২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলন যেভাবে ২০২৪ সালের বিপ্লব জন্ম দিয়েছে
সাদিয়া নওরিন একজন তরুণ চাকরিজীবী। তিনি সম্প্রতিই সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কোটা সংস্কার আন্দোলনই পরে সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়।
তিনি আন্দোলনে গেছেন একবারে নিঃস্বার্থভাবে। প্রতিদিনই চিন্তা করে গেছেন তিনি হয়ত আর ফিরবেন না। তাই, বাইরে যাওয়ার আগে নিজের ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংকের বিবরণী ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সবকিছু বাড়িতে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।
তবে তার এ সাহস একদিনে গড়ে ওঠেনি। তার এ সাহসিকতার রূপকার হলো ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন।
ছয় বছর আগে ২৯ জুলাই বাসচাপায় মারা যান ঢাকার এক হাইস্কুলের দুই শিক্ষার্থী। তাদের মৃত্যু তখন বিক্ষোভের জন্ম দেয়। সেই বিক্ষোভ জুলাই থেকে শুরু হয়ে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে। কাকতালীয়ভাবে এ বছরের কোটা আন্দোলনও একই সময়ে হয়েছে।
যে তরুণরা তীব্রভাবে রাজনীতি বিমুখ হয়ে উঠেছিল, সেই সড়ক আন্দোলনই তাদের মধ্যে নতুন করে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত করে। ২০১৮ সালে সড়কে নিরাপত্তার মতো জনস্বার্থমূলক আন্দোলনে তরুণরা জনসাধারণকে যুক্ত করতে পেরেছিল এবং নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছিল। এবার শুধু আন্দোলনের বিষয় 'কোটা সংস্কার' ছিল কিন্তু তাদের সক্ষমতা আগেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সাদিয়া ছিলেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি তখন প্রথমবারের মতো আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভাবতে পারেননি যে তার এ অংশগ্রহণই তার রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে চিরতরে বদলে দিবে।
তিনি বলেন, "নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর থেকে আমি সবকিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করি। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি যে প্রায় সবকিছুই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এটি আমাদের মৌলিক অধিকার এবং এটি আমাদের জীবনযাত্রাকে সংজ্ঞায়িত করে। এ আন্দোলন আসলে শুধু সড়কে নিরাপত্তার দাবি ছিল না, এটি ছিল সামগ্রিকভাবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। সবাই জানতো পরিবহণ খাতে সরকার সমর্থিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গিয়ে ওই দুজন মৃত শিক্ষার্থীর জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল।"
তিনি আরো বলেন, "তখন থেকেই আসলে আমি শিখেছি যে বিনামূল্য কিছু পাওয়া যায় না। আমাদের অধিকারের জন্য অবশ্যই আমাদের লড়তে হবে। তাই আমি যখনই কোনো মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান পাই, তখনই আমি কাজ করতে প্রস্তুত থাকি।"
গত পাঁচ বছর ধরে সাদিয়া নিজের মধ্যে একই চেতনা ধারণ করে গেছেন। ২০২২ সালে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারী উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আন্দোলনটি ছিল মূলত ছাত্রীদের আবাসিক হলগুলোতে উন্নত সুযোগ-সুবিধার দাবিতে। কিন্তু ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশ গুলি চালানোর কারণে এটি তখন এক দফা দাবিতে পরিণত হয়।
২০১৮ ও ২০১৪ উভয় আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা আরেক শিক্ষার্থী হলেন সৈয়দ কিঙ্কেল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ছেন। তিনি আরো চমকপ্রদ কিছু তথ্য যোগ করেন।
সৈয়দ কিঙ্কেল বলেন, "নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমি সবেমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি। আমরা প্রাথমিকভাবে উত্তরায় আন্দোলন করেছি। সে সময় নবম শ্রেণি থেকে শুরু করে কলেজ শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত রাস্তা নেমেছিল। ২০১৮ সালের আন্দোলন আমাদের মধ্যে এ অনুভূতি জাগ্রত করেছিল যে স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীদেরও ভূমিকা আছে। এবারের আন্দোলনে আমরা দেখেছি স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরা স্ব-উদ্যোগে রাস্তায় নেমে গিয়েছে। কোটা ইস্যুতে তাদের ব্যক্তিগত কোনো চাহিদাও নেই তারপরও তারা এতে যোগ দিয়েছে।"
তিনি আরো বলেন, "আরেকটি বিষয় হলো আগের আন্দোলন থেকেই এটি সবার মধ্যে সেট হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে, এবার সবকিছু করা অনেক সহজ ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উত্তরায় বিএনএস সেন্টার ও হাউস বিল্ডিং ছিল আমাদের জড় হওয়ার স্থান। তাই নতুন করে কোনো জড় হওয়ার জায়গা খোঁজার প্রয়োজন পড়েনি। তাই সবাই জানতো কোথায় আসতে হবে।"
যদিও আন্দোলন দুটি ভিন্ন দুটি বিষয়ের দাবিতে হয়েছিল, তারপরও দুটি আন্দোলন কিছু ক্ষেত্রে এক। কারণ বহু বছর ধরে চলা অন্যায় থেকে জন্মানো ক্ষোভই আন্দোলনগুলোকে শক্তি দিয়েছিল।
এ বছরের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। কারণ একটা সামান্য কোটা সংস্কার আন্দোলনই পরবর্তীতে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবির আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলনে শহিদদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তাকে স্বৈরাচারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান শুরু হয়। তবে কোনো একক ঘটনার কারণে তিনি স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হননি। এটি তার ১৫ বছরের কৃতকর্মের ফল।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল নায়ক 'সমন্বয়ক'-দের সাহস ও নেতৃত্বের উৎস হলো ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সড়ক আন্দোলন।
নুসরাত তাবাসসুমের কথাই ধরুন। প্রতিদিনের কর্মসূচি ঘোষণা থেকে শুরু করে গোয়েন্দা শাখার হেফাজতে থাকা পর্যন্ত সব কিছুতেই তিনি জড়িত ছিলেন।
নুসরাত সেসময়ের সড়ক আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, "সড়ক আন্দোলনের সময় আমি একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। এটি আমার প্রথম আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছিল। আমি তখন কলেজ শিক্ষার্থী। জিগাতলায় যখন আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মম হামলা চালানো হয় সেখানেও আমি ছিলাম। ওইদিনের অভিজ্ঞতা চিরকালের জন্য আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে।"
নুসরাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। সেখানেও তিনি ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন বলে জানান। তবে তিনি এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদে যোগ দেন। পরে তিনি এর ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টে যোগ দেন। সেসময় এ ছাত্র সংগঠনের সদস্য সচিব ছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আইসিটি ও তথ্য উপদেষ্টা এবং কোটা আন্দোলনের মূল সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলাম।
এই দায়িত্ববোধ শুধু প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারে পতনের পর সারাদেশে পুলিশ কর্মকর্তারা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাজ থেকে বিরত থাকেন।
এসময় ছাত্ররাই আবার দেশের শৃঙ্খলা ফেরাতে রাস্তায় নেমে পড়েন। ২০১৮ সাল যেন আবার 'ডেজা ভু' হয়ে ফিরে আসে। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বিশেষ লেন, প্রতিটি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখা থেকে শুরু করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও রাস্তা পরিষ্কার সব ক্ষেত্রই তখন শিক্ষার্থীদের দখলে।