ঢাকা কেন জেগে থাকে রাতভর? জানাবে স্লিপ ল্যাব
বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছেন নাহিদ। তার মাথা, বুকে, পেটে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে বৈদ্যুতিক তার জড়ানো। একটি টেপ চোয়াল থেকে মাথা পর্যন্ত আটকে আছে।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আরাম বোধ করছেন? হালকা হাসি দিয়ে তিনি বললেন, 'না, আসলে এভাবে ঘুমানো কতটা সম্ভব তা বুঝতে পারছি না।'
সেদিন রাতে ঢাকার আফতাবনগরের একটি স্লিপ ল্যাবের ভেতরে বসে কথা হচ্ছিল নাহিদের সাথে। নিদ্রাজনিত রোগ শনাক্ত করতে তাকে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছিল।
যন্ত্রগুলো সংযুক্ত করার পর, নিভিয়ে দেয়া হলো ল্যাবের সকল আলো, অন্ধকারে আচ্ছন্ন পুরো ঘর। স্টিলের পার্টিশন দিয়ে বিভক্ত কক্ষটিতে কেবল ডেস্কটপ মনিটরের নীলচে আলো জ্বলছিল। সেখানে ঢেউয়ের মতো রেখায় ফুটে উঠছিল নাহিদের হৃদস্পন্দন, পায়ের নড়াচড়া, মস্তিষ্কের কার্যকলাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং চোখের নড়াচড়ার তথ্য।
নাহিদ ঘুমিয়ে গেলেও জেগে ছিলেন টেকনিশিয়ান মেহেদি ও তার সহকারী রুবেল। কম্পিউটারের মনিটরের সামনে বসে নানান তথ্য পর্যবেক্ষণ করছিলেন। মেহেদি বললেন, 'আমাদের অন্তত কয়েকটি ঘুমের চক্র রেকর্ড করতে হয়। প্রতিটি রোগীর অবস্থাই ভিন্ন, তাই পরীক্ষা রোগীর ঘুমিয়ে পড়ার পর তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে পারে।'
পরীক্ষা শেষে ফলাফল—রোগীর ঘুমের সময়ের শারীরিক কার্যকলাপের বিস্তারিত গ্রাফ—একজন চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয়।
নাহিদের ক্ষেত্রে এই ফলাফল পর্যবেক্ষণ করবেন রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালের পালমোনোলজিস্ট ও স্লিপ বিশেষজ্ঞ ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন। আফতাবনগরে এই বেসরকারি স্লিপ ল্যাবটি তারই উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে।
বর্তমানে দেশে অল্প কয়েকটি হাসপাতালেই স্লিপ ল্যাব রয়েছে। এগুলো মূলত ঘুমজনিত রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে সাধারণ ঘুমজনিত রোগগুলোর একটি হলো স্লিপ অ্যাপনিয়া। তবে অন্যান্য ঘুমজনিত সমস্যাও বিদ্যমান।
ঢাকার প্রেক্ষাপটে স্লিপ ল্যাবের ধারণা এখনো বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানা। দেশের অন্যান্য অংশের কথা তো আরও দূরে। এ দেশের মানুষ যেখানে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুতর অসংক্রামক রোগ এবং ভগ্নপ্রায় (সরকারি) বা ব্যয়বহুল (বেসরকারি) স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই ব্যস্ত, সেখানে নিদ্রাজনিত সমস্যাগুলো প্রায়শই গুরুত্বহীন থেকে যায়।
কেন 'স্লিপ আর্কিটেকচার' নিয়ে মাথা ঘামাই না আমরা?
ডা. নাহিদ রায়হান লক্ষ্মীপুর থেকে এসেছেন। অনলাইনে ঢাকা স্লিপ রিসার্চ সেন্টারের বিষয়ে জেনেছেন তিনি। 'আমরা পিজি হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ) এবং পপুলার হাসপাতালে ফোন করেছিলাম। একজন বলল ফেব্রুয়ারিতে স্লিপ ল্যাবের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাবে, আরেকজন জানাল জানুয়ারিতে,' বলছিলেন নাহিদ।
পেশায় একজন চিকিৎসক নাহিদ এতদিন অপেক্ষা করতে পারেননি। গত ছয় মাসে তার ঘুমের সমস্যা আরও বেড়েছে। 'বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট থেকে এটি আরও খারাপ হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
তার প্রধান সমস্যা ঘুমের ব্যাঘাত, মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠা এবং ঘুম থেকে ওঠার পর অস্বস্তিবোধ করা। এর প্রভাব দৈনন্দিন কাজের ওপরও পড়ছিল।
তিনি বলেন, 'এটি আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি আর অপেক্ষা করতে পারি না। প্রায় এক বছর ধরে ঠিকমতো না ঘুমাতে পারার মানসিক ও শারীরিক চাপ অসহনীয়'।
স্লিপ ডায়াগনোসিসের জন্য কাজ থেকে বিরতি নিয়েছেন নাহিদ। তিনি ও তার বাবা লক্ষ্মীপুর থেকে এসে প্রথমে এলিফ্যান্ট রোডে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলেন। সেখান থেকে আফতাবনগরের স্লিপ ল্যাবে যান। 'আমি এখানে আসার আগে ল্যাবএইডে ডা. মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে দেখা করেছি', জানান তিনি।
'তাহলে দেশের মানুষ কি স্লিপ ল্যাব সম্পর্কে সচেতন?', জিজ্ঞেস করলাম তাকে। 'স্লিপ ল্যাব? না। এমনকি চিকিৎসক সমাজেও, যদি আমি পলিসমনোগ্রাফি (স্লিপ স্টাডি) নিয়ে কথা বলি, তাদের অনেকেই বিভ্রান্ত হন,' বললেন নাহিদ।
নাহিদের স্লিপ স্টাডি শেষ হয় রাত আড়াইটায়। এরপর টেকনিশিয়ান, নাহিদ ও তার বাবা সকাল ৮টা পর্যন্ত ল্যাবেই ছিলেন। এই পরীক্ষা করতে ৪০ শতাংশ ছাড় দিয়ে ১২ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে তাকে।
মুঠোফোনে নাহিদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, 'আমার শরীরে যন্ত্রগুলো সংযুক্ত থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারিনি। তবে টেকনিশিয়ানরা জানিয়েছেন যে তাদের প্রয়োজনীয় ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে'।
পরের দিন (২১ নভেম্বর) নাহিদ চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানতে পারেন, তার স্লিপ অ্যাপনিয়া নেই। ঘুমের উন্নতির জন্য তাকে 'ফিল ফ্রেশ' নামের ওষুধ এবং ঘুমের স্বাস্থ্যবিধি (স্লিপ হাইজিন) মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। বর্তমানে আগের থেকে বেশ ভালোভাবে ঘুমোতে পারছেন বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে স্লিপ ল্যাব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব মূলত ঘুমের গুরুত্ব নিয়ে মানুষের অজ্ঞতা থেকেই আসে। দীর্ঘস্থায়ী ঘুমজনিত সমস্যার চিকিৎসা না হলে এটি স্মৃতিশক্তি হ্রাস, যৌনাকাঙ্ক্ষায় হ্রাসসহ বিভিন্ন মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের ব্যাধি স্ট্রোক, ডায়াবেটিস এবং কিডনির রোগসহ বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়। ডা. মোশাররফ হোসেন বলেন, 'বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে এটি অবস্থাকে আরও খারাপ করতে পারে।'
তাহলে এত গুরুতর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সচেতনতার অভাব কেন? ডা. হোসেন মনে করেন, 'চিকিৎসকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব আরও বড় একটি সমস্যা। আমরা কখনই রোগীর কাছে তাদের ঘুম নিয়ে প্রশ্ন করি না। রোগী যে কারণেই চিকিৎসকের কাছে আসুক না কেন, ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি ৯০ শতাংশ স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। প্রতিটি চিকিৎসকের উচিত এটি নিয়ে প্রশ্ন করা'।
ঘুমের একটি চক্র সাধারণত ৬০ থেকে ৯০ মিনিট স্থায়ী হয়, এবং একটি স্বাস্থ্যকর ঘুমে ছয় থেকে সাতটি এমন চক্র থাকে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ সময় আমরা নন-আরইএম (যেখানে চোখের দ্রুত নড়াচড়া থাকে না) ঘুমে থাকি এবং ২০ শতাংশ সময় আরইএম (যতটুকু সময় আমরা স্বপ্ন দেখি)। আরইএম বা র্যাপিড আই মুভমেন্ট হলো ঘুমের একটি বিশেষ স্তর, যেখানে মস্তিষ্ক খুবই সক্রিয় থাকে এবং স্বপ্ন দেখা হয়।
এই ঘুমের চক্রের মধ্যে আরও কিছু স্তর রয়েছে, যেগুলো মিলেই গড়ে তোলে আমাদের ঘুমের প্রকৃতি বা স্লিপ আর্কিটেকচার।
সাধারণ ঘুমের ব্যাধিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইনসোমনিয়া (অনিদ্রা), নারকোলেপসি (একটি দীর্ঘস্থায়ী স্নায়বিক সমস্যা, যা মস্তিষ্কের ঘুম-জাগরণ চক্র নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটায়) এবং স্লিপ অ্যাপনিয়া। এছাড়া পারাসমনিয়া, স্লিপ-সম্পর্কিত নড়াচড়ার ব্যাধি (যেমন ঘুমের মধ্যে হাঁটা) ইত্যাদিও ঘুমজনিত অন্যান্য সমস্যার অন্তর্ভুক্ত।
আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব স্লিপ মেডিসিন দ্বারা প্রকাশিত 'ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব স্লিপ ডিসঅর্ডারস' বইয়ে ঘুমজনিত ১০০টি রোগের তালিকা রয়েছে, যার মধ্যে অতিরিক্ত ঘুমের কথাও উল্লেখ আছে।
বাড়ছে নিদ্রাজনিত সমস্যার প্রবণতা, শীর্ষে স্লিপ অ্যাপনিয়া
বাংলাদেশে ঘুমজনিত সমস্যার রোগী কি বেড়েছে? 'হ্যাঁ, এটি দেশের উন্নত আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি,' এমন মন্তব্য করেন ডা. হোসেন। তিনি ২০০৫ সালে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে দেশের প্রথম স্লিপ ল্যাব স্থাপন করেন।
জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের (জেবিএফএইচ) স্লিপ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ডা. সরদার এ বাকী জানিয়েছেন, প্রতি বছর তাদের হাসপাতালে অন্তত দুইশ থেকে আড়াইশ রোগী স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগের চিকিৎসার জন্য আসেন।
স্লিপ অ্যাপনিয়া দুই ধরনের: অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (যখন গলা বন্ধ হয়ে যায় এবং রোগী শ্বাস নিতে না পেরে জেগে ওঠে) এবং সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া (যা স্নায়ুজনিত কারণে হয়, যেমন- পারকিনসন রোগ)।
'এছাড়া, যদিও রোগীর সংখ্যা কম, আমরা কিছু রোগী পাই যারা ইনসোমনিয়া বা নারকোলেপসি নিয়ে আসেন,' বলেন ড. বাকী। এই ধরনের রোগীদের সাধারণত ওষুধ এবং জীবন চর্যা পরিবর্তনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জাপান-বাংলাদেশ হাসপাতালের পর এভারকেয়ার, স্কয়ার, এবং ল্যাবএইদের মতো কিছু বেসরকারি হাসপাতাল স্লিপ ল্যাব চালু করেছে। এসব ল্যাবে ঘুমের পরীক্ষা করার খরচ ১০ হাজার টাকার বেশি হতে পারে। জেবিএফএইচ-এ এর খরচ ১৫ হাজার টাকা।
সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্লিপ ল্যাব রয়েছে। সেখানে খরচ তুলনামূলকভাবে একটু কম।
গবেষণা বলছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে নিদ্রাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ার অন্যতম বড় কারণ কোভিড-১৯ মহামারি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্লিপ অ্যাপনিয়া এবং ইনসোমনিয়ার প্রবণতা বেড়েছে, এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা।
বাড়িতে ঘুমের পরীক্ষা বা হোম স্লিপ অ্যাপনিয়া টেস্ট করার জন্যও এখন বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। বেশ কিছু কোম্পানি এমন সেবা দিচ্ছে যেখানে টেকনিশিয়ানরা বাড়িতে গিয়ে ঘুমের পরীক্ষা করেন এবং পরে স্লিপ অ্যাপনিয়া মেশিনের প্রেসক্রিপশন দেন।
ডা. হোসেন বলেন, 'আমি এটির শক্তভাবে বিরোধিতা করি, কারণ এসব টেকনিশিয়ানরা চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত পেশাদার নয় এবং তারা সঠিকভাবে এই রোগ নির্ণয় করতে পারে না। এটাই ছিল আমার আফতাবনগরে সেন্টার শুরু করার একটি কারণ। কারণ আমি জানি কতটা অপব্যবহার হচ্ছে'।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন