বেদখল, দূষণ ও নগরায়নে বেহাল ঢাকার খাল
"আপনি জানেন কি, এই রাস্তাটি, যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেটা দুই দশক আগে একটা খাল ছিল?" পান্থপথ রোডের দিকে ইশারা করে এমনটাই বলছিলেন আবদুস সাত্তার নামের সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ।
বয়স্ক এই লোকটি বলেন, "আমি এখানে মাছ ধরতাম ও গোসল করতাম। হাতিরঝিলের পানি এই পান্থপথ খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ধানমন্ডি লেক হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে যেত।"
হতাশা প্রকাশ করে আবদুস সাত্তার বলেন, "এই রাস্তাটি করার জন্য খালের ওপরে একটি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছিল। খালটি যদি এখনও প্রবাহিত থাকত তাহলে আমরা তাতে নৌকা চালাতে পারতাম। আমি ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশে ঘুরেছি। কিন্তু কখনো দেখিনি যে, রাস্তা-ঘাট নির্মাণের জন্য প্রকৃতিকে এভাবে ধ্বংস করা হয়। এমনটা শুধু বাংলাদেশেই হয়।"
তিনি আরও বলেন, "বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক বছর পরপর খালের মালিকানা পরিবর্তন হয়। কিন্তু তা আর ফিরে আসে না। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকায় একটি খাল খুঁজে পেতে আমাদের দূরবীনের প্রয়োজন হবে।"
মিরপুরের পশ্চিম কাফরুলের আনন্দবাজার রোডের বাসিন্দা সানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, "কল্যাণপুর খালটি কাজিরপাড়া হয়ে মিরপুর ২ নম্বরে প্রবাহিত হতো। এখন এটি একটি ড্রেন। ঢাকা ওয়াসা কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে এটি ছোট করে দিয়েছে। শীতে এতে আবর্জনা জমে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।"
সানোয়ার হোসেন তার ফোনে পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তার ছবি দেখান। তিনি বলেন, "এমনকি ২-৩ ঘণ্টার বৃষ্টিতেও কোমর সমান পানির জমে যায়। খালের আবর্জনা আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সিটি কর্পোরেশন এটি পরিষ্কার করে না। ফলে নির্মিত ড্রেনটি থেকে পানি উপচে সব তলিয়ে যায়।"
ঢাকার খালগুলো নিয়ে সাত্তার ও সানোয়ারের মতোই উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন ঢাকার বেশিরভাগ বাসিন্দা। এক্ষেত্রে খালগুলো বাঁচানো সম্ভব কি-না তারা সেই প্রশ্ন তোলেন।
বছরের পর বছর ধরে ঢাকার খালের মালিকানা জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মধ্যে বারবার স্থানান্তরিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ৫০টি খাল রয়েছে। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন দাবি, ঢাকায় খাল রয়েছে ৪৬টি।
বর্তমানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ২৬টি খালের দায়িত্বে রয়েছে৷ অন্যগুলো গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে রয়েছে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকায় ১৯৪০ থেকে ২০২৩ সকলের মধ্যে গত ৮৩ বছরে ১২০ কিলোমিটার (৩০৭ হেক্টর) খাল হারিয়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অবহেলার কারণে ৯৫টি খাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে মাত্র ১১টি খাল ও ৪টি লেক নতুন করে খনন করা হয়েছে।
আরডিআরসি ১৮৮৮ থেকে ১৯৪০ সালের ক্যাডাস্ট্রাল জরিপগুলিকে ২০২২ সালের স্যাটেলাইট ইমেজের সাথে তুলনা করেছে। এক্ষেত্রে ঢাকার ৭৭টি প্রধান খাল ও লেক চিহ্নিত করে।
এই জলাশয়গুলি মোট ৫৬৫ হেক্টর জায়গা জুড়ে ছিল। যার প্রায় ৫৫ ভাগ এখন হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া ৩০৭ হেক্টরের মধ্যে ৩৩.৭৫ শতাংশে অবকাঠামো, ১৮.৯২ শতাংশে কৃষিজমি ও ১৬.৯৪ শতাংশে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।
বেগুনবাড়ি, রামচন্দ্রপুর, ধোলাই ও রামপুরা খালের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৩ কিলোমিটারের বেশি বিলীন হয়ে গেছে। একইভাবে বুড়িগঙ্গার পুরাতন চ্যানেল ২.৪৬ কিলোমিটার হারিয়ে গেছে।
আরডিআরসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজাজ মনে করেন, নদী, খাল ও অন্যান্য জলাশয়ের অবৈধ দখল ও দূষণ ঢাকার পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি বলেন, "দ্রুত নগরায়ণের কারণে ঢাকার জলাশয় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পানি ও বায়ু দূষণ, জলাবদ্ধতা, ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাস ও অন্যান্য সংকট শহরটিকে প্রভাবিত করেছে।"
মোহাম্মদ আজাজ দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ একইসাথে খালের পানি প্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য সিটি কর্পোরেশনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি অবশিষ্ট নদী-নালা, লেক ও খাল সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যোগ ও সামগ্রিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
নগরায়ণে হারিয়ে গেছে ১৫টি খাল
নগরায়ণে ঢাকার অন্তত ১৫টি খাল এখন বক্স কালভার্ট ও রাস্তায় রূপান্তরিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি নির্দেশনাতেই এসব পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু খালগুলো পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
এরকম একটি জলপথ ছিল পান্থপথ খাল। যেটি ধানমন্ডি লেককে হাতিরঝিল লেকের সাথে সংযুক্ত করতো। এখন পান্থপথ রোডের নীচে খালটি চাপা পড়ে গেছে। এটি দিয়ে একসময় বৃষ্টির পানি বেগুনবাড়ি খালে প্রবাহিত হতো।
আরেকটি জলাশয় ছিল পরীবাগ খাল। যেটি শাহবাগ থেকে মগবাজার হয়ে প্রবাহিত হতো। এখন এটি সোনারগাঁও সড়কের কারণে হারিয়ে গেছে।
একসময়ের প্রধান জলাধার হিসেবে বিবেচিত আরামবাগ ও গোপীবাগ খালও ভরাট হয়ে গেছে। একইভাবে রাজাবাজার ও নন্দীপাড়া-ত্রিমোহিনী খাল বক্স কালভার্টে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বিশেষ করে একটি দীর্ঘ খাল যা মৎস্য ভবন এলাকা থেকে প্রবাহিত হয়ে বেশ বিখ্যাত এলাকার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতো৷ এটিও কালের পরিক্রমায় সড়কে রূপান্তরিত হয়েছে। কাজলার পাড় খাল একসময় স্থানীয়দের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এক জলপথ ছিল। এখন এটি কাজলা-কুতুবখালী সড়কে পরিণত হয়েছে।
ধোলাইখাল ও দয়াগঞ্জ খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় ধোলাইখাল-দয়াগঞ্জ-মিরহাজিরবাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি কাঁঠালবাগান ও ধলপুর খালও একই পরিণতি পেয়েছে। এই জায়গাগুলি এখন জমি ও অবকাঠামো তৈরি করে দখল করা হয়েছে।
রায়েরবাজার, সেগুনবাগিচা, গোবিন্দপুর, কাঁঠালবাগান ও নারিন্দা খালসহ আরও অনেক খাল একই পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা খালগুলোকে সড়কে রূপান্তরের জন্য সরকারি নির্দেশনার কথা জানিয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার এ কে এম শহীদ উদ্দিন বলেন, "১৯৯০-এর দশকে আমরা সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খালের ওপরে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করেছিলাম। তখন রাস্তার প্রয়োজন ছিল।"
খালগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি
রূপনগর খাল একসময় ২.৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৮ মিটারের বেশি চওড়া ছিল। এখন এটি একটি সরু ড্রেন। অবকাঠামো ও বর্জ্যের স্তূপে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে কিছু এলাকায় খালটির প্রস্থ ২ থেকে ৩ মিটারেরও কম হয়ে গেছে।
আব্দুল ওয়াসেত নামে একজন বাসিন্দা খালটির এমন বাজে পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি জানান যে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত এটি পরিষ্কার করে না। যাত্রাবাড়ীতে বাইশটেকী খালের অর্ধেক সড়কে পরিণত হয়েছে। বাকি অংশ সরু ও দূষিত ড্রেনে পরিণত হয়েছে।
কল্যাণপুর খাল মূলত ছয়টি ছোট খালের সমন্বয়ে গঠিত; যার অধিকাংশই এখন দখল হয়ে গেছে। যদিও সরকারি হিসেব অনুযায়ী, খালটি ৮ থেকে ৪০ মিটার পর্যন্ত প্রস্থের থাকার কথা।
এক সময়ের তিন কিলোমিটার দীর্ঘ হাজারীবাগ খাল এখন বর্জ্যের স্তূপ। তীরে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট স্থাপনা৷ হাজারীবাগ স্লুইস গেটের কাছেও নেই পানির প্রবাহ।
স্থানীয় বাসিন্দা আসমা বেগম বর্জ্যের তীব্র সমস্যা ও যথাযথ পরিষ্কার কার্যক্রমের অভাবের কথা উল্লেখ করেন। একইভাবে ৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২০ থেকে ৩০ মিটার চওড়া জিরানী খালটি দখলের কারণে ৩ থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত সরু হয়ে গেছে।
একসময়ের ৩.১ কিলোমিটার দীর্ঘ রামচন্দ্রপুর খালটি বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ভরাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে মিরপুরের দ্বিগুণ খাল প্রায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে।
প্রায় চার বছর ধরে ২৬টি খাল পরিচালনা করেও দুই সিটি করপোরেশনের কোনোটিই নিয়মিত পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। যদিও ঢাকা উত্তর গত চার বছরে ৩৩০ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ ২২০ কোটি টাকা খরচ করলেও অগ্রগতি বেশ ধীরগতিতে হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণে বর্তমানে চারটি খাল পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ৯০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প রয়েছে। যার মধ্যে বাঁধ নির্মাণও রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। তবে প্রকল্পটি এখনও বাস্তবায়িতই হয়নি।
সিটি কর্পোরেশনগুলো ঢাকার খালগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে দখল ও নিজেদের সীমিত সম্পদকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এক্ষেত্রে তারা স্বীকার করে যে, খালগুলো পুনরুদ্ধারে সময় লাগবে। আর নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদেরা জোর দেন যে, বিদ্যমান নীতিগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন সংকট মোকাবেলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।