রাজধানীর কোথায় মেলে ‘ফ্রি খাবার’
'জাদুর শহর' ঢাকা। বড়বড় অট্টালিকা আর দালানকোঠার ভিড়ে এ শহরে অগণিত মানুষকে পড়ে থাকতে হয় ফুটপাতে। শহরের এক প্রান্তে যখন চলে জমজমাট খাওয়াদাওয়া আর ব্যুফের আয়োজন, তখন অন্য প্রান্তে কিছু মানুষ তিনবেলা আহার জোগাড়ের সংগ্রামে লিপ্ত। শহরের নিচুতলার হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত লড়ে যান টিকে থাকার যুদ্ধ।
দিনমজুর থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ, সবার সংগ্রাম যেন একটাই — তিনবেলা পেটভরে খাবার খাওয়া। কিন্তু কোথায় মিলবে খাবার?
রাজধানীতে খুঁজলে সন্ধান পাওয়া যায় এমন কিছু মানুষ, সংগঠন আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের, যেগুলো প্রান্তিক এ মানুষগুলোর টিকে থাকার যুদ্ধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় প্রতিনিয়ত। তারা পালন করে মানুষের ক্ষুধা নিবারণের মহান ব্রত।
প্রতিদিন শতশত মানুষ ভালো কিছু খাবারের আশায় ভিড় করেন এমনই বেশ কিছু জায়গায়। ঢাকা শহরে সেসব 'ফ্রি খাবারের' সুলুক-সন্ধান করা যাক।
কারওয়ান বাজার মোড়ের পাশে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট রোড দিয়ে গিয়েছেন কখনো? গেলে নিশ্চই চোখে পড়েছে একটি রঙিন দেওয়াল, যাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা — 'ভালো কাজের হোটেল'। এর কাছেই, সাতরাস্তার মোড়ে রয়েছে এমন আরও একটি।
এ দেওয়ালগুলো আসলে একটি হোটেল, যেখানে সপ্তাহে সাতদিন মানুষকে বিনামূল্যে খাবার খাওয়ায় 'ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ'। দিনে একটি অন্তত ভালো কাজ করলেই এখানে খাবার খেতে পারেন যে কেউ।
সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক ফারহান রহমান জানালেন, ২০১৯ এর ডিসেম্বর থেকে 'ভালো কাজের হোটেল' পরিচালনা করে আসছে তাদের এ সংগঠনটি। শুভাকাঙ্ক্ষী আর সদস্যদের মাসিক চাঁদা দিয়ে চলে সমস্ত কার্যক্রম।
বললেন, 'আমরা এখানে ভালো কাজের বিনিময়ে খাবার সরবরাহ করি। ঢাকা শহরে মোট ১০ জায়গায় এ আয়োজন হয়। দুপুরে মিরপুর, কালশী, সাতরাস্তা, কারওয়ান বাজার, ওয়ারী এবং বনানী কড়াইল বস্তিতে, আর রাতে বাসাবো, কমলাপুর, মোহম্মাদপুর, ধানমন্ডিতে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেও এ হোটেল পরিচালিত হয়।'
পেশায় চায়ের দোকানের কর্মচারী ভুলু মিয়া। দৈনিক আয় আড়াইশ টাকা। মাসে ৭৫০০ টাকা থেকে নিজের জন্য ৫০০ টাকা রেখে বাকিটা পাঠিয়ে দিতে হয় বাড়িতে।
তিনি জানালেন, ভালো কাজের হোটেলের জন্যই 'তার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে, নইলে মারা যেতেন' অনেক আগে। রাজধানীর সাতরাস্তা মোড়ে তিনি তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছিলেন খিচুড়ি আর ডিমভুনা। জানালেন, গত আটমাস যাবত প্রতিদিন দুপুরে এখানে খাবার খাচ্ছেন তিনি।
ভালো কাজের হোটেলের মত একই ভাবে মানুষকে খাবার খাওয়ায় 'দস্তরখানা' নামে একটি সংগঠন। নিউ ইস্কাটন রোডে ফ্লাইওভারের নিচে সপ্তাহে ৬ দিন চলে তাদের কার্যক্রম। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক মানুষ এখানে খাবার খেয়ে থাকেন।
দুপুর ১২ টার আগে থেকেই ফ্লাইওভারের ছায়ায় জড়ো হতে থাকেন সবাই। খাবার আসে ঠিক ১টায়। এখানে খেয়ে স্বস্তির দিন কাটে অনেক অসহায় মানুষের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী হাসান মাহমুদ অনিক (ছদ্মনাম) ভালোবাসেন 'পথের' মানুষের কাছাকাছি থাকতে। ঢাকা শহর ঘুরেফিরে ছিন্নমূল মানুষদের আপন করে নেওয়া তার নেশা। তিনি জানালেন, নানান জায়গায় বিনামূল্যে খাবার খেতে গিয়ে তিনি খাঁটি মানুষের দেখা পান।
বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়ে গিয়ে তিনি খাবার খেয়ে দেখেছেন। মাজার, মন্দির, গির্জা; ছিন্নমূল মানুষের মতই সর্বত্র তার যাতায়াত। মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার এ ধারণাটি তাকে মুগ্ধ করে।
