বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ ফের চালুর পথে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে
১৯৭০ সালের আগে দেশে ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এর প্রতিটিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চালু ছিল।
এরপর থেকে দেশে প্রায় পঞ্চাশটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও বেশিরভাগেই এখনও ছাত্র সংসদের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো নেই। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
স্বাধীনতার পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন সময়ের সাথে সাথে বেশ অনিয়মিত হয়ে ওঠে। এমনকি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ১৯৯০-এর দশকে এই নির্বাচনগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তী সরকারগুলোও ছাত্র সংসদ নির্বাচন বেগবান করতে অনিচ্ছুক ছিল। যার ফলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম চালুর প্রক্রিয়া কেবল দীর্ঘায়িত হয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের খসড়া তৈরির সময়ও ছাত্র সংসদের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জাতীয় বা অন্যান্য নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিষয়টি সামনে এনেছেন। এতে করে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়। অর্থাৎ যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ও সাংবিধানিক বিধান নেই সেখানে কীভাবে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করা যাবে?
যদিও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সমস্যাটি সমাধানে কাজ শুরু করেছে। তবে বিস্তারিত প্রক্রিয়ার বিষয়ে এখনও ঐকমত্য পৌঁছানো যায়নি। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনি বিধানের অভাব রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠায় আইনি জটিলতাগুলো তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী মনে করেন, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "তবে ক্ষমতাসীন দলগুলি প্রায়ই ছাত্র সংসদকে তাদের কর্তৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিবেচনা করে। যার ফলে এই ধরনের নির্বাচনের প্রতি ক্রমাগত অনিচ্ছা দেখা যায়।"
অধ্যাপক আজাদ মনে করেন, ছাত্র রাজনীতি রাজনৈতিক দলভিত্তিক না হয়ে আদর্শভিত্তিক হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, "ছাত্র রাজনীতি একটি বৈশ্বিক প্রবণতা। তবে এটির বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন দেশভেদে পরিবর্তিত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি রাজনৈতিক দলগুলির পেশী শক্তি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া দরকার।"
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডক্টর নকীব মুহাম্মদ নসরুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ চালু করা বর্তমানে চ্যালেঞ্জিং।"
তিনি মনে করেন, ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ, আদালতের আদেশ বা সংসদ কর্তৃক পাস করা নতুন আইনের প্রয়োজন হবে।
এদিকে বিভিন্ন সংগঠনের ছাত্রনেতারা ক্যাম্পাস পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।
ছাত্র ইউনিয়নের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, "অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় হয়, ক্ষমতায় থাকা ছাত্র সংগঠনগুলো সব সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এক্ষেত্রে তারা কখনোই সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতিনিধিত্ব করেনি।"
তিনি আরও বলেন, "এজন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করার জন্য নির্বাচিত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ছাত্র সংসদ গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। এ লক্ষ্যে প্রথমে একটি আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে।"
২০১৯ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের রেগুলেশনে ছাত্র সংসদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রশাসন আইনের একটি খসড়া তৈরি করে এবং স্টেকহোল্ডারদের মতামতের জন্য ৪৫ দিনের সময় নির্ধারণ করে। তবে করোনা মহামারি শুরু হলে উদ্যোগটি স্থগিত হয়ে যায়। এরপর আর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে আলোচনায় বিষয়টি আবারো উঠে এসেছে।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় উপ-দপ্তর সম্পাদক তৌসিব মাহমুদ সোহান টিবিএসকে বলেন, "ছাত্র সংসদ গঠনের উদ্যোগ আগে থেকে থাকলেও তা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তবে আমরা নতুন প্রশাসনের সাথে আলোচনা করেছি। তারা আগামী বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে একটি ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। তবে এক্ষেত্রে দেখতে হবে যে, যাতে কোনো আইনি বাধা না থাকে।"
তিনি আরও বলেন, "এক্ষেত্রে আইনি জটিলতা দেখা দিলে প্রশাসন আমাদের জানিয়েছে যে, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ছাত্র সংসদ গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে।"
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোঃ রেজাউল করিম বলেন, "আমরা একটি আইনি কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়ায় আছি। একটি কমিটি এটি নিয়ে কাজ করছে। কাঠামোটির খসড়া হয়ে গেলে আমরা আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে সে অনুযায়ী এগিয়ে যাব।"
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট, চুয়েট, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে ।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, "আইনে ছাত্র সংসদের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম এটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।" আইন সংশোধন না করে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করেন প্রবীণ এই আইনজীবী।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, "ছাত্র সংসদ গঠনের ক্ষেত্রে কোনো আইনি জটিলতা দেখা দিলে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করে সহায়তা দেবে। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হোক।"
প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬২) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬১) প্রতিষ্ঠার পরপরই ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বাইরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৯১) একটি ছাত্র সংসদ রয়েছে।
সাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে নাম পরিবর্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) করা হয়। ১৯২৪-২৫ সালে ডাকসুতে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময়ের মধ্যে মাত্র সাতবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। যার সর্বশেষটি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এদিকে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে মোট ৩০ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে সেখানে ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) গঠিত হয়েছিল। সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট নয়বার ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্র সংসদ গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। আর সর্বশেষটি ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত চবিতে মোট ছয়টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। আর সেখানে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৫৬-৫৭ সালে। ১৯৬২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট ১৪টি নির্বাচন পরিচালিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বশেষটি ১৯৮৯-৯০ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ১৯৬২ সালেই ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে ২০০১ সালে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট ২১টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ গঠন করে। এতে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯৮ সালে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর এতে মোট পাঁচটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। যার মধ্যে সর্বশেষটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে।