রহস্যময় আবাবিল: যে পাখি চাঁদে যায়, পানিতে ঘুমায়...
৫৭০ খ্রিস্টাব্দ। মক্কার পার্শ্ববর্তী ইয়েমেনের শাসক আবরাহা তার রাজধানী সানাতে কাবার অনুরূপ ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ করেন। আবহারার ইচ্ছা মক্কার পরিবর্তে সানা ঘিরে আবর্তিত হবে বিশ্ববাসীর প্রার্থনা। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষ কাবা ত্যাগের কথা কোনোভাবেই ভাবতে পারে না। ক্ষুদ্ধ আবরাহা তাই কাবা গুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। ৯-১৩টি বড় বড় হাতি নিয়ে কাবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তার সৈন্যদল। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে হাতিগুলোও আর অগ্রসর হতে চায় না।
চতুর আবরাহা এবার হাতিগুলোকে খাবারের লোভ দেখান। খাবার দেখে সেগুলো আবারও আগাতে শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ করেই আবরাহার সেনারা থামতে বাধ্য হয়। তাদের ওপর বৃষ্টির মতো নুড়ি পাথরের ঢিল এসে পড়তে থাকে। দেখা যায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিতে আকাশ ছেয়ে গেছে। তারাই ছুড়ছে এসব ঢিল।
এভাবেই সৃষ্টির বৃহদাকার প্রাণীর পথ আটকে দেয় আকারে ক্ষুদ্র এক পাখি। কুরআন শরীফের সূরা ফিলে এই পাখির কথা উল্লেখ আছে। পাখিটি আবাবিল। আবাবিলের আক্ষরিক অর্থ পাখির ঝাঁক। অনেকে তাই একে নির্দিষ্ট কোনো পাখি মানতে নারাজ। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সোয়ালোকেই বলা হয় কুরআনের সেই আবাবিল। তবে সোয়ালো বা আবাবিল যে নামেই ডাকা হোক, তাতে এদের রহস্য কমবে না।
একসময় পশ্চিমাদের ধারণা ছিল শীতকালে আবাবিল পাখি চাঁদে যায়। অনেকে ভাবত শীত এলে তারা নদীর তলদেশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আবাবিল নিয়ে গ্রিক এমনকি রোমান পুরাকথাতেও বহু কাহিনি পাওয়া যায়।
পরিযায়ী আবাবিল
আবাবিল বা সোয়ালো পাখিটি ইউরোপে বার্ন সোয়ালো বা গোলাঘরের পাখি হিসেবেও পরিচিত। প্রজাতি অনুযায়ী এদের আচরণে পার্থক্য দেখা যায়। আবাবিলের অনেক প্রজাতিই গাছের কোটর, গোলাঘর, আস্তাবল ইত্যাদি জায়গায় বাসা বাঁধে। সাধারণভাবে এরা জলাভূমির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকার পাখিগুলো পরিযায়ী। শীত পড়লে এরা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে উষ্ণ অঞ্চলে আসে। তবে পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উষ্ণ অঞ্চলের আবাবিলরা জন্মস্থানেই কাটিয়ে দেয়।
শীতকালে বাংলাদেশে পরিযায়ী আবাবিল পাখির দেখা মিলে। খাল, হাওড়, জলাশয় কিংবা ফসলের খেতের ওপর উড়ন্ত অবস্থায় তাদের ছোট ছোট পোকা শিকার করতে দেখা যায়। প্রচলিত আছে এই পাখিরা নাকি কখনোই মাটিতে নেমে আসে না। উড়তে ভালোবাসলেও তারা যে কখনোই অবতরণ করে না এমন নয়। পরিযায়ী পাখিগুলো প্রতিবছরই শীত শেষে তাদের ঘরে ফিরে।
আবাবিল নিয়ে যত বিশ্বাস
বহু বছর ধরে আবাবিল পাখিকে বসন্তের আগমনের প্রতীক হিসেবে দেখেছে পশ্চিমারা। আবাবিলের আচরণ দেখে আবহাওয়া কেমন যাবে তা নির্ধারিত হতো। পাখিরা মাটি থেকে কাছাকাছি ওড়ার অর্থ বৃষ্টি হবে। তারা উঁচুতে উড়ছে মানে আবহাওয়া ভালো। অবশ্য বিষয়টি স্রেফ প্রচলিত বিশ্বাস নয়। নিম্নচাপ প্রায়ই খারাপ আবহাওয়া পূর্বাভাস দেয়। অন্যদিকে সেসময় পাখিদের জন্য উড়াও কঠিন হয়ে পড়ে।
এককালে ধারণা করা হতো আবাবিল পাখি মৃতদের আত্মা বহন করে। আর তাই ছেলে হারানো শোকার্ত মায়েরা পাখিটিকে পবিত্র মনে করত। আবাবিল পাখিকে হত্যাও অশুভ হিসেবে দেখা হতো। খ্রিস্টানরা এখনো পাখিটিকে আত্মত্যাগ, পুনর্জন্ম এবং নতুন সূচনার প্রতীক মনে করে। ইংল্যান্ডে শ্রমজীবী মানুষের প্রতীক হিসেবেও এই পাখির চিহ্ন ব্যবহার করা হতো।
নাবিকদের জন্য আবাবিল পাখির ট্যাটু বিশেষ অর্থ বহন করত। সাধারণত কোনো নাবিক ৫০০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি ভ্রমণ করার পর তাদের অভিজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে এই ট্যাটু অঙ্কন করত। দূরের যাত্রায় নাবিকদের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক ছিল আবাবিল। অনেক যোদ্ধা শক্তি ও দ্রুততার চিহ্ন হিসেবে হাতের আঙুলে সোয়ালোর ট্যাটু করাতেন।
গ্রিক পুরাণে আবাবিল
প্রাচীনকালে আবাবিলের সঙ্গে দেবতা এমনকি মৃত মানুষের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে বলে ভাবা হতো। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, আবাবিল ছিল প্রণয়ের দেবী আফ্রোদিতির আশীর্বাদপুষ্ট। আফ্রোদিতি একবার অলিম্পাস থেকে মর্ত্যে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। রাজহাঁসদের সাথে রথে চড়ে তিনি বের হন। কিন্তু যাত্রাপথে তুমুল ঝড়ের কবলে পড়েন আফ্রোদিতি। রথ ভেঙে দেবী পৃথিবীতে পতিত হন। আহত আফ্রোদিতি কাছাকাছি একটি আবাবিল পাখি দেখে তার কাছে সাহায্য চান। পাখিটি উড়ে গিয়ে তার জন্য মিষ্টি বেরি ফল নিয়ে আসে। পরদিন আরও তিনটি পাখি খাবার ও সাহায্য নিয়ে আসে। এভাবে যতদিন যায়, তার কাছে তত বেশি পাখি আসতে থাকে।
এক মাস পর রথ সারানো হয়ে যায়। আফ্রোদিতি ফিরে যাবে এমন সময় দেখা গেল তার হাঁসগুলো নেই। সেগুলো আগেই ঘরে ফিরে গেছে। এবার আবাবিলরাই দেবীকে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব রাখে। আফ্রোদিতি খুশি হয়ে বরদান দেয় যে এই ভূমি আবাবিলদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হবে। শয়ে শয়ে আবাবিল পাখি মিলে তাকে অলিম্পাস পর্বতে পৌঁছে দিয়ে আসে। অলিম্পাস ঘুরে প্রায় একবছর পর পাখিরা নিজেদের ঘরে ফিরে। সেই থেকে তারা ঠিক করে যে প্রতিবছর একবার হলেও যে স্থানে তারা আফ্রোদিতিকে সাহায্য করেছিল সেই স্থানে ফিরে আসবে।
বহু বছর পর মানুষ সেই জায়গায় এসে ঘরবাড়ি গড়ে তোলে, আবাদ শুরু করে। তারা অবাক হয়ে দেখে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে আবাবিল পাখিরা এখানে আসে।
আবাবিল শীতনিদ্রায় যায় বলে ভাবতেন অ্যারিস্টটল
আবাবিল পাখি নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই গ্রিকরা ভাবতে শুরু করেছিল। গভীরভাবে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করত তারা। সাধারণভাবে তারা ধারণা করেছিল শীত আসলে পাখিরা দূরে কোথাও চলে যায়। কিন্তু কোথায় যায়, সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। মিশরে যেহেতু পাখিগুলো সারাবছরই থাকত, তারা ধারণা করেছিল পাখিগুলো কোনো উষ্ণ অঞ্চলে যাচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় অ্যারিস্টটলকে নিয়ে। তিনি কাঠামোগত পদ্ধতিতে প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন। পাখিদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে হিস্টরিয়া অ্যানিমালিয়াম বইয়ে তিনি লিখেন, শীতকালে পালকহীন অবস্থায় কিছু পাখিকে গাছের কোটরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিষয়টি থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, উষ্ণ অঞ্চলের কাছাকাছি থাকা পাখিগুলো দেশান্তরী হয়। অন্যদিকে যেসব পাখি উষ্ণ অঞ্চল থেকে দূরে থাকে, তারা শীতকালে গাছের কোটরে বা এরকম জায়গায় আশ্রয় নিয়ে পুরো শীতকাল হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রায় কাটিয়ে দেয়।
শীতকাল চাঁদে কাটায় আবাবিল
১৬৮০ সালের দিকে ইংরেজি শিক্ষাবিদ চার্লস মর্টন দাবি করেন শীতকালে আবাবিল পাখি চাঁদে যায়।
শীতকালে আবাবিলদের দেখা যায় না, তা সকলেই জানত। কিন্তু সে সময় তারা কোথায় যায় এ বিষয়ে কারও কোনো ধারণা ছিল না। মর্টন পাখিদের অনেক অনুসন্ধান করেও খোঁজ না পেয়ে এই তত্ত্ব দেন। তিনি ধারণা করেন পাখিরা এমন জায়গায় যায় যেখানে তাদের খুঁজে পাওয়ার সাধ্য মানুষের নেই। এমন ধারণা থেকেই তিনি পাখিদের চাঁদে যাওয়ার তত্ত্ব দেন।
মর্টনের প্রায় ৭০ বছর আগেই গ্যালিলিও চাঁদে পাহাড় ও সমুদ্র খুঁজে পাওয়ার দাবি করেন। সম্ভবত তিনি ফ্রান্সিস গডউইনের ১৬৩৮ সালে প্রকাশিত 'দ্য ম্যান ইন দ্য মুন' উপন্যাসও পড়েছিলেন। উপন্যাসটিতে চাঁদে গিয়ে এক ব্যক্তি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দেখা পান।
মর্টনের হিসাব অনুযায়ী পাখিরা গড়ে ঘণ্টায় ১২৫ মাইল গতিতে দুই মাস ধরে উড়ার পর চাঁদে গিয়ে পৌঁছে। যাওয়ার পথে বাতাস তাদের পথে কোনো বাধার সৃষ্টি করে না। গ্রীষ্মকালে তারা শরীরে বাড়তি মেদ সঞ্চয় করে রাখে এবং চাঁদে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। সেখানে কেবল শীত পড়লেই তারা ঘুম থেকে জেগে উঠে।
নদীতে ঘুমায় আবাবিল
জল ভালোবাসে বলেই নদী ও হ্রদ ঘিরেও আবাবিলকে নিয়ে বিভিন্ন গল্প আছে। লোককথায় আছে আবাবিল পাখি হ্রদে রাত কাটায়। অনেকে নদীর তলদেশ থেকে পাখিকে উঠতে দেখেছেন বলেও দাবিও করেন।
স্যামুয়েল জনসন তো জোর দিয়েই বলেছিলেন, 'সোয়ালো নিশ্চিতভাবেই পুরো শীতকাল ঘুমিয়ে কাটায়…তবে তা নদীর তলদেশে'।
আবাবিল কীভাবে পরিভ্রমণ করে তা এখনো অজানা
১৯ শতকে গিয়ে অবশেষে আবাবিলের রহস্য উন্মোচিত হয়। ভারতে ব্রিটিশদের শাসন জোরদার হতে শুরু করে। ফলে এই অঞ্চলে অতিথি পাখি হিসেবে আসা আবাবিলদের দেখে তাদের পরিযায়ী আচরণ সম্পর্কে নিশ্চিত হন পাখি বিশারদরা।
১৮৬৪ সালে আলজারনন চার্লস সুইনবার্ন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানান যে, শীতকালে সোয়ালো উষ্ণতার খোঁজে দক্ষিণে পাড়ি দেয়।
তবে আবাবিল কীভাবে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় তা এখনো ধাঁধার মতোই। ধারণা করা হয় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সাহায্যে ম্যাগনেটোরিসেপশনের মাধ্যমে তারা গতিপথ চিনতে পারে।
তবে এই বিষয়েও বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। অনেকে ধারণা করেন তাদের চোখে বিশেষ স্নায়বিক ক্ষমতা আছে। আবার অনেকের মতে এর সঙ্গে শ্রবণ ক্ষমতাও সম্পর্কিত। কয়েক শত বছরের বিতর্কের পরেও আমরা বিস্তারিত কিছু জানি না। আর তাই এই পাখি নিয়ে শার্লট স্মিথের মতো আমরাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে পারি:
"হায়! আমরা কত কম জানি
প্রকৃতি রহস্যের ঘোমটায় তাকে ঢেকে রেখেছে
বিভ্রান্ত বিজ্ঞানকে একাই তার রহস্য বুঝতে দাও
সব নীতি সেই ঠিক করবে।"