এই যেমন হাইকোর্ট মাজার। শাহ খাজা শরফুদ্দীন চিশতি (র.)-এর দরবার শরিফ সকলের কাছে পরিচিত ঐ নামে। সেই প্রাচীন কালের মতই আজও অসহায়-দুস্থ মানুষের আশ্রয়স্থল এ মাজার। এখানেই সপ্তাহে সাতদিন, অন্তত দুই বেলা খাবার মেলে তাদের।
হাইকোর্ট মাজার তাই ছিন্নমূল মানুষের কাছে এক ভরসার নাম। অন্য কোথাও না পেলে এখানে কিছু না কিছু খাবার পাবেন, এমন ভাবনা নিয়ে মানুষ এখানে আসেন। অনেক উচ্চ আর মধ্যবিত্তও খাবার খান এখানে।
মাজারের খাদেম হাজী আমজাদ হোসেন জানালেন, আগে সকালেও খাবার দেওয়া হতো। অনুদান কমে যাওয়ায় শুধু দুপুর আর রাতের খাবারের আয়োজন করা হয়। একেকদিন একেক ধরনের খাবারের ব্যবস্থা থাকে।
বললেন, ভাত, খিচুড়ি, তেহারি, যে সময় যা তৈরি হয়, তা দিয়েই মানুষের খিদমত করেন তিনি। 'বছরে ৫টা বড় অনুষ্ঠান হয়। বার্ষিক ওরশ মোবারকে হাজার হাজার মানুষ খাওয়াদাওয়া করে। এখানে খাওয়ানোর পাশাপাশি আমরা মিরপুরে, এতিমখানায়, গোলাপ শাহ মাজারেও খাবার দেই।'
হাইকোর্ট মাজারের অদূরেই গোলাপ শাহ (র.)-এর মাজার। এখানে ভক্ত-খাদেমদের উদ্যোগেও বিভিন্ন সময়ে খাবারের আয়োজন করা হয়। এ মাজারের ভক্ত আরমান পাগল জানালেন, এখানে প্রতিরাতে ১০০ কলা ও ২০০ রুটি খাওয়ানো হয় এক ভক্তের উদ্যোগে। এছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে খাওয়ানো হয় খিচুড়ি।
ঢাকা শহরের একটি বড় অংশ ছিন্নমূল মানুষের বাস কমলাপুর রেলস্টেশন ঘিরে। এ স্টেশনে নানারকম কাজ-কর্মে তাদের জীবন কাটে। তবে তিনবেলা খাবারের চাহিদা পূরণ হয় না সবার। তাই এখানে কাজ করে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা এনজিও 'লিডো' এগুলোর মধ্যে অন্যতম।
রেলস্টেশন ঘিরে বেড়ে ওঠা পথশিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি তিনবেলা খাবারের সুযোগ করে দিয়েছে এ সংগঠনটি। 'লিডো'র মিডিয়া ও কমিউনিকেশন ম্যানেজার দীপ বিশ্বাস জানালেন, কমলাপুর ছাড়াও ঢাকার বেশকিছু জায়গায় তাদের কার্যক্রম 'স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই' পরিচালিত হয়।
লিডো ছাড়াও বেশ কয়েকটি সংগঠন ও ব্যক্তি নামে-বেনামে খাবার বিতরণ করেন এখানে। এর মধ্যে অন্যতম 'ভালো কাজের হোটেল'। রিকশাওয়ালা-কুলি থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের সব মানুষই এখানে খাবার খেয়ে থাকেন।
কথা হলো রিকশাচালক হাবিব মিয়ার সঙ্গে। জানালেন, রোজার দিনে প্রতিদিন ইফতার দেওয়া হয় এখানে। আর এমনিতে রাতের খাবার। রাতের খাবারটা এখানে সেরেই ঘরে ফেরেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত শিখ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উপাসনালয় গুরুদুয়ারায় প্রতি শুক্রবার সাধারণ মানুষদের জন্য খাবার পরিবেশন করা হয়। ধর্মীয় সংগীত পরিবেশনের পর উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করা হয়, যা খেতে আসেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ভজন সংগীত শোনার জন্য অনেকেই মাথায় একখণ্ড কাপড় বেঁধে বসে থাকেন, উপভোগ করেন এ আবহ। এরপর পরিবেশন করা হয় খাবার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন কর্মকার প্রতি শুক্রবার গুরুদুয়ারায় আসেন ভজন সংগীত শুনতে। সংগীতের মূর্ছনা তাকে মুগ্ধ করে, আর এখানে একবেলা ভালো মানের খাবারও খেতে পারেন তিনি।
সুমন বললেন, 'ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানোর চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে?' কথার ফাঁকে এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন তিনি। ছিন্নমূল মানুষের পক্ষ থেকে তিনি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, 'মানুষের প্রতি মানুষের এ সৌহার্দ্য টিকে থাকুক।'
ছবি: জুনায়েত রাসেল/টিবিএস