যানজটের ফেরিওয়ালা: ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালের হকারদের নেপথ্যের গল্প
সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। ঢাকার অন্যতম ব্যস্ততম বিজয় স্মরণীর রাস্তায় গাড়ি, মোটরসাইকেল, বাস ও রিকশাগুলো ধীরগতিতে গন্তব্যের দিকে ছুটছিল। কানে ভেসে আসছিল এসব যানবাহনের বিরক্তিকর ও অপ্রয়োজনীয় হর্নের তীব্র শব্দ। যাত্রীদের জন্য সময়টা বেশ বিরক্তির হলেও কিছু মানুষের কাছে এটাই তাদের জীবিকার জন্য সবচেয়ে ভালো একটি সুযোগ। আর এ মানুষগুলো হলেন হকার, যারা রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে পণ্য বিক্রি করেন।
যানজটের মধ্যেই হকাররা হেঁটে হেঁটে তাদের পণ্য নিয়ে যান যাত্রীদের কাছে। হাতে থাকা পণ্যগুলি দেখিয়ে সম্ভাব্য ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকেন তারা। সব যাত্রীই যে পণ্যগুলো দেখা বা কেনার জন্য তাদের ডাকেন, বিষয়টি তেমন নয়। কোনো হকার আবার চুপচাপ ঘুরতে থাকেন, কেউ আবার সব গাড়ির কাছে না গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু গাড়ির কাছে যান। এক্ষেত্রে তারা সম্ভাব্য ক্রেতাকে টার্গেট করেন এবং সেসব গাড়ির জানালার সামনে পণ্য তুলে ধরে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এতে যানজট পরিস্থিতিতে ছোট ছোট এ ব্যবসাগুলি যেন এক ব্যস্ত ছোট মার্কেটে পরিণত হয়। যেখানে হকাররা তাদের অসাধারণ দক্ষতা দেখান। পণ্য বিক্রি করতে তাদের অফারগুলিও বেশ বৈচিত্র্যময়। সময় ও ট্রেন্ডের সাথে যা পরিবর্তন হয়।
সান্ধ্যকালীন এ বিশেষ সময়ে বিক্রেতারা ঝুড়ি, স্ন্যাকস থেকে শুরু করে তোয়ালে, গাড়ির ডাস্টারসহ নানা জিনিস বিক্রি করেন। এ ব্যবসাগুলি সাধারণত দুটি মডেলের যেকোনো একটি উপায়ে করা হয়। প্রথমত, বিক্রেতারা সরাসরি ঢাকার বা বাইরের কারখানা থেকে পণ্য ক্রয় করে এবং নিজের মতো করে বিক্রি করেন।
তবে সবচেয়ে সাধারণ মডেলটি হচ্ছে- একজন গ্রুপ লিডার থাকেন যিনি কি-না মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন। তিনি পণ্যগুলি কিনে আনেন এবং বিক্রেতাদের একটি গ্রুপের মাঝে সেগুলি ভাগ করে দেন। এক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঝুঁকি নিয়ে পরবর্তীকালে সেটি থেকে তিনি মুনাফা লাভ করেন।
রাস্তার বিক্রেতারা প্রতিদিন ১০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো উপার্জন করেন। এটি দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন।
হস্তশিল্প
মোহাম্মদ উজ্জ্বল হস্তশিল্পের পণ্য বিক্রি করেন। যার মধ্যে রয়েছে কলা পাতা, ঘাস এবং নাইলন দিয়ে তৈরি ঝুড়ি। পণ্যটির দাম ক্ষেত্রভেদে ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। তার মামাও রাস্তার অপরদিকে এ ট্রাফিক সিগন্যালে কাজ করেন।
উজ্জ্বল আমাকে পণ্য দেখাতে গিয়ে তার ব্যবসায়িক একটি কার্ডও দেন। যেটা তিনি নিয়মিত গ্রাহকদের দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, "দেখুন, এটি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য এবং নানা কাজে ব্যবহার করা যায়।"
পণ্যগুলো আসে বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর থেকে। এক্ষেত্রে পরিবহন খরচ কমাতে উজ্জ্বল ও তার দল অন্য মালপত্র সরবরাহ করার পর খালি ফিরে আসা লরিগুলিতে করে পণ্য নিয়ে আসেন। এতে করে তারা পরিবহণ খরচ বেশ কমাতে পারে। উজ্জ্বল নিজেসহ মোট চারজন মিলে শহরের বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে এই সুন্দর কারুকাজ করা হস্তশিল্পের পণ্যগুলো বিক্রি করেন।
উজ্জ্বল বলেন, "এই পণ্যগুলি বেশিরভাগই রপ্তানির জন্য কিংবা আড়ং-এর মতো দোকানের জন্য তৈরি করা হয়। কিন্তু শিপমেন্ট বাতিল হলে, অর্ডার ফিরিয়ে দিলে কিংবা ছোটখাটো ত্রুটি থাকলে তখন প্রস্তুতকারকেরা সেগুলি সংগ্রহের জন্য আমাদের ডাকেন৷ পণ্যগুলি এভাবেই আমাদের হাতে আসে।"
পণ্যের স্টক আনতে উজ্জ্বল বা তার চাচা বগুড়ায় যান। উজ্জ্বল আট বছর বয়স থেকে ট্রাফিক সিগন্যালে হস্তশিল্পের পণ্য বিক্রি করছেন। সময়ের সাথে সাথে তিনি গ্রাহকদের সাথে নেটওয়ার্কিং করার জন্য একটি কৌশল তৈরি করেছেন।
উজ্জ্বল সম্ভাব্য ক্রেতাদের বিজনেস কার্ড দেন। যাতে করে প্রায়শই সে ফের অর্ডার পান। তিনি হাসিমুখে বলেন, "উদাহরণস্বরূপ, কারো প্রতিবেশী যদি তাদের পছন্দের একটি ঝুড়ি দেখে এবং কিনতে চায় তবে তারা সরাসরি আমাকে কল করতে পারেন। আমি হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ইত্যাদি সবকিছুতেই আছি। আমি প্রায়ই এভাবেই অর্ডার পাই।"
গাড়ি মোছার ডাস্টার
ট্রাফিক সিগনালে বিক্রি হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে পালকের তৈরি ডাস্টার অন্যতম। বিশেষ করে গাড়ির মালিকেরা তাদের যানবাহন পরিষ্কারের জন্য এটি ব্যবহার করেন। ফয়জুল করিম নামের এক হকার ১১ বছর ধরে ডাস্টার বিক্রি করছেন। এমনকি তার পরিবারের অন্য দুই সদস্যও এ ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়েছেন। তারা এখন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্যটি বিক্রি করছেন।
একটি ডাস্টারের দাম ১০০ থেকে ৪০০ টাকা। ফয়জুল প্রতিদিন গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করেন।
তিনি বলেন, "আমরা ৮৫ টাকায় ন্যূনতম দামের ডাস্টার কিনি এবং ১০০ টাকায় বিক্রি করি। প্রতিটিতে কমপক্ষে ১৫ টাকা লাভ হয়। কখনও কখনও খুশি হয়ে ক্রেতারা একটি ডাস্টারের জন্য ১২০ বা ১৫০ টাকা দেন। তবে আমি সাধারণত ১০০ টাকায় বিক্রি করি।"
উজ্জ্বল নিজের ব্যবসা সম্পর্কে খোলামেলা আলাপ করেন। ফয়জুল সাধারণত প্রায় এক হাজার টাকা মূল্যের ডাস্টার বাল্কে কিনে থাকেন। সব বিক্রি করা হলে তিনি আবার কামরাঙ্গীর চরের কারখানায় গিয়ে নতুন করে কিনেন। তিনি একসময় ওই এলাকায় থাকতেন এবং সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করতেন। কিন্তু তার বেশ কয়েকটি সাইকেল চুরি হয়ে যাওয়ায় তিনি বিজয় স্মরণীর কাছে বর্তমান অবস্থানে চলে আসেন।
ফয়জুল বলেন, "সাইকেলগুলি হারানোতে বেশ ক্ষতি হয়েছিল। দ্রুত যাতায়াতের জন্য এটি বেশ প্রয়োজনীয় ছিল।"
ডাস্টার তৈরির প্রক্রিয়াটি জটিল। প্রতিটি পালক পৃথকভাবে কিউরেট করা হয় এবং তারপর একটি লাঠির সাথে সংযুক্ত করা হয়। যার জন্য বেশ সময় ও পরিশ্রমের প্রয়োজন। কামরাঙ্গীচরের কারখানায় এসব তৈরি করা হয়; যাতে বেশির ভাগ কাজ করেন নারীরা।
ফয়জুল বলেন, "আমি যেটা ডাস্টারটা ৮৫ টাকায় কিনছি সেটি যে নারী তৈরি করেছেন তিনি এই কাজের জন্য মাত্র ২০ টাকা পান। পুরুষরা সাধারণত এত কম মজুরিতে কাজ করে না। তাই কারখানাগুলিতে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়।"
ডাস্টারের সাধারণ কারখানাগুলিতে একজন মালিকের পাশাপাশি ২০ থেকে ২৫ জন নারী কর্মী কাজ করেন। তারপর আমরা হকাররা সেটা রাস্তায় বিক্রির জন্য সংগ্রহ করি।
স্ন্যাকস
আশরাফুল আলম নামের আরেক তরুণ বিক্রেতা বাদাম, চিনাবাদাম, পপকর্ন এবং রিং চিপসসহ ট্রাফিক সিগন্যালে বিভিন্ন ধরনের স্ন্যাকস বিক্রি করেন। তিনি বলেন, "আমি আমার ব্যবসার জন্য নিখুঁত স্পট জানি। বিকালের সময় লোকেরা প্রায়শই ক্ষুধার্ত থাকে এবং ট্রাফিক মধ্যে অপেক্ষা করার সময় জলখাবার খেতে পছন্দ করেন।"
আশরাফুলের কৌশল নির্ভর করে ট্রাফিক জ্যামের পূর্বাভাসের উপর। পিক আওয়ারে উপস্থিত থেকে বেশি বিক্রি করে থাকেন। কয়েক বছর ধরে তিনি এই রাস্তায় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করেছেন।
আশরাফুল বলেন, "আমি ফুল বিক্রি করতাম এবং মালা তৈরি করতাম।" তিনি গাড়ি চালাতেও জানেন। কিন্তু লাইসেন্স না থাকায় সম্প্রতি তাকে জরিমানা গুণতে হয়েছে। তাই তিনি ফের রাস্তায় ফেরি শুরু করতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে তিনি দৈনিক প্রায় ৫০০ টাকা আয় করেন।
আশরাফুল যে স্ন্যাকস বিক্রি করেন তা সায়েদাবাদের একটি কারখানা থেকে কিনেন। প্রতি ১০ টাকার প্যাকেট বিক্রিতে তার ২ টাকা লাভ হয়। অন্যান্য বিক্রেতাদের মতো যতক্ষণ না সমস্ত স্টক বিক্রি হয়, তিনি রাস্তায় থাকেন। সাধারণত রাত নয়টা বা দশটার মধ্যে বিক্রি শেষ হয়ে যায়। অবিক্রীত আইটেমগুলি আবার চাইলে কারখানায় ফেরত দেওয়া যায়। যেখানে পণ্যগুলিকে তাজা রাখার ফের ভাজা হয়।
লেবু
সাধারণত নির্দিষ্ট মৌসুমে লেবু বিক্রি করা হয়। মর্জিনা দুই ব্যাগ লেবু হাতে ধরে রাস্তায় পাশে ট্রাফিক পুলিশের গাড়ি থামানোর অপেক্ষায় থাকেন।
মর্জিনা গাড়ির জানালায় ঠকঠক করে ডাকেন, "লেবু, তাজা লেবু। আজ একদম কম দামে!" এভাবেই তিনি সম্ভাব্য ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মর্জিনা ব্যস্ত রাস্তার যানজটের দিকে তাকিয়ে বলেন, "আমি তিন দিন ধরে এখানে আসতে পারিনি।" তিনি নিয়মিত ফেরি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানান।
তিনি বলেন, "আমি সাধারণত অন্য কারো হয়ে বিক্রি করি না। কিন্তু আমার টাকার প্রয়োজন। তাই আমি আজ অন্য এক মহাজনের সাথে কাজ করছি।"
মর্জিনা শুধু নারী মহাজনদের সাথেই কাজ করেন। তার বর্তমান মহজনও একজন নারী। তিনি বলেন, "আমরা এই ব্যবসায় একে অপরকে সাহায্য করি। নারীরা নারীদেরকে সাহায্য করি। ঠিক এই পন্থা অবলম্বন করেই আমরা মাঝে মধ্যে জীবিকা নির্বাহ থাকি।"
মর্জিনা প্রতি বিক্রিতে ন্যূনতম ২০ টাকা লাভ করে। তিনি বলেন, "আমি একটি ব্যাগ ৬০ টাকায় কিনি এবং ৮০ টাকায় বিক্রি করি। ভাগ্য থাকলে আমি ৯০ টাকা বা এমনকি ১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারি। অর্থাৎ, আমি ৬০ টাকার উপরে যা বিক্রি করি তা আমার লাভ।"
এই ব্যবসার সঠিক সময়কে কাজে লাগানোই সবকিছু। প্রথম দিনে বিক্রি করা তাজা লেবুর দাম বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে অবশিষ্ট লেবুর দাম কমতে থাকে; যা উপার্জনকে প্রভাবিত করে।
মর্জিনা বলেন, "আপনাকে তাড়াহুড়ো করতে হবে। জানালায় টোকা দিতে হবে; ডাকতে হবে। এমনকি আপনার পা ব্যথা করলেও মুখে হাসি রাখতে হবে। এভাবেই আমরা বিক্রি করি।"