ঢাকার সার্কুলার ওয়াটারবাস শুরু হলো, শেষ হলো!
সদরঘাট থেকে পশ্চিম দিকে আহসান মঞ্জিল পার হয়ে বাদামতলী। বছরভর নানান জাতের নানান রকম ফল মেলে বাদামতলীতে। আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বিদেশ থেকেও। ফলের আড়ত অনেকগুলো এখানে। এখন এই আমের মৌসুমে বাদামতলী এক দর্শনীয় জায়গা। বিক্রেতার হাকডাক আর ক্রেতার দামাদামিতে সরগরম।
জুন মাসের ২৪ তারিখ ছিল সেদিন। আম দেখে ও গন্ধ শুঁকে মুগ্ধ আমি। ফলপট্টির ওধারে বুড়িগঙ্গার বাদামতলী ঘাট। অবসরে পাঠানোর পর থেকে রকেট স্টিমারগুলো এ ঘাটে ভিড়ে থাকে। গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে কলকাতার গার্ডেন রিচ ডকে এগুলো তৈরি করা হয়েছিল। ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল-খুলনা হয়ে কলকাতা চলাচল করতো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষ বসু, কবি জীবনানন্দ দাশ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা এর যাত্রী হয়েছিলেন। ফ্লোরিকান, কিউয়ি, ফ্লেমিঙ্গো, শেরপা, পাঠান, লালি ইত্যাদি নামের স্টিমারও ছিল। এখন আছে অস্ট্রিচ, টার্ন, মাহসুদ ও লেপচা।
বছর কয় হলো এরা আর যাত্রী বহন করে না, অবসর কাটায় বাদামতলী ঘাটে। স্টিমার দেখব বলে ঘাটে গেলাম। শত বছর বয়সী জলযানগুলো দারুণ আকর্ষণীয়। এগুলোর রঙ কমলা, মেঝে কাঠের, পানি ভাঙার জন্য আছে দুপাশে দুই বিশাল চাকা, পেটের দিকটা খোলা। লেপচার পেছনে ক্ষুদ্রাকার কিছু জলযান বাঁধা দেখতে পেলাম। গায়ে নাম লেখা- ওয়াটার বাস।
একসময় ঢাকাবাসীকে আশান্বিত করেছিল ওয়াটার বাস। যানজটে নাকাল ঢাকাবাসী ভেবেছিল নদীর হাওয়া গায়ে লাগিয়ে কম সময়ে পৌঁছে যাবে গাবতলী, আশুলিয়া কিংবা টঙ্গী। কিন্তু দফায় দফায় ওয়াটার বাস সার্ভিস বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, এখন এ প্রকল্প আর কোনো আশা দেখাচ্ছে না। স্টিমারের মতো ওয়াটার বাসগুলোও বসে আছে বাদামতলী ঘাটে। বসে থেকে থেকে গায়ে জং ধরিয়ে ফেলেছে। তাহলে কর্মীদের কী অবস্থা?
এগিয়ে গিয়ে রাজীব হাসানের দেখা পেলাম। ২৭ বছর বয়স তার। এই বয়সে সারাদিন বসে থাকতে ভালো লাগার কথা নয়, রাজীবেরও ভালো লাগে না। শুয়ে-বসে থাকা ছাড়া কাজ নেই তার, অথচ আছে চাকরি। ফলে নেই চাকরি খোঁজার ব্যস্ততাও। এমন দ্বিমুখী ঝামেলায় বিষন্ন রাজীব।
ম্যানেজমেন্টে গ্রাজুয়েট হয়েছেন রাজীব, তারপর চাকরিপ্রাপ্তির সুবিধা হবে ভেবে নৌযান প্রকৌশল বিষয়ে মাদারীপুরের মেরিটাইম ইনস্টিটিউটে অধ্যয়ন করেছেন। যেদিন তিনি বিআইডব্লিউটিসির (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহন কর্পোরেশন) একটি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে ঢাকায় যাচ্ছিলেন, সেদিনের ঘটনাটা তার আজও মনে আছে।
তাদের পরিবহনকারী ফেরিটি একটি ডুবোচরে আটকে যায়, সহসা এ থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছিল না, তখন এক যাত্রী ব্যাপক কান্না জুড়ে দেন। রাজীব কাছে গিয়ে জানতে পারেন লোকটির দুবাইয়ের ফ্লাইট দুপুর সাড়ে তিনটায়। রাজীব সমব্যথী হয়ে ফেরির চালকের সঙ্গে কথা বলেন এবং একটি পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। তখনই ফেরিটির গায়ে একটি ট্রলার এসে ভিড়ে। সেটি ছিল পাইলটের ট্রলার।
পাইলটরা নৌযানের পথ নির্দেশ করেন। কোথায় কোথায় ডুবোচর আছে, কোন জায়গার নাব্যতা কতটুকু ইত্যাদি বিষয় তারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করেন এবং নিশানা পুতে রাখেন। কিন্তু রাত গভীরে বা ঘন কুয়াশায় নিশানা সব সময় ঠাহর করা যায় না, তখনই বিপদে পড়ে নৌযান। পাইলটকে ডেকে এনে জেনে নেওয়া হয় পানির গভীরতা কোথায় বেশি, যান চলাচল কোন দিক দিয়ে সহজ হবে।
পাইলটকে অনেক বলেকয়ে দুবাইগামী যাত্রীকে সঙ্গে করে রাজীব ট্রলারে চাপলেন। তীরে নেমে সড়ক পথ ধরে দুপুর নাগাদ কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছালেন, তারপর ট্রেনে করে বিমানবন্দর স্টেশনে গেলেন, তারপর দৌড়াতে দৌড়াতে বিমানবন্দরে ঢুকলেন। তখন বিমান ছাড়তে অল্প সময় বাকি ছিল। ওই যাত্রী রাজীবকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন আর বলেন, "যে উপকার করলেন, জীবনেও ভুলব না। দুবাইয়ে গিয়ে আপনাকে ফোন করব।"
একদিন যখন দুবাই থেকে ফোন এলো, রাজীবের তখন বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি হয়েছে। পদায়ন হয়েছে মাওয়ার এক ফেরিতে। ফেরির তিনি ইঞ্জিনম্যান। ফোন পেয়ে রাজীব ভাবেন, ফেরিতেই মানুষটির (দুবাই যাত্রী) সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, আর চাকরি সে করেন এখন ফেরিতেই। অবাক লাগে তার।
মাওয়ায় তার ভালোই কাটছিল, নতুন নতুন অনেক কিছু শিখেছেন। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে ফেরি বন্ধ হয়ে যায়, রাজীবকে বদলি করা হয় বাদামতলী ঘাটে, ওয়াটার বাসের ইঞ্জিনম্যান হিসাবে। কিন্তু বছর গড়াতে চললেও ইঞ্জিন চালু করার সুযোগ মিলেনি।
ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে ২০১০ সালে ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথে চালু করা হয়েছিল সার্কুলার ওয়াটার বাস সার্ভিস। উদ্দেশ্য ছিল দুঃসহ যানজট কমানো এবং দখল-দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগকে রক্ষা করা। বিআইডব্লিউটিএ (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ) ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে বৃত্তাকার নৌপথ চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।
২০০৪ সালে উদ্বোধন করা হয় নৌপথটির। তখন বিআইডব্লিউটিএ'র চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌ যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. রিয়াজ হাসান খন্দকার।
তিনি বলেছিলেন, "বহুমুখী লক্ষ্য নিয়ে নৌপথটি চালু করা হয়েছিল। যানজট কমাতে বিকল্পপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগকে অবৈধ দখল ও দুষণের হাত থেকে রক্ষা করা এবং নৌপথে ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করে রাজধানী ও আশপাশের মানুষের বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করা ছিল অন্যতম। ওইসব লক্ষ্য সামনে রেখে খনন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্ভাব্য দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে নৌপথটি উদ্বোধনও করা হয়েছিল। এরপর এটি জনপ্রিয় করতে বিআইডব্লিউটিসি নিয়মিত ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করলেও অল্পদিনের মধ্যেই যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়।"
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং 'বাংলাদেশের নদ-নদী ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থা' শীর্ষক বইয়ের লেখক আশীষ কুমার দে বলছিলেন, 'এটি ছিল একটি চমৎকার উদ্যোগ। উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সরকার আন্তরিকও ছিল নতুবা দফায় দফায় এটি নবায়ন করা হতো না। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় এটি কার্যকর হতে পারল না। এগুলোর মধ্যে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আছে, তবে মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতাই বেশি দায়ী।'
সাধারণভাবে ওয়াটার বাস সার্ভিস ভেস্তে যাওয়ার পেছনে নাব্যতাহীনতা, ল্যান্ডিং স্টেশনে নিরাপত্তার অভাব, পানি দূষণ, ওয়াকওয়ে না থাকা, অসুন্দর নদীতীর, সড়ক থেকে নৌঘাট পর্যন্ত যানবাহনের অভাব ইত্যাদি কারণ উল্লেখ করা হয়। উপরন্তু, ছোট নৌযান ও বালুবাহী জাহাজের বিশৃঙ্খল চলাচলে ওয়াটার বাস পূর্ণ গতিতে চালানোও যাচ্ছিল না। নৌপথের পাশ দিয়ে বেড়িবাঁধ ধরে চলা বাহনে গন্তব্যে পৌঁছাতে যেখানে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে, সেখানে ওয়াটার বাসে যেতে দেড় ঘণ্টা লেগে যেত। সড়কপথে যেখানে সেখানে ওঠানামার সুযোগ আছে, কিন্তু ল্যান্ডিং স্টেশন ছাড়া ওয়াটার বাসে ওঠা-নামার সুযোগ নেই। সময়মতো বাস না ছাড়াও নৌপথটির জনপ্রিয়তা হারানোর একটি কারণ।
আরও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নৌযানমালিকদের স্থানীয় সিন্ডিকেট। তারা অভিযোগ তুলেছিল, ওয়াটার বাসের গতিতে অন্য নৌযানগুলোর সমস্যা হয়। বসিলা ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় ওই অভিযোগে কয়েকবার ওয়াটার বাস আটকে দিয়েছিল ট্রলার, নৌকা ও বালুবাহী নৌযানের মালিক-শ্রমিকেরা। একবার বসিলার বাসিন্দারা ওয়াটার বাসের গতির কারণে নদীর পাড় ভাঙার অভিযোগপত্রও দাখিল করেছিল। অক্টোবর থেকে মার্চ বুড়িগঙ্গায় চরম দূষণ থাকে। ওয়াটার বাসের প্রপেলারের সঙ্গে গার্মেন্টের ঝুট, পলিথিন আটকে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা যায়।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেলো, ২০০৪ সালে ওয়াটার ট্যাক্সি প্রথমবারের মতো যাত্রা শুরু করে। তবে মাসখানেক পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় চালু হয় ২০১০ সালের আগস্ট মাসে। টিকে ছিল মোটে ১১ মাস। তৃতীয় দফায় চালু হয় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। তখনকার নৌপরিবহনমন্ত্রী জলযানগুলোর নামকরণ করেন ওয়াটার বাস।
আরও জানা যায়, তিন দফায় নির্মিত ১২টি ওয়াটার বাসে খরচ হয়েছে ৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সদরঘাট-গাবতলী নৌপথে আয় হয় ৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। তবে এই সময়কালে কেবল জ্বালানি বাবদ খরচ হয়েছিল ৪১ লাখ টাকা। এরসঙ্গে যোগ হবে কর্মীদের বেতন-ভাতা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়।
পৃথিবীর খুব কম শহরই ঢাকার মতো ভাগ্যবান, দুর্ভাগা অবশ্য একটিও নেই। ভাগ্যবান এ কারণে যে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা মোট পাঁচটি নদ-নদী এর চারদিকে। আর দুর্ভাগা এ কারণে যে, সবগুলো নদ-নদী দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। না যাত্রী পরিবহন, না মালামাল পরিবহন— কোনোভাবেই এগুলোকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না— আক্ষেপ বহুদিনের, সব মহলের।
সড়ক, রেল ও নৌপথ সমন্বিত করেই পৃথিবীর উন্নত শহরগুলোয় যানজট নিরসন করা হয়ে থাকে। পাঁচটি নদ-নদী দিয়ে ঢাকার চারদিকে ১১০ কিলোমিটার নৌপথ। পুরোটা ব্যবহার করার কথাই ভাবা হয়েছিল প্রথমে। বিভিন্ন রুটে স্থাপন করা হয়েছিল ১২টি ল্যান্ডিং স্টেশন। সদরঘাট, খোলামোড়া, বসিলা, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া, টঙ্গী, উলুখোলা, ডেমরা, কাঁচপুর, শ্যামপুর, ফতুল্লা হয়ে চলাচল করার কথা ছিল ওয়াটার বাসের। কিন্তু সদরঘাট-গাবতলী আর টঙ্গী-নারায়ণগঞ্জ রুট ব্যর্থ হওয়ায় বাকিগুলো আলোচনার বাইরে চলে গেছে। মাঝখান থেকে জলে গিয়েছে কোটি টাকা, বস্তুত শত কোটি টাকা।
ধারাবাহিক লোকসান থেকে রেহাই পেতে ২০১৭ সালে বিআইডব্লিউটিসির সমীক্ষা কমিটি ১২টি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছিল। এগুলো হলো— বুড়িগঙ্গার পানি দুর্গন্ধমুক্ত করা, ঘাটগুলোয় যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন, উভয় পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নৌযানগুলোয় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু কোনোটিই কার্যকর হয়নি। ফলে ওয়াটারবাসগুলোর বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
২০১০ সালের জুলাইয়ে নামানো হয় দুটি ৩৫ আসনবিশিষ্ট ওয়াটার বাস, ২০১৪ সালে চালু হয় আরও ৪টি– যেগুলোর প্রতিটিতে আসনসংখ্যা ৮৩। ২০১৪ সালেরই শেষ দিকে ৪৬ আসনবিশিষ্ট আরও ছয়টি বাস যুক্ত করা হয়। পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাসগুলো সদরঘাট-গাবতলী রুটে চলাচল করবে।
আশীষ কুমার দে বলছিলেন, "বৃত্তাকার নৌপথ সচল থাকলে যাত্রীদের ভোগান্তি যেমন কমতো, তার চেয়েও বড় কথা শহরবাসী নদীমুখী হতো। ফলে নদী দূষণ ও দখলমুক্ত করা সহজ হতো। নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকায় নতুন প্রাণ সঞ্চার হতো।"
২০১০ সালে যেদিন ওয়াটার বাস যাত্রা শুরু করে, সেদিনকার ফিরতিযাত্রায় আশীষ কুমার দে যাত্রী হয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন বাঁকগুলোতে বাসগুলোকে বেগ পেতে হচ্ছে। বলছিলেন, "খুব তাড়াহুড়া করে নৌপথটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। নাব্যতা সংকট মোচনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, পরে ধারাবাহিক ড্রেজিংও করা হয়নি। নৌযানগুলোতেও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যেই। তাই বলা চলে, গলদ ছিল গোড়াতেই।"
রকেট স্টিমারের কর্মীদেরও চাকরি আছে, কিন্তু কাজ নেই। দিবানিদ্রার অভ্যাস হয়ে গেছে প্রায় সবার। মাঝে মধ্যে মোবাইলে লুডু, তাস খেলে সময় কিছু পার করে। সারাদিনই অবসর তাই আলাদা করে অবসর বলে কিছু নেই।
জামাল মিয়া (আসল নাম নয়) ঠিক মনে করতে পারেন না কবে থেকে ঘাটে বসে আছেন। তবে করোনার আগে থেকে যে তা ঠিক মনে আছে। তিনি ওয়াটার বাসের লস্কর। যারা নৌযান ঘাটে ভিড়ানোর, দড়ি-দড়া পন্টুনে বাঁধার কাজ করেন তারা লস্কর। রাতে নৌযান পাহারা দেওয়া তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব। সার্ভিস বন্ধ হওয়ার দুই বছর আগে তিনি কাজে যোগ দেন। যাত্রী বেশি হতো না তখনো, তবে দিনে দুবার আপ-ডাউন করতেন। তার মন্দ লাগতো না এ কাজ, তবে বসে যাওয়ার পর থেকে সময় আর কাটতে চায় না। ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তা হয়।
সরকারী চাকরি চলে যাওয়ার ভয় কম, কিন্তু উন্নতির আশা দেখেন না। একজন মাস্টার বা সারেং, একজন টিকিট মাস্টার, একজন ইঞ্জিনম্যান বা ড্রাইভার, একজন বাবুর্চি, একজন লস্কর ও একজন ক্লিনার— মোটমাট ৬ জনের দল তাদের নৌযানে। তাদের ডিউটি ২৪ ঘণ্টার, নৌযানেই রাত-দিন, থাকা-খাওয়া সবকিছু।
ওয়াটার বাস আর রকেট স্টিমার মিলিয়ে ৭০-৭৫ জনের অলস সময় কাটে বাদামতলী ঘাটে। জামালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কর্মহীন জীবন কেমন লাগে?
জামাল বলেছিলেন, "এ জীবনের কোনো মূল্য নেই। খেয়ে ঘুমিয়ে সময় শেষ করছি। আবার কবে চলতে পারব তার ঠিক নেই কোনো।"
বেশি দুঃখী মনে হলো রাজীবকে। পরিবার থেকে তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে বসে থেকে থেকে উন্নতির কোনো আশা দেখছেন না। বিয়ে করতেও সাহস পাচ্ছেন না। সবে জীবনের শুরু, এখনই তো জোরসে কাজে লেগে থাকার বয়স।
আশীষ কুমার দে বললেন, "সার্কুলার ওয়াটার বাস সার্ভিস আবার চালু হবে এমন আশা দেখছি না। কর্মীদের দক্ষতা নষ্ট হচ্ছে বসে থেকে থেকে, এটা উদ্বেগের বিষয়। বসে থেকে থেকে বাসগুলোও নষ্ট হচ্ছে। এটা মোটেও কাম্য নয়।"