ফিরে দেখা ২০২১: করোনার নতুন ত্রাস ‘ওমিক্রন’
২০২১ সালের শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বের অনেক দেশেই যখন ভ্যাকসিনের বণ্টন নিশ্চিতকরণ এবং কোভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে কার্যকরী নানা ধরনের চিকিৎসা উদ্ভাবনের ফলে করোনা নিয়ে জনমনে ভয়-ভীতি ও দুশ্চিন্তা তলানিতে গিয়ে ঠেকছিল, ঠিক তখনই নতুন উদ্যমে ত্রাস সঞ্চার করতে শুরু করেছে সার্স-কোভ-২ এর ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন।
২৭ ডিসেম্বর এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ওমিক্রনই করোনার সর্বশেষ, এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রামক, ভ্যারিয়েন্ট।
পূর্বে বি.১.১.৫২৯ নামে পরিচিত ওমিক্রনকে বর্তমানে গ্রিক বর্ণমালার ১৫তম বর্ণ অনুযায়ী নামকরণ করা হয়েছে। আলফা, বিটা, গামা ও ডেল্টার পর পঞ্চম ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে এটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা 'ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন' বা 'উদ্বেগজনক ধরন' হিসেবেও চিহ্নিত করেছে।
গবেষণাগারে ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হয় গত ২২ নভেম্বর; ১১ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত বতসোয়ানা ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সংগৃহীত নমুনার উপর ভিত্তি করে। অবশ্য পরে জানা গেছে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সমৃদ্ধ প্রথম নমুনা নাকি সংগৃহীত হয়েছিল সেই ৮ নভেম্বরই। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার তরফ থেকে ২৪ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ওমিক্রনের ব্যাপারে অবগত করা হয়, এবং মাত্র দুদিনের মাথায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটির ব্যাপারে 'রেড অ্যালার্ট' জারি করে।
গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ৮৯টি দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর শরীরে ওমিক্রনের অস্তিত্ব নিশ্চিত হওয়া গেছে। কেবল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশই ছিল ওমিক্রনের ছোবল থেকে মুক্ত। তবে ধারণা করা হচ্ছে, শনাক্ত হোক না না-হোক, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদই বিশ্বের প্রতিটি দেশে ওমিক্রন পৌঁছে গেছে।
আমাদের বাংলাদেশেও প্রথম ওমিক্রন ধরনে আক্রান্ত দুই রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় গত ১১ ডিসেম্বর। আক্রান্ত সেই দুই রোগীই ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সদস্য, যারা আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে সফর করে দেশে ফিরে আইসোলেশনে ছিলেন।
তবে এরও সপ্তাহ দুয়েক আগে, ২৮ নভেম্বর, যে দেশগুলোতে ওমিক্রনের সংক্রমণ হয়েছে সে দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে যাত্রা প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরামর্শ দিয়েছিল কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সরকারের কারিগরি কমিটি।
শুধু বাংলাদেশই নয়, ওমিক্রনের খবর চাউর হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশই আফ্রিকার দেশগুলোর উপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করতে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববাসীকে ওমিক্রনের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে এভাবে 'একঘরে' করে দেওয়া কতটুকু নীতিসম্মত, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনারও ঝড় ওঠে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ওমিক্রনের ভয়াবহতা দৃশ্যমান না হলেও, ইতোমধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। সেজন্য গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানায় রাত্রিকালীন কারফিউও জারি করা হয়েছে।
গত ৩০ অক্টোবর থেকেই বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার ১ শতাংশের আশেপাশে থাকলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টকে বাংলাদেশিদের হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা করোনার আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর ঢেউও বাংলাদেশে আছড়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের বেশ কয়েক মাস পরে। তাই ওমিক্রন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ভয়ের কারণ হয়ে না দাঁড়ালেও, ভবিষ্যতের ব্যাপারে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।
ওমিক্রনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকারও সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ডিসেম্বরের শুরুর দিকেই সরকার ওমিক্রন-নিশ্চিত বা স্থানীয় সংক্রমণ থাকা দেশগুলো থেকে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বর্তমানে বিমানবন্দরে প্রত্যেক যাত্রীকে সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করা হচ্ছে, এবং ওমিক্রনের উপস্থিতি থাকা দেশগুলো থেকে আগত যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হচ্ছে। হাসপাতালগুলোকেও ওমিক্রন মোকাবেলার জন্য তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিদের বুস্টার ডোজ প্রদানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
ওমিক্রন নিয়ে সতর্কতার বাড়াবাড়ির কারণ, এটি করোনার পূর্ববর্তী ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক। ফুসফুসের ব্রংকাইতেও এটি আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে প্রায় ৭০ গুণ বেশি গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত ওমিক্রন যে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি, সেটি এজন্য যে এই ভ্যারিয়েন্টটির ফুসফুস টিস্যুর গভীরে প্রবেশের ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম।
তারপরও ওমিক্রন উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট, কেননা এর ফলে রোগীরা চূড়ান্ত রকমের অসুস্থ হয়ে মারা না গেলেও, এটি ডাবল ভ্যাকসিনেশন এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তোয়াক্কা না করেই মানুষকে সংক্রামিত করছে, যার ফলে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে, এবং কোভিড-১৯ সহ অন্য সকল রোগের জন্য রোগীদের যথাসময়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করাও চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গবেষকরা এখনও জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলোর ওমিক্রন ধরনের উপর কার্যকারিতা ঠিক কতটুকু। এ ব্যাপারে প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাণ যদিও এখন অবধি সীমিত, তবে এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে দুই ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করা ব্যক্তিদের ওমিক্রনের কারণে চরম অসুস্থ হওয়া বা মৃত্যুর আশঙ্কা কিছুটা হলেও কম। বুস্টার ডোজ নিলে আরও খানিকটা নিশ্চিন্ত থাকা যাবে বলেও অভিমত অনেকের।
এছাড়া ওমিক্রনের প্রকোপ থেকে রেহাই পেতে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রথমত, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পরা ও স্যানিটাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি দৈনিক ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার খাওয়া, শরীরচর্চা করা কিংবা জগিং ও হাঁটাও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে কিছুটা হলেও কাজে দেবে।
২০২০ সালের শেষদিকে ভারতে শনাক্ত হওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ২০২১ সালের একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশও নিস্তার পায়নি। জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে নতুন করে কঠোর লকডাউনের কবলে পড়ে দেশ, যা শিথিল হয় আগস্টের শুরুর দিকে। এ সময়ের মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রচুর বাংলাদেশির মৃত্যুও ঘটে। ওমিক্রনও আগামী মাসগুলোতে বাংলাদেশকে একই ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাবে কি না, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।