প্রচলিত নিয়মে ঘরে নয়, চট্টগ্রামে ডিসি হিল-সিআরবি পার্কেই হয় পাত্র-পাত্রী দেখা
সূর্য তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে কিছুটা। কিন্তু তাতে রোদের তেজ যে কমেছে, সেটা বলা মুশকিল। বলতে গেলে ঝকঝকে সোনালী রোদের বিকেলবেলা ছিল সেদিন। নিজেকে চাঙা করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলাম।
বাড়ি থেকে দূরত্ব কম বলে ডিসি হিল যাওয়ার মনস্থির করলাম। নন্দনকানন এলাকার যে অনতিউচ্চ পাহাড়টিতে ডিসির বাংলো অবস্থিত, সেটিই ডিসি হিল পার্ক নামে পরিচিত। ভাবনা এই, একে খরচ তো কমবে, সঙ্গে সৌন্দর্যও উপভোগ করা যাবে। রিকশাযোগে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।
পার্কের ভেতরে ঢুকে একপাশে পাহাড় কেটে ইট দিয়ে বানানো সিড়িতে বসে আছি। খোলা আকাশ, তার ওপর মৃদু ঠান্ডা বাতাস। এমন পরিবেশে একান্তে অলস বিকেল কাটানোর অনুভূতি ব্যক্ত করবার মতো নয়। পাশেই আছে ফুচকা-চটপটির একটি ছোট্ট টং। সেখান থেকে চটপটি খেতে খেতে তৃপ্তির ঢেকুর গিলছি, ঠিক তখনই চোখ পড়ল একদল মানুষের ওপর।
খুব পরিপাটি সাজে ৫–৬ জন প্রবেশ করলেন ডিসি হিলের ভেতরে। তিনজন নারী এবং দুইজন পুরুষ। সঙ্গে এক ছোট্ট শিশু। কিছুক্ষণ পার্কের এদিক ওদিক তাকালেন। তারপর স্থান বাছাই করে বসে পড়লেন ছায়াযুক্ত এক কোণায়। বিশ্রাম নিতে নিতে নিজেদের মধ্যে আলাপ চালিয়ে গেলেন মিনিট দশেক ধরে।
তাদের মধ্যে একজন ২০–২৫ বছর বয়সি তরুণী। পরনে তার জমকালো থ্রিপিস। সাজসজ্জাও অন্যদের চেয়ে আলাদা। সবার মধ্যে তাকে একটু বেশি চিন্তিত মনে হলো। বারবার মুছে চলেছেন কপালের ঘাম। আবার সঙ্গে থাকা অন্যরাও কী যেন বলে যাচ্ছেন তার দিকে তাকিয়ে। মেয়েটিও লক্ষ্মীটির মতো অতি মনোযোগের সঙ্গে মাথা নাড়াতে নাড়াতে শুনছেন সবার কথা।
এভাবে অতিক্রান্ত হলো আরও পনের–বিশ মিনিট। তবে এসবের মাঝে মিনিট দুয়েক পর পর এদিক-ওদিক কাদের যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তারা। খানিক পরেই আবার চোখ পড়লো ৬–৭ জন মানুষের দিকে। সবারই বাহারি সাজগোজ, পরিপাটি, জমকালো পোশাক পরনে। বুঝতে বাকি রইল না কী ঘটতে চলেছে।
আগের গ্রুপ হলেন পাত্রীপক্ষ, আর এখন যারা এসেছেন, তারা হলেন পাত্রপক্ষ। সাক্ষাৎ হলো দুই দলের। পাত্র-পাত্রী উভয়ই পা ধরে সালাম করলেন সঙ্গে থাকা মুরুব্বিদের। সালাম বিনিময় পর্ব শেষ করে দাঁড়িয়ে আলোচনা চলল প্রায় অনেকক্ষণ।
তারপর সবাই মিলে গোল হয়ে বসে পড়লেন। এবার সবার মুখে দেখা গেলো হাসির রেখা। হাসি-ঠাট্টায় গরম গরম চটপটি-ফুসকার সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে তুললেন তারা।
ব্যস! তাদের হাবভাব দেখেই বোঝা গেল, পাত্রপক্ষের কন্যা পছন্দ হয়েছে। এবার ঠিক হবে দিনক্ষণ। মূহুর্তেই এভাবে সম্ভাব্য একটি বিয়ের সাক্ষী হওয়া কম আনন্দের বিষয় নয়! পাত্র-পাত্রীর দুদলের মধ্যে চলছে খুশির আবহ।
ইচ্ছে হলো তাদের আড্ডায় সঙ্গী হওয়ার। কথা হলো খোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি পাত্রের মামা। তার সঙ্গে আছেন পাত্রের বাবা, মা এবং বড় এক ভাই। খোরশেদ ছোটখাটো ব্যবসা করেন। থাকেন চন্দনপুরার আশেপাশে। ভাগ্নের জন্য পাত্রী দেখছেন অনেক মাস ধরে। মন মতো না হওয়ায় কথা এগোয়নি আর।
এ নিয়ে তার চতুর্থ পাত্রী দেখা। জানালেন, এভাবে বাইরে এসে পাত্রী দেখা এটিই প্রথম।
কম খরচে পাত্রী দেখা
কেন এমন উদ্যোগ নিলেন? খোরশেদ বলেন, 'ইদানীং তো রেস্টুরেন্টেই বেশি বর-কনে দেখা হয়। আমরাও দেখেছি কয়েকবার। তাও আবার সস্তা রেস্টুরেন্টে না। দেখা সাক্ষাৎ বা আলাপকালে কমপক্ষে ১৫–২০ জন মানুষ তো থাকেই। ভাবেন তো, খাবারের পেছনে কম করে দেড় হাজার করে খরচ হলে কত আসে? শুধু পাত্রী দেখতে এত টাকা খরচার দরকার আছে?'
যদিও পার্কে এসে দেখা করার প্রস্তাব আসে পাত্রী পক্ষ থেকে, খোরশেদের তা মনে ধরে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যান। তার ভাগ্নে মো. সাইমন, কুয়েত প্রবাসী পাত্র। বিয়ে করবার উদ্দেশ্যেই দেশে আসা। কাজ সেরে আবার ভিনদেশে পাড়ি জমাবেন।
তিনিও খরচের বিষয়টিকে জোর দিয়ে বলেন, 'শুধু দেখা-সাক্ষাতেই যদি ৪০–৫০ হাজার খরচ হয়ে যায়, অন্য প্রোগ্রামগুলোর অবস্থা বুঝতে পারছেন? একটু এদিক থেকে কমিয়ে নিলে তো খারাপ হয় না। দুই পক্ষের জন্যই ভালো।'
ইচ্ছে হলো পাত্রী পক্ষের ভাষ্য শোনার। খরচপাতির প্রকৃত ভুক্তভোগী তো তারা। কথা বলছিলাম পাত্রীর মা রোকসানা বেগমের সঙ্গে। সৌম্য চেহারার এ ভদ্রমহিলার ভাবনা-চিন্তা অন্যরকম।
তিনি বলেন, 'দেখুন, পাত্রপক্ষ পাত্রী দেখতে গেলে সবচেয়ে কষ্ট কাদের? নিশ্চয় ঘরের যত মেয়ে আছে তাদের, তা-ই না? আসলে এভাবে বাইরে এসে দেখা করে যাওয়াতে ঘরের মহিলাদের জন্য সুবিধা বেশি। সকাল থেকে বিকেল অব্দি রান্নাবান্নার খাটনি নেই। এটা কম, ওটা কম সে চিন্তাও নেই।'
দুপক্ষের বেশিরভাগ লোকই খরচ কমানোর বিষয়টিকে সামনে আনেন বারবার। নিখরচায় পাত্রী দেখা যায় বলে অনেকেই ডিসি হিল এবং সিআরবি এলাকায় ভিড় করেন। তার ওপর এসব পার্কে প্রবেশের জন্য আলাদা করে টিকিট কাটার ঝামেলাও নেই। সবদিক দিয়ে সাশ্রয়ী পন্থা বলে হয়তো দিন দিন এভাবে পাত্রী দেখা বেড়ে চলেছে।
দুপুরের পর পূর্বনির্ধারিত সময়ে হাজির হন পাত্র-পাত্রীর পরিবার। দেখা-সাক্ষাৎ করে পছন্দ হলে তো হলো, না হলে আলাদা কোনো চাপও নেই।
'আগে মেয়ে দেখতে এলে একবারে পছন্দ হতো তা নয়। এমনও দেখা গেছে, ছয়-সাতবারের অধিক সময়ে পাত্রী দেখতে আসতো। এতে করে ঠিক ততবারই আলাদা করে খরচ করতে হতো পাত্রী পক্ষের। এটা অনেক বড় একটা প্রেশার,' বলেন রোকসানা বেগম।
'সপ্তাহে ৪–৫ দিন এমন দেখা যায়'
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ৩০ টাকার চটপটি এবং ৪০ টাকার ফুসকায় পাত্র-পাত্রী দেখা হবে, তা কি চাঁটগাইয়াদের কেউ ভেবেছে আগে?
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, অলস বিকেলে ঘুরে বেড়ানোর এসব এলাকাই এখন পাত্র-পাত্রীর দেখা-সাক্ষাতের অন্যতম পছন্দের স্থান। ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এ পদ্ধতি। ব্যাপারটা এখন অনেকের কাছে এমন, পাত্রী দেখে পছন্দ হলে তো হলো, না হলে একটু ভ্রমণও করা হলো। অনেকটা রথ দেখা ও কলা বেচার মতো।
প্রায় সময় চট্টগ্রাম নগরীর এই ডিসি হিল এলাকায় পাত্রী বা পাত্রপক্ষ দেখা করে একে অপরের সঙ্গে। সঙ্গে থাকেন বাড়ির মুরুব্বিরা। বড়দের মধ্যে কথাবার্তা শেষ হলে পাত্র-পাত্রীকে একান্তে কথা বলার সুযোগও করে দেন তারা।
অবশ্য এমন দৃশ্যপট নিত্য-নৈমত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্কের চটপটি বিক্রেতা মুনিরের ভাষ্যও তাই। তিনি জানান, 'যদি প্রতিদিন বিকেলের দিকে আসেন, তবে কাউরে না কাউরে দেখতে পাবেন। সপ্তাহে অন্তত ৪–৫ দিন এমন দেখা যায়।'
স্বচক্ষে পাত্রী দেখা বুদ্ধিমানের কাজ
এখন একটা প্রশ্ন রইল। সাধারণত বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী দেখা হয় কীভাবে? জানামতে, হয় পাত্রপক্ষ আসে পাত্রী দেখতে, নয়তো পাত্রী পক্ষ যায় পাত্রের বাড়িতে — এমনটাই তো হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে!
বলতে গেলে, প্রায় সব জেলায় এমনই নিয়ম। কিন্তু এ রীতির বাইরে গিয়ে পার্কে-পার্কে ঘুরে বেড়িয়ে পাত্র-পাত্রী দেখা, আলাপ করা, দিনক্ষণ ঠিক করা, তা কি আদৌ স্বপ্নেও ভেবেছে কেউ? উত্তর হয়তো 'না' হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
কথায় আছে, পাত্রী সৌন্দর্যে যতই প্রসিদ্ধ হোক, তবুও বিবাহের পূর্বে তাকে এক ঝলক দেখে নেওয়া উত্তম। পাত্রীকে সচক্ষে একবার দেখে নেওয়া তাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মানেন গুরুজনেরা। একই কথা প্রযোজ্য পাত্রের বেলায়ও।
দীর্ঘকাল ধরে পাত্র-পাত্রী দেখার এমন রীতিই প্রচলিত। গ্রাম কিংবা শহর—সবখানে এক নিয়ম। আর এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের কথা আলাদা করে উল্লেখ না করলেই নয়! এ জেলায় বিয়ের ক্ষেত্রে আলাদা করে নিয়মনীতিরও যেন শেষই নেই।
এত রীতি মানতে গিয়ে জীবন যেন যায়-যায় অবস্থা।
বিয়েতে খরচা কত
ধনী থেকে গরিব — এখানকার সবার একটাই কথা, সব রীতি মেনে বিয়ে ধুমধাম করে হওয়া চাই। সমাজের দশ লোকের সামনে যাতে 'গলা বাড়িয়ে বলা যায়' কার বিয়েতে কত খরচা হলো!
চাটগাঁইয়াদের কাছে বিয়েতে করা খরচের পরিমাণও রীতিমতো একটা গর্ব করার বিষয়! যার বিয়েতে যত ব্যয়, সমাজের মানুষের কাছে তার চর্চাও তত বেশি। কিন্তু এই ধুমধাম বিয়ের মাঝে নিঃস্ব হয়ে যাবার উপক্রম হয় অনেকের।
সচ্ছল বা স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় টাকা! বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরা আছেন এ দলে। যৌতুক-প্রথার গ্যাঁড়াকলে পড়ে কতো পরিবারকে যে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে সব বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছেন এমন উদাহরণও ভূরিভূরি। তবুও লোকলজ্জার ভয়ে সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও টাকা ব্যয় করেন কেউ কেউ।
বিয়েশাদির খরচের ব্যাপারে চাঁটগাইয়াদের অবস্থা হয় অথৈ জলে পড়ে যাওয়া পিঁপড়ার মতো। ধাক্কা সামলে উঠতে হাঁসফাঁস করতে হয় অনেককে।
ছেলে-মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতেই অল্প বেতনের চাকরিজীবী বাবার বেহাল অবস্থা। যেন গলা দিয়ে খাবারও নামতে চায় না। তাছাড়া রীতিনীতির একটু হেরফের হলে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার চিন্তা তো আছেই।
এরই মাঝে উচ্চমূল্যের এই যুগে পাত্রী দেখা বা পাত্রের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টিও হয়ে দাঁড়িয়েছে অতি ব্যয়বহুল। পাত্রী দেখার কথা আসতেই তাই পকেটে হাত চলে যায় বারবার।
বদলেছে চিন্তা-ভাবনা
স্বস্তির বিষয় হলো, কঠিন এই অবস্থান থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটছে মানুষের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক হওয়ার সঙ্গে বদলেছে মানুষের চিন্তা ভাবনাও। তাই প্রচলিত প্রথা ভেঙে খরচা কমানোর বিকল্প ভাবছে কেউ কেউ।
সে চিন্তা থেকে নতুন পন্থাও বের করে এনেছেন সাধারণ মানুষ। সেকেলের নিয়মকানুন আজকাল শক্তভাবে কেউ কেউ পালন করলেও অনেকেই খুঁজছেন সেসব থেকে বের হয়ে আসার উপায়। ইতোমধ্যে তা হচ্ছেও।
এইতো, আগে যেখানে হাতভর্তি জিনিস নিয়ে পাত্রী দেখতে যাওয়া বা পাত্রপক্ষ আসবে বলে মহা আয়োজনে রাজকীয় ভোজনের ব্যবস্থা করা হতো, তা আর হচ্ছে না। ব্যতিক্রম আছে, তবে তা সংখ্যায় অতি নগণ্য।
বন্দি এ শেকল থেকে মুক্তির নতুন নতুন পথ বের করে চলেছেন মানুষ। বিয়ে নিয়ে অসম সব রীতিনীতির চট্টগ্রামে এসেছে অভূতপূর্ব এই ভিন্নতা। ধরাবাঁধা রীতি থেকে বর্তমানে মুক্ত হতে পারার যে আনন্দ, তা কিছুটা উপলব্ধি করা যায় রোকসানা বেগম বা খোরশেদ আলমদের সঙ্গে কথা বলে।
'পারিবারিক বন্ধনে এক পরিবার আরেক পরিবার নিয়ে ভাববে — এটাই তো নিয়ম হওয়ার ছিল। আমরাই অযথা এসব রীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে বাড়িয়েছি। সবার উচিত লজ্জা না পেয়ে বিয়ের ক্ষেত্রে খরচ কমানোর যত পথ আছে সেগুলো বেছে নেওয়া,' বলেন খোরশেদ।