সেরা করদাতা কাউছ মিয়ার অদ্ভুত নেশা
ঘিঞ্জি বাড়িঘর আর কোলাহলে পরিপূর্ণ ঢাকায় মনের মতো বাসাবাড়ি খুঁজে পাওয়া যে কতোটা মুশকিল তা ঢাকাবাসী মাত্রই জানে। সেখানে রোজকার যাওয়া-আসার পথে এক প্রাণহীন নিস্তব্ধ বাড়ির দেখা মিললে মনে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক।
ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত প্রকাণ্ড বাড়িটির কথা বলছি তা বেশ দূর থেকেও নজর কাড়বে। তবে কাছে গেলে মিলবে না কোনো সাড়াশব্দ। ছিমছাম নীরবতায় ঢাকা ভবনটি যেন কোনো রহস্য গল্পের অংশ।
কারও যদি বাড়িটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকে তবে হতাশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ভেতরে যেমন কেউ নেই, তেমনি বাইরেও অধিকাংশ সময় তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে এই বাড়ি। স্থানীয়রা বাড়িটিকে 'ভূতুড়ে বাড়ি' বলেই ডেকে থাকেন।
ভাবতে অবাক লাগে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এমন একটি পরিবেশে এই বিশাল স্থাপনা খালি পড়ে আছে। তার থেকেও কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হলো বাড়িটির মালিক দেশের শ্রেষ্ঠ করদাতা। টানা ১৪ বছর ধরে সেরা করদাতার শীর্ষে অবস্থান করছেন ভবন মালিক কাউছ মিয়া।
হাকিমপুরী জর্দার প্রতিষ্ঠাতা এবং একমাত্র প্রস্তুতকারক কাউছ মিয়া। ইস্কাটনের বাড়িটি ছাড়াও কাউছ মিয়ার ঢাকায় ৩০টির অধিক ফাঁকা ভবনের মালিকানা রয়েছে।
২০০৮ সাল থেকে কাউছ মিয়া সেরা করদাতাদের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছেন। সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে তিনি ১৮টি রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারও লাভ করেছেন।
ফাঁকা এই ভবনগুলোর কোনোটিতেই নামফলক, চিহ্ন এমনকি বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত লেখা নেই। ভবনগুলোর একটি ইস্কাটন গার্ডেন রোডের পাঁচবাড়ি। স্থানীয়রা বাড়িটিকে এই নামেই চিনে। স্থানীয়দের ভাষায়, তারা যতদূর পর্যন্ত মনে করতে পারেন, সেই থেকে বাড়িটিকে ফাঁকাই দেখে আসছেন।
ভবনটিতে দায়িত্বরত কেয়ারটেকারদের মধ্যে নাঈম নামের একজনকে পায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের দল। নাঈম জানান, নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় ভবনটি খালি পড়ে আছে। "কনস্ট্রাকশনের কিছু কাজ এখনও বাকি আছে। মালিকপক্ষ অসম্পূর্ণ অবস্থায় বাড়ি লিজ বা ভাড়া দিতে চান না," বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, ভবন মালিকের পক্ষ থেকে তদারককারীরা নিয়মিতভাবেই খোঁজ নিয়ে যান।
বৃহদাকার স্থাপনাটিতে তিনটি ভবনের সংযোগ রয়েছে। প্রতিটি ভবনে পাঁচটি ফ্লোরে চারটি করে ইউনিট। একদম নিচে গ্রাউন্ড ফ্লোর পার্কিংয়ের জন্য বরাদ্দ আছে। "আমরা শিফট অনুযায়ী ভবনের দেখাশোনা করি," যোগ করেন নাঈম।
ভবনটির পাশেই মাহতাব রানার চায়ের দোকান। তিনি প্রায় ১১ বছর ধরে এই এলাকায় আছেন। মাহতাব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "আমি এখানে আসার পর ভবনটিতে কাউকে দেখিনি। এমনকি এখানে কোনো কাজও চলে না।"
তবে মজার ব্যাপার হলো কেউ যদি ভবন ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে সাথে সাথে মানা করে দেওয়া হয়।
মাহতাব নির্মাণ কাজের বিষয়টিও উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, "আমি গত ১১ বছর ধরে এই বাড়ি দেখে আসছি। এখানে বড় কোনো নির্মাণ কাজ দূরে থাকুক, মেরামতের কাজও হয়নি।"
তবে কেবল পাঁচবাড়িই নয়, ঢাকায় এরকম আরও অন্তত ৩৫টি বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স আছে কাউছ মিয়ার অধীনে। রমনা, মগবাজার, দিলু রোড, ইস্কাটন, ধানমন্ডি এবং পুরান ঢাকার মতো আকর্ষণীয় জায়গায় অবস্থিত এসব বাড়ি। কিন্তু সবগুলো বাড়িই ফাঁকা পড়ে আছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে, কাউছ মিয়া প্রতি বছর ৪৩-৪৫ কোটি টাকার আয়কর দিয়ে থাকেন। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত তিনি ব্যবসায়ী বিভাগে শীর্ষ স্বতন্ত্র করদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছেন। ৬১ বছর ধরে কাউছ মিয়া আয়কর দিয়ে আসছেন। ১৯৫৮ সালে তিনি প্রথম কর দেন। পাকিস্তান আমলেও ১৯৬৭ সালে তিনি সর্বোচ্চ করদাতার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক এক গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছিলেন, তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তিনি ৪০-৪৫টি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন।
১০ ইস্কাটন রোড, গাউসনগরে কাউছ মিয়ার অপর এক ছয় তলা ভবন অবস্থিত। এই ভবনটিও নির্মাণের পর থেকে খালি পড়ে আছে। প্রায় আট বছর ধরে ভবনটির দেখাশোনা করছেন রিজিয়া বেগম। তিনি জানান, ভবনটি অন্তত দশ বছর আগে নির্মিত।
"এখানে আসার পর থেকেই কোনো অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া বা লিজ দিতে নিষেধ করা হয়েছিল," জানান রিজিয়া।
তবে শুরুতেই কেন এ ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল তার কোনো ব্যাখ্যাই রাজিয়া দিতে পারেননি। রিজিয়া আরও জানান, তার স্বামী দাউদ মিয়াও একজন কেয়ারটেকার। মগবাজারে কাউছ মিয়ার আরেকটি ফাঁকা ভবনের দেখাশোনা করেন তিনি। দাউদ মিয়া রিজিয়ার থেকেও দীর্ঘ সময় ধরে কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি প্রায় ১৬ বছর ধরে আট তালা ভবনের নজরদারির দায়িত্বে আছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দাউদ মিয়া বলেন, "আজ পর্যন্ত এখানে কাউকে থাকতে দেওয়া হয়নি, কোনও অফিস চালানোর অনুমতিও ছিল না।" রিজিয়ার মতো তিনিও ভবনগুলো ফাঁকা রাখার রহস্য জানেন না।
গ্রিনরোডে অবস্থির গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সন্নিকটেই আছে কাউছ মিয়ার মালিকানাধীন পাঁচতলা এক অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। শোনা যায়, ২০১০ সালে কলেজ স্থাপনের আগে সংস্কার কাজের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই ভবনটিতে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, "আমরা প্রথমে কাউছ মিয়ার কাছে ভবনটি কেনার প্রস্তাব রেখেছিলাম। পরবর্তীতে ভাড়া দেওয়ার অনুরোধও করা হয়। কিন্তু তিনি প্রতিবারই আমাদের নিষেধ করে দেন।"
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের দল এরপর কাউছ মিয়ার ম্যানেজারদের একজন মোহাম্মদ রাসেলের সাথে যোগাযোগ করেন। রাসেল ফাঁকা ভবনগুলো তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কেয়ারটেকারদের বেতনও সরবরাহ করেন।
তিনি জানান, ঢাকায় কাউছ মিয়ার ৩০টির অধিক এরকম ফাঁকা বাড়ি আছে। "কিন্তু এই বিশাল ভবনগুলো ফাঁকা কেন?" মোহাম্মদ রাসেলও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। "এসব অ্যাপার্টমেন্টে কেন কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না, সে সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। আমাদের মালিক কাউছ মিয়ার পরিবার ধানমন্ডি এবং পুরান ঢাকার দু'টি ভবনে বাস করেন," বলেন রাসেল।
রাসেল এবং অন্যান্য যারা তার অধীনে কাজ করছেন, সবাইকেই ভবনগুলো যেমন আছে তেমনি রাখার নির্দেশনা দেওয়া আছে।
এবার সরাসরি আসল মানুষটির কাছ থেকেই রহস্য জানতে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের দল ছুটল পুরান ঢাকায়। পুরান ঢাকার চকবাজারে কাউছ কেমিক্যাল ওয়ার্কসের প্রধান দপ্তর।
তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য কাউছ মিয়া সরাসরি উপস্থিত হতে পারেননি। তার ব্যক্তিগত সহকারী আলী আহমেদ দাবি করেন, অধিকাংশ ভবনের কাজই অসম্পূর্ণ। তবে তাকে ভবনগুলোর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানানো হলে তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি।
কথা বলার সময় আলী আহমেদ কাউছ মিয়ার নিজের লেখা সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনীর উল্লেখ করেন। বইটির তথ্যানুযায়ী, কাউছ মিয়া নব্বইয়ের দশকে তার অপ্রকাশিত কিছু অর্থ সাদা টাকায় পরিণত করেন।
"কাউছ মিয়া বিশাল অঙ্কের টাকা সাদা করেন। তিনি সে টাকায় ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে জমি কেনা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি জমিগুলোয় ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন," বলেন আলী আহমেদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসের এক কর্মচারী বলেন, কাউছ মিয়া হয়তো শখের বশে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেন। "বাড়ি ভাড়া কিংবা লিজের ঝামেলা থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই তিনি বাড়িগুলো ফাঁকা রেখেছেন। একইসাথে স্থাপনাগুলো তার প্রতিষ্ঠার স্বাক্ষর বহন করছে।" বলেন তিনি।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) পরিচালক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, স্থান বিবেচনা করলে ভবনগুলোর মূল্য আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকার বেশি হবে।
"যদিও এটা কোনো অপরাধ না, তবে তিনি ভবনগুলো ফাঁকা না রাখলে, ঢাকা শহরে আবাসস্থলের হাহাকার সামান্য হলেও কমতে পারত," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন শাহাদাত।
তিনি আরও বলেন, "যে জমিগুলো কেনা হয়েছিল সেগুলো আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো যেত। সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার আওতায় আনলে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নেও যথাযথ ভূমিকা রাখত।"
স্থাপত্যের দিক থেকে পরিত্যক্ত কাঠামোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আয়োটিকের সদস্য স্থপতি মুমতাহিনা কবির বলেন, "কোনো কমপ্লেক্স বা আবাসিক ভবন প্রায় এক দশক ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রাখা হলে আর্দ্রতার কারণে কাঠামোতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।"
এধরনের ভবনগুলো ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
"এমনকি দীর্ঘ সময় পর সেখানে বসবাস শুরু করলে সেটাও বিপজ্জনক হতে পারে," যোগ করেন মুমতাহিনা।