বন্যায় অপেশাদার ‘হ্যাম’ রেডিও অপারেটররা যেভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন
১৯ আগস্টের আকস্মিক বন্যা ফেনী জেলাকে এক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। হঠাৎ করে পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে ফেনীর বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়, ব্যাহত হয় সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ বিপর্যয়ের সময় ফেনীতে অবস্থান করছিলেন ড. আসিফ-উদ-দৌলা, এক অপেশাদার রেডিও অপারেটর। অনেকটা শখের বশেই 'হ্যাম' রেডিও অপারেট করেন তিনি।
বিশেষ ধরনের রেডিওর মাধ্যমে দূর দেশের আরেক রেডিও গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা। তাদের হ্যাম বলা হয়। বাণিজ্যিক কাজে এই রেডিও ব্যবহার করা যায় না। মূলত শখ মেটাতেই এটি ব্যবহৃত হয়। এজন্য অবশ্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে লাইসেন্স নিতে হয়।
তবে, দুর্যোগকালে এই হ্যাম রেডিওই সারাদেশের সাথে ফেনীর যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বন্যায় আটকে পড়া আসিফ যোগাযোগ সংকটের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঢাকায় থাকা অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের সাথে যোগাযোগ করেন। তার বার্তা ছিল স্পষ্ট—ফেনীর জনগণকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত কিছু করতে হবে।
পুরো কার্যক্রমের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে থাকা আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ বলেন, "আমরা তার কাছে তৎক্ষণাৎ পৌঁছাতে পারিনি, কিন্তু তিনি আমাদের ফেনীর পরিস্থিতি সম্পর্কে অনবরত জানাচ্ছিলেন।"
আসিফ চারদিন পানিবন্দি থাকলেও তার আহ্বান অন্যান্য সহকর্মী অপারেটরদের উদ্যোগী করে তোলে। প্রথাগত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় নিজেদের উদ্যম এবং তহবিল ব্যবহার করে তারা দ্রুত সংকট মোকাবিলায় নামেন।
ফাহাদ বলেন, "আমরা জানতাম আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল উদ্ধারকারীদের সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখা। বন্যার তীব্রতা যতটা ব্যাপক, তার চেয়েও বেশি ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা—সবাইকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে হবে।"
ঢাকায় থাকা তাদের স্কাউটস এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির নেটওয়ার্কের সদস্যরা—দ্রুত একত্রিত হয়ে একটি ডেটাবেজ তৈরি করে আটকে পড়া লোকদের তালিকা করতে শুরু করে। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী আহমেদ ইবনে আরিফ জানান, "আমরা একটি সিস্টেম গড়ে তুলি যাতে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি এবং তা কাজে লাগিয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে পারি।"
টিমের আরেক সদস্য শিহাব উদ্দিন সানি বলেন, "আমরা ফেনীর বেইজ স্টেশন থেকে সেনাবাহিনীর কাছে তথ্য পাঠাতাম। তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই তথ্যের ভিত্তিতে উদ্ধারকাজ শুরু করত।"
টিমটির প্রচেষ্টার একটি বড় অংশ ছিল সেনাবাহিনী ও ফেনীর জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন। এই সম্পর্কে ফাহাদ বলেন, "ডিসি অফিসের কাছে ঠিকঠাক তথ্য ছিল না। আমাদের মূল ফোকাস ছিল পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত রাখা। যাতে তারা ঠিকভাবে রিসোর্স প্রয়োগ করতে পারে। এমনকি আমরা ডিসি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের সুবিধার্থে একটি পৃথক বেইজ স্থাপন করেছি।"
২২ আগস্ট সন্ধ্যায় ফাহিম এবং তার দল ফেনীতে 'তারা নিবাস' নামের একটি ১৫ তলা ভবনের ছাদে প্রথম বেইজ স্টেশন স্থাপন করেন। একইসাথে, ডিসি অফিসে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। রাত ৯টায় সাব্বির হোসেন, এমওবি জিহাদ এবং মনিরুজ্জামান রিফাত প্রথম রেসপন্ডিং টিমের সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
জিহাদ পুরো উদ্ধার কাজ সমন্বয় করার দায়িত্ব নেন এবং পরের দিন সানি, মুতাম্মিম মাহমুদ আসিফ ও ডা. দিপ্তসহ আরও বেশ কয়েকজন অ্যামেচার রেডিও অপারেটর দলে যুক্ত হন। একইসাথে তারা মেডিকেল স্টুডেন্টদের দল নিয়ে 'প্ল্যাটফর্ম ফর ডক্টরস' ও মেডিকেল স্টুডেন্টস কমিউনিটিকে ফেনীতে নিয়ে আসেন।
মহিপাল আর্মি ক্যাম্পের সহযোগিতায় তারা দ্রুত আরও দুটি স্টেশন স্থাপন করেন—একটি মহিপাল আর্মি ক্যাম্পে এবং আরেকটি অস্থায়ী আর্মি মেডিকেল ক্যাম্পে।
ফাহাদ বলেন, "আমরা জানতাম আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। আমরা ডিসি অফিস, আর্মি ক্যাম্প, ফিল্ড রেসকিউ টিম এবং মেডিকেল ক্যাম্পের মধ্যে যোগাযোগের একটি কার্যকর চেইন তৈরি করতে পেরেছিলাম, যা সামগ্রিক উদ্ধার মিশনকে অনেক সহজ করেছিল।"
তিনি আরও বলেন, "ঢাকায় কাকরাইল স্কাউট সদর দফতরে আমরা একটি বেইজ স্থাপন করেছি। আরেকটি ডেমরায় আমার বাড়িতে স্থাপন করি। যেহেতু আমি সব সময় স্কাউট অফিসে থাকতে পারতাম না।"
"আমি কেবল একমুখী যোগাযোগ করতে পারতাম, কিন্তু ফিরতি কোনো জবাব শুনতে পেতাম না," বলছিলেন ফাহাদ। "কিন্তু ১৫ তলা ভবনের ছাদে কিছু সংকেত পাওয়া যাচ্ছিল, যেখান থেকে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে তারা আমাকে শুনতে পাচ্ছে। তাই, আটকে পড়া লোকজন বা যাদের জরুরি ত্রাণ প্রয়োজন, তাদের সম্পর্কে আমার কাছে থাকা সব তথ্য আমি পাঠিয়ে যেতে থাকি, যাতে সেই তথ্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী এবং ডিসি অফিস যথাযথভাবে রিসোর্স মোবিলাইজ করতে পারে।"
বন্যার কারণে সেনাবাহিনীর নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সেনা ক্যাম্প এবং ফিল্ড টিমগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। যখন উদ্ধার ও ত্রাণবাহী নৌকা দূরবর্তী স্থানে পাঠানো হচ্ছিল, প্রতিটি নৌকায় একজন স্বেচ্ছাসেবক রেডিও অপারেটর ছিল, যিনি প্রতি ৩০ মিনিট পরপর ফেনী কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখছিলেন।
এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ বজায় রাখার মাধ্যমে তারা ৩৭৫টিরও বেশি সফল উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। ফাহাদ আরও বলেন, "৭০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে আমরা একমাত্র সংযোগ ছিলাম—আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল উদ্ধারকারীদের সাথে যোগাযোগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, যাতে কেউ বিপদে না পড়ে।"
অবশ্য প্রতিবার উভমুখী যোগাযোগ স্থাপনের পর তারা হ্যান্ডহেল্ড ওয়াকি-টকিটি বন্ধ করে দিতেন যাতে ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে না যায়।
ডিসি অফিসে একটি ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম প্রতিদিন বন্যা পরিস্থিতি তদারকি করছিলেন। আর শুরুর প্রথম চারদিন অপেশাদার রেডিও অপারেটররা সংকট মোকাবিলায় দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় ছিলেন।
ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীর মতো তীব্র বন্যাকবলিত এলাকা জুড়ে এই অপেশাদার রেডিও নেটওয়ার্কের অব্যাহত প্রচেষ্টা ও দৃঢ় সংকল্প শেষ পর্যন্ত সফল হয়। মানবিকতার এই গল্পে তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, সংকট যতই বড় হোক না কেন, মানুষের ইচ্ছাশক্তি তার চেয়েও বড়।
সম্মিলিত প্রচেষ্টা
গুটি কয়েকজনের নয় বরং এই উদ্যোগটি ছিল হ্যাম রেডিওর প্রতি ভালোবাসায় সংযুক্ত বিভিন্ন মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও নেটওয়ার্কের মধ্যে স্কাউট সদস্য, রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ আরও অনেকেই অন্তর্ভুক্ত। এই অপারেটরদের বেশিরভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়েছেন।
অ্যামেচার রেডিও সার্ভিস সার্টিফিকেটধারী বাংলাদেশ স্কাউটসের একদল সদস্য একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে এনিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু করেন। ফাহাদের নেতৃত্বে সানি ও আসিফকে সঙ্গে নিয়ে তারা দ্রুত একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন।
সানি বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিই ফেনী হবে আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। কে কোথায় যাবে, কী সরঞ্জাম রয়েছে এবং আমাদের কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা নিয়েও আলোচনা করি আমরা।
যোগাযোগের সেতুবন্ধন
বন্যায় ফেনীর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা দ্রুত বিভিন্ন উদ্ধারকারী দলের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ফেনীতে কাজ করা তাদের সহপাঠীদের খোঁজ না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ধারকারী দলের সমন্বয়কারী ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র আরিফ এবং অ্যামেচার রেডিও নেটওয়ার্কের সদস্য একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রাক্তন ছাত্র শাকিব খান— ফেনীতে যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়ে অবহিত করার জন্য ১৪ জন উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের সঙ্গে একটি জরুরি সভার ডাক দেন।
আরিফ বলেন, "যখন জানতে পারলাম যে কিছুটা হলেও যোগাযোগ স্থাপন করা গেছে, তখন আমাদের উদ্বেগ অনেকটাই কমে গিয়েছিল।"
ঢাকায় অবস্থানরত আরিফ ও শাকিব, ফেনীতে থাকা সানি ও আসিফের সঙ্গে একযোগে কাজ করছিলেন। শাকিব বলেন, "আমাদের মূল দায়িত্ব ছিল ফেনী ও ঢাকার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা খোলা রাখা। আমরা উদ্ধার ও ত্রাণের অনুরোধ সংগ্রহ করতাম এবং সেগুলো ফেনী ডিসি অফিসের কন্ট্রোল রুমে পাঠাতাম।"
এই নেটওয়ার্কটি শুধু ফেনীর ভেতরে যোগাযোগ সুবিধা দেয়নি, বরং ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে মাঠে থাকা সহকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ আপডেটও সরবরাহ করেছে। আহমদ বলেন, "সে সময়ে এটিই ছিল একমাত্র নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ চ্যানেল। আমরা উদ্ধার কার্যক্রমের তথ্য সমন্বয় করে সেই বার্তা সংশ্লিষ্টদের নিকট পৌঁছে দিতাম"।
"প্রয়োজনে আবারও করব"
এই পুরো সংকটকালীন সময়ে, অ্যামেচার রেডিও নেটওয়ার্কই ছিল পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র। এটি ঢাকা ও ফেনীর দলগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করতো, বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত উদ্ধার অনুরোধ কন্ট্রোল রুমে পৌঁছে দিত এবং প্রয়োজনীয় বার্তা সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক দলগুলোর কাছে প্রেরণ করতো।
এক স্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, "এই নেটওয়ার্ক না থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নিত।"
ফেনীর এই যোগাযোগহীন অবস্থায়, এই উদ্যোগ কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের অধীনে সংগঠিত হয়নি; বরং এটি ছিল সবার ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলাফল।
আহমদ বলেন, "আমরা কোনো সংগঠন বা ব্যানারের অধীনে ছিলাম না। এখানে কাজ করা সবাই বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়েছি। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব ছিল আমরা করেছি"।
ফেনীর অনেক এলাকাতেই এখন যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সেই সংকটময় দিনগুলোতে, এই নামহীন অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টাই বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পার্থক্য এনে দিয়েছে।
বর্তমানে নোয়াখালীতে বন্যার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায়, অ্যামেচার রেডিও কমিউনিটির চারজন সদস্য সেখানে কাজ করছেন। সানি বলেন, "পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যেটা করা দরকার ছিল সেটা আমরা করেছি, যদি প্রয়োজন হয় আবারও করব।"
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন