বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছে ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা
গত ১৪ মে বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার খান ইউনিসের কাছে একটি তাঁবুতে শিক্ষার্থীরা বালির উপর বসে ক্লাস করছেন।
মিশরের কায়রো থেকে দুই বোন পশ্চিম তীরের একটি স্কুলে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন।
অন্যদিকে, জার্মানির একজন অধ্যাপক ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগে সহায়তা করছেন। তাদের জন্য এটিই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের একমাত্র উপায়।
১৩০ দিনেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি মুহুর্মুহু বিমান হামলায় সেখানকার স্কুল ও শ্রেণিকক্ষগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, শিক্ষকেরা বাস্তুচ্যুত বা নিহত হয়েছেন এবং লাখ লাখ শিশুর শিক্ষা জীবন ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
ইসরায়েলি বোমা হামলার কারণে শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশে থাকা ফিলিস্তিনি দূতাবাস তার দেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়ার আবেদন করেছে।
বিশেষ করে পাকিস্তান, সিরিয়া, ইরানের মতো মুসলিম দেশগুলোর অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সংকটে থাকা ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি দিচ্ছে।
গত জানুয়ারিতে লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সহযোগিতায় ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ হাজার বৃত্তি, ফেলোশিপ এবং সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রস্তাব দেয়।
বাংলাদেশও এই লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। ঢাকার ফিলিস্তিনি দূতাবাস এবং এক্সেলস কনসালটেন্সি নামে একটি উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ৮৪ জন ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী (৮০ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী) ছাড়াও, আরও ৩০০ জন শিক্ষার্থীর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা নিতে আসার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তত ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় এসব শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
শিক্ষার্জনের জন্য একটি দারুণ গন্তব্য
বাংলাদেশে বসবাসরত ফিলিস্তিনি তরুণদের অধিকাংশই চিকিৎসা ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
২০২১ সালে গাজা থেকে ঢাকায় আসা ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) এমবিবিএস শিক্ষার্থী ইব্রাহিম এস কিশকো বলেন, 'আমার পরিবারের সদস্যরা যখন ফিলিস্তিনে মারা গেল, আমার শিক্ষক, হলমেট এবং সহপাঠীরা তখন তখন আমার প্রতি মানসিক ও একাডেমিকভাবে আন্তরিক সমবেদনা ও সমর্থন জানিয়েছিল। তারা আমাকে শোক কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছিল।'
ইব্রাহিম বলেন, 'কেউ কেউ আমাকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তাও দিয়েছেন। সবার ভালোবাসা ও সমর্থনে এই দেশকে দ্বিতীয় বাড়ির মতো মনে হচ্ছিল। এখানে সবাই বন্ধুসুলভ।'
ইসহাক নামুরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
তিনি বলেন, 'এই দেশটা আমার কাছে ভালো ও উদারতার আরেক নাম। আমি দারুণ কিছু বাংলাদেশি বন্ধু পেয়েছি।'
ইসহাক বাংলাদেশে ফিলিস্তিনি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।
বাংলাদেশে ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক কোনো সংগঠন না থাকলেও, ফিলিস্তিন দূতাবাসের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ইসহাক বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের সমর্থনে সমাবেশেও নেতৃত্ব দেন।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ আমাদের প্রতি এবং আমাদের দেশের প্রতি যে ভালোবাসা দেখায়, তা আমাকে অভিভূত করেছে। শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ দেশ এবং এখানকার মানুষ খুবই সুন্দর ও অতিথিপরায়ণ।
তিনি আরও বলেন, 'এখানে আমার যে ফিলিস্তিনি বন্ধুরা আছেন, তারাও বাংলাদেশের পরিবেশের প্রশংসা করেছেন। সুতরাং, ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের এই দেশে আসার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত সুযোগ, এখানে তাদের আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানানো হবে।'
আরেক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আবু আয়াদা বলেন, 'আমি কোভিড-১৯ মহামারির সময় এসেছিলাম, সেসময় কোয়ারেন্টাইন চলছিল। সবকিছুই আমার কাছে অপরিচিত ছিল, শুরুতে আমার নিজেকে একা মনে হচ্ছিল।'
আয়াদা বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন।
তিনি জানান, কোয়ারেন্টাইন, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, অপরিচিত শিক্ষাব্যবস্থা ও অনলাইন ক্লাসের কারণে শুরুর দিকে তার মানিয়ে নিতে ও চলাফেরা করতে অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, ততই মানিয়ে নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, যারা ভোজনরসিক, তাদের জন্য বাংলাদেশ আশীর্বাদ। 'এখানকার খাবার বৈচিত্র্যময় ও সুস্বাদু। খিচুড়ি আমার অন্যতম প্রিয় খাবার।'
আয়াদা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, 'আমি কক্সবাজার, সিলেট ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের মতো চমৎকার কিছু জায়গায় ঘুরতে গেছি। এসব স্থান বেড়ানোর জন্য খুবই চমৎকার।'
আয়াদা বলেন, 'শুরুতে বাংলাদেশ আমার জন্য অবশ্যই একটি বড় কালচারাল শক ছিল। আমি কিছু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়া সত্বেও, এই দেশ আমাকে যে আতিথেয়তা ও শিক্ষা দিয়েছে, সেজন্য এই দেশের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।'
বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি চালু করার কারণেও এসব ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন।
এক্সেল কনসালটেন্সি সাহায্যে এগিয়ে আসে
শের এ নাসের খান এবং দায়ি আবদুল্লাহ'র প্রতিষ্ঠিত এক্সেল কনসালটেন্সি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করে।
তবে তারা এখন আগত ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও দূতাবাসের মধ্যে যোগাযোগ সহজতর করতে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এক্সেলস কনসালটেন্সির ম্যানেজিং পার্টনার শের এ নাসের খান বলেন, 'আমরা যোগাযোগ করা বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এসব শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করতে এবং ভর্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে তারা এসব শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারবে না বলে জানিয়েছে।'
তিনি বলেন, 'তাই আমরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছি যেখানে আবাসন সুবিধা রয়েছে। যেমন এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ছাত্রীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে রাজি হয়েছে।'
ইসহাক বলেন, 'আমাদের শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের এ ধরনের সহায়তা খুবই প্রয়োজন।'
সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক শামস মোঃ এনাম বলেন, 'কিছু ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী তাদের দেশে আংশিক মেডিকেল পড়াশোনা সম্পন্ন করেছে। তাই তারা এখন তাদের ক্রেডিট এনাম মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করতে পারে। যারা শুরু থেকে শুরু করতে ইচ্ছুক তাদেরও আমাদের ক্যাম্পাসে স্বাগত। '
তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু আমাদের অন্যান্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মেয়েদের আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে, তাই ফিলিস্তিনি নারী শিক্ষার্থীরা আমাদের এখানে থাকতে পারে।'
এক্সেলস কনসালটেন্সি শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সব কাগজপত্র এবং যোগাযোগ পরিচালনা করবে, তারা কোথায় পড়াশোনা করবে এবং থাকবেন তা নিশ্চিত করবে।
এক্সেলস কনসালটেন্সির ম্যানেজিং পার্টনার দায়ি আবদুল্লাহ বলেন, 'প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় দূতাবাসের চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করে, আমরা সব কাগজপত্র দিয়ে দূতাবাসকে সহায়তা করতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি।'
ঢাকাস্থ ফিলিস্তিন দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন জিয়াদ এম এইচ হামাদ বলেন, 'যেহেতু বাংলাদেশে আসার পর সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা এবং এসব শিক্ষার্থীর চাকরি করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং, তাই এক্সেল কনসালটেন্সি আমাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে এসেছে। '
ফিলিস্তিনি দূতাবাস প্রায় ৩০০ ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি), ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি), নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিসহ (এইউএসটি) ৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃত্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে, নারী শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিবছর অন্তত ২০ জন ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সে বৃত্তি ও আবাসন সুবিধা পাবেন।
আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের স্নাতক শ্রেণীতে আবাসন সুবিধা ও বৃত্তি দেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ রামাদান গাজায় ইসরাইলের চলমান সামরিক অভিযানের সময় ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় সহায়তার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের মুসলিম বিশ্বের সমর্থন প্রয়োজন। দখলদারদের হাতে নিহত ফিলিস্তিনের শিশু ও শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের (ফিলিস্তিনিদের) সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য আপনাদের প্রয়োজন।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি