গরম গরম হাঁস ভুনা আর পিঠার টানে নীলা মার্কেটে
দেশি হাঁসের মাংস, সঙ্গে আতপ চালের চাপটি কিংবা চিতই পিঠা। শীত যখন বেশ জেঁকে বসেছে, তখন এটিই ঢাকায় খাবারের নতুন ট্রেন্ড! তা শীতের এই 'মাস্ট ট্রাই' কম্বো কোথায় পাবেন? ইন্টারনেটে খোঁজ নিতে গেলে ঘুরে ফিরে একটা নামই আসবে আপনার সামনে। নীলা মার্কেট! পূর্বাচলের ৩০০ ফিট এক্সপ্রেসওয়ের পাশেই যার অবস্থান।
হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্য এই মার্কেট ভোজনরসিকদের কাছে এক রকম তীর্থস্থান এখন। শুক্র-শনিবার তো বটেই, যেকোনো বন্ধের দিনে এখানে থাকে উপচে পড়া ভিড়। বিকেল থেকে শুরু করে সেই মধ্যরাত অবধি চলে খাওয়াদাওয়া।
পূর্বাচল সেক্টর-১ এ বিশাল জায়গাজুড়ে এই মার্কেট। ৩০০ ফিট এক্সপ্রেসওয়ে এমনিতেই দর্শনীয় স্থান। পাশেই নীলা মার্কেটের মজাদার হাঁসের মাংস। এই স্থানের সুখ্যাতি তাই দেশজোড়া। দূরদূরান্ত থেকে শুধু হাঁসের মাংস খেতেই অনেকে আসেন এখানে। দু'পাশে শত শত রেস্তোরাঁ থেকে ইচ্ছেমতো যেকোনো একটায় বসে উপভোগ করা যায় দেশি হাঁসের ঝাল ঝাল মাংস কষা, সঙ্গে বাহারি পিঠা।
দেশি হাঁস, আতপ চালের পিঠা
রাস্তার দুপাশে সারি সারি দোকান। প্রায় প্রতিটিই একটি বিশেষ খাবারের, যার জন্য বিখ্যাত এই নীলা মার্কেট। দুপুরের পর পরই শেষ হয়ে যায় মাংস কাটা ধোয়া। সূর্য পশ্চিমে ঢলতেই বড় বড় কড়াইয়ে শুরু হয় রান্না। আর তাতেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ঘ্রাণ।
শুক্রবার, তাই ক্রেতা বেশি। ময়মনসিংহ পিঠাঘরে আজকে রান্না হচ্ছে ২০টি হাঁস। আরও ১০টি মজুদ আছে ঘরে। মিতু আক্তার তার পরিবার নিয়ে প্রায় আড়াই বছর হলো এখানে ব্যবসা করছেন। মজার খাবার আর মার্কেটের প্রবেশমুখে দোকান হওয়ায় শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। জানালেন, ছুটির দিনগুলোতে বিকেল থেকে রাত ১টা পর্যন্ত বেচাকেনা চলে তার দোকানে।
খাবারের আইটেম হিসেবে থাকে দেশি পাতি হাঁসের মাংস। সঙ্গে আতপ চালের চাপটি, চিতই আর চালের পিঠা। এছাড়া কোনো কোনো দোকানে পাওয়া যায় রুমালি রুটি। হাঁস ছাড়াও গরুর মাংস, দেশি মুরগি ভুনা, গরুর বটও বিক্রি করেন মিতু আক্তার। পাওয়া যায় প্রায় ৫-৬ রকমের ভর্তা। জানালেন, হাঁসের মাংস ২৫০ টাকা প্লেট— যাতে ১টি লেগ পিস সহ মোট ৫ পিস মাংস থাকে, সঙ্গে আনলিমিটেড ঝোল।
এছাড়া গরুর মাংস ২৫০, দেশি মুরগি ৩০০, আর গরুর বট ২০০ টাকা প্লেট। মাংসের সঙ্গে খাওয়ার জন্য চাপটি, আটার রুটি, রুমালি রুটি ২০ টাকা করে, আর ডিম চাপটির দাম ৪০ টাকা।
ছুটির দিনে হাঁসের টানে
সন্ধ্যা নামতেই ৩০০ ফিটে ঘুরতে আসা মানুষেরা আসতে শুরু করেন নীলা মার্কেটে। অনেকের আবার সরাসরি গন্তব্যই এটি। উদ্দেশ্য, এখানকার মজাদার সব খাবার। এই যেমন ব্যাংকার মাহাবুব কবীর। পুরো পরিবার নিয়ে বিকেলেই চলে এসেছেন মার্কেটে। জানালেন, ছুটির দিনে হাঁসের মাংস খেতে এসেছেন। এর আগে ৩০০ ফিটে ঘুরতে এসেছেন, কিন্তু এদিকটায় খেতে আসা হয়নি। এবার ছুটির দিনে পুরো পরিবার নিয়ে হাজির তিনি।
সন্ধ্যা নামতেই এখানে বাড়ে ভোজনরসিকদের আনাগোনা। প্রতিটি দোকানেই থাকে উপচে পড়া ভিড়। খাবার পরিবেশনে হিমশিম খান কর্মীরা। রাত যত বাড়ে, ততই জমে ওঠে খাওয়া-দাওয়া। কথা হলো এশাদ রহমানের সাথে। স্টেট ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই ক্ষুধা নিবারনের জন্যই এখানে আগমন। খাওয়া-দাওয়া শেষে ১১ জনের এই দলটির খরচ হলো প্রায় ৪ হাজার টাকা।
এশাদ বললেন, "এখানকার খাবার তো অনেক ভাইরাল আগে থেকেই। হাঁস খেতে হলে এখানেই আসতে হবে। খাবারও বেশ উপভোগ্য। বিশেষ করে চাপটি দিয়ে হাঁস। অনবদ্য লাগে খেতে।"
একই কথা জানালেন তার বন্ধু সামি। পূর্বাচলেই থাকেন তিনি। বললেন, "মাঝেমধ্যেই আসি। বিশেষ করে, এই শীতকালে। হাঁসের মাংসের টানে বার বার আসতে হয়।"
তাদের মতে শহরের নামিদামি রেস্তোরাঁর থেকে কিছুটা আলাদা এই মার্কেটের দোকানগুলো। জানালেন, খাবারে ঘরোয়া রান্নায় স্বাদ পান তারা।
মটির চুলায় কাঠের 'লাকড়ি'
নীলা মার্কেটের আরেকটি বিশেষত্ব হলো, এখানে হাঁসের মাংস রান্না হয় মাটির চুলায়, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় শুকনো কাঠ। এ কারণে খাবারের স্বাদ অনেকটাই বেড়ে যায় বলে দাবি করছেন দোকানিরা। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে অনেকের দোকানে সাইনবোর্ডেও লেখা থাকে- 'লাকড়ি দিয়ে মাটির চুলায় রান্না হয়!'
নিমন্ত্রণ পিঠা ঘরে রান্না করছিলেন খালেদা আক্তার। মাটির চুলার বিশেষত্ব জানাল গেলো তার কাছে।
"মাটির চুলায় কাঠ দিয়া রানলে রান্নাডা হইতে টাইম লাগে। আস্তে আস্তে রান্না হয়। এজন্য খাবারডা মজা হয়। আর হাঁসের মাংস তো অনেক সময় নিয়া রান্না করা লাগে। মাংস শক্ত থাকলে খাইয়া মজা নাই," বললেন খালেদা।
এই মার্কেটের হাঁসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য বেশিরভাগ হাঁস আসে হাওড় অঞ্চল থেকে। জামাই-বউ পিঠা ঘরের মালিক মোহম্মাদ সেলিম মিয়া জানালেন, তাদের নির্দিষ্ট লোক রয়েছে, যারা এই হাঁস সরবারহ করেন।
"আমাদের লোক আছে। ওরা ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা থেকে হাঁস দিয়ে যায়। একদম প্রাকৃতিক দেশি হাঁস। হাওড়ে যেগুলো পালা হয়," বলেন সেলিম মিয়া।
শীতে জমে ব্যবসা
জামাই-বউ পিঠাঘরে শুক্র-শনিবারে ১৫ থেকে ২০টি হাঁস লাগে। আর শীতের দিনে, বিশেষ করে কোনো ছুটিতে এই সংখ্যা ৪০ এ গিয়ে ঠেকে।
মোহম্মাদ সেলিম মিয়া জানালেন, হাঁসের মাংস সারাবছর চললেও শীতেই তাদের ব্যবসা জমে ওঠে। "আমাদের সিজনটা শুরুই হয় শীতের সময়। সারাবছর এমনি বন্ধের দিনে চলে। শীতের দিনে সন্ধ্যার পর থেকে অনেক ভিড় হয়। দোকান ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলে। শীতের তিন মাস বেশি বেচাকেনা হয়।"
অনন্যা খাবার ঘরের মালিক জাকির মিয়া বললেন, নীলা মার্কেটে কমপক্ষে দেড়শো থেকে দুইশো দোকান রয়েছে যারা হাঁসের মাংস বিক্রি করে। আর শীতেই সবচেয়ে জমজমাট হয়ে ওঠে ব্যবসা।
"শীতে গরম গরম হাঁস ভুনা দিয়ে পিঠা খাইতে সবাই পছন্দ করে। এই সিজনে এক মাসে আমার প্রায় দুইশো থেকে আড়াইশ হাঁস লাগে। আমার চেয়ে বেশি চলে যেসব দোকান, তাদের আরও বেশি লাগে। আমরা ব্যবসাটা করিই এই শীতকালে," বললেন জাকির মিয়া।
শীতে এত পরিমাণ বিক্রি হয় যে, বেশি মানুষের খাবার একেবারে দিতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। তাই বেশি মানুষ গেলে আগে থেকেই খাবার অর্ডার দেওয়ার পরামর্শ দিলেন জাকির। প্রয়োজনে ফেসবুকে দেওয়া তার দোকানের মোবাইল নম্বরে কল দিয়েও অর্ডার দেওয়া যাবে।
এসব দোকানে বসে খাওয়ার পাশাপাশি পার্সেল নিয়ে আসারও চমৎকার সুযোগ রয়েছে। এর জন্য বাড়তি কোনো মূল্যই রাখা হয় না। সপ্তাহে ৭ দিনই দোকান খোলা থাকে। সারাদিন সব খাবার পাওয়া যায়। তবে হাঁসের মাংস খেতে হলে যেতে হবে বিকেলের পর।
শাকিলার ভাইরাল দোকান
নীলা মার্কেটে এসে অনেকে খোঁজ করেন, শাকিলার দোকান কোথায়! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল শাকিলার দোকান খোঁজাটা স্বাভাবিক হলেও নীলা মার্কেটে খোঁজাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ শাকিলার দোকান অন্য জায়গায়। নীলা মার্কেটের ঠিক উল্টো দিকে ১২ নম্বর সেক্টরের বুরলিয়া চত্বরেও অসংখ্য দোকানে বিক্রি হয় হাঁসের মাংস। এখানেই খাবার বিক্রি করেন শাকিলা।
প্রায় ৫ বছর ধরে এখানে দোকান চালান শাকিলা ও তার পরিবার। জানালেন, ফেসবুক আর ইউটিউবের কল্যাণেই তার এই পরিচিতি। এখানকার অন্যান্য দোকানের মতোই হাঁস, গরু, মুরগির সাথে চাপটি, চিতই আর রুটি বিক্রি করেন তিনি। দাম একই। বিকেল থেকে শুরু করে রাত ৩-৪টা পর্যন্ত বিক্রি করতে হয় তাকে।
শাকিলার দোকানে যেতে হলে ৩০০ ফিট রাস্তা থেকে নীলা মার্কেটের বিপরীত দিকে যেতে হবে। পূর্বাচল সেক্টর ১২–তে তার দোকান।
হাঁস ছাড়াও আরও যা
শুধু হাঁসের মাংস খেতে কেন মানুষ এত দূর আসে? আপনার প্রশ্নটি যদি এমন হয়, তবে আপনি সম্পূর্ণ খবর পাননি। হাঁসের মাংস আর চিতই পিঠা ছাড়াও এই মার্কেটে আরও বাহারি সব খাবার পাওয়া যায়। এরমধ্যে অন্যতম হলো, গরম গরম মিষ্টিজাতীয় খাবার। চোখের সামনে বানানো মিষ্টি তাৎক্ষণিক অর্ডার দিয়ে খাওয়া যায় এখানে। রসগোল্লা, বালিশ মিষ্টি, মালাই চপ, সন্দেশ, লেংচা, গোলাপ জামুন, ছানা, দধি থেকে শুরু করে প্রায় সবধরনের জনপ্রিয় মিষ্টি এখানে পাওয়া যায়। এছাড়াও, খাবারের মধ্যে রয়েছে তান্দুরি চা. ৫০ ও ৬০ টাকা মূল্যে দুই ধরনের তান্দুরি চা পাওয়া যায় এখানে।
নীলা মার্কেটের আরেকটি জনপ্রিয় খাবারের নাম বারবিকিউ! মাছ, মাংস আর সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণির বারবিকিউ জায়গাটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া, আর নানান ধরনের মাংসের বারবিকিউ পাওয়া যায় এখানে। এছাড়া, স্পেশাল আইটেম হিসেবে কোনো কোনো দোকানে রয়েছে হান্ডি বিফের আয়োজন।
এসব খাবারের বাইরে আরেকটি কারণে এ মার্কেটে অনেকের প্রিয়। আর তা হলো এখানকার বারোমাসী মেলা। নীলা মার্কেটে দর্শনার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয় একটি বিশাল বড় মেলার। তাতে নাগরদোলা, নৌকা রাইড ছাড়াও থাকে শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা। অন্য যেকোনো মেলার মতোই হরেক আইটেমের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা।
সবশেষে এই মার্কেটকে বিশেষ করে তোলে এর পাশ দিয়ে বয়ে যায় টঙ্গী খাল— যাকে অনেকে ডাকেন বালু খাল বলে। খাবারের বেশিরভাগ দোকানই এ খালের পাড়ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে। খালের পাশের দোকানে বসে যেকোনো খাবারই বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
ছবি: জুনায়েত রাসেল/টিবিএস