হ্যাম রেডিও: শব্দ ও ছবি ধরার রুদ্ধশ্বাস খেলা!
অ্যামেচার রেডিও পরিচিত হ্যাম রেডিও নামেও । উইকিপিডিয়া এর বাংলা করেছে,সৌখিন রেডিও যোগাযোগ। বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে সংবাদ আদান-প্রদান করা হয় এর মাধ্যমে। ব্যক্তিগত আনন্দ-বিনোদনের মধ্যেই পড়ে বিষয়টি, যেকারণে রেডিওস্পোর্ট শব্দের উদ্ভব। এটি শখের আর মজার ব্যাপার। তবে এর বিশেষ ব্যবহার দেখা যায় দুর্যোগ কালে। তখন এটি জীবনদায়ী।
নিয়মকানুন তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) অ্যামেচার রেডিও সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্যে অ্যামেচার স্যাটেলাইট সার্ভিসও অন্তর্ভুক্ত। নির্দিষ্ট দেশের সরকারী কর্তৃপক্ষ (আমাদের দেশে যেমন বিটিআরসি) তথ্য বিনিময়ের কারিগরী ও প্রায়োগিক নিয়মাবলি নির্ধারণ করে এবং প্রতি ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট কলসাইন দিয়ে লাইসেন্স দেয়। লাইসেন্স পাওয়ার জন্য একজন সৌখিন অপারেটরকে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় যেখানে রেডিও চালনায় তাঁর পারদর্শিতা প্রমাণ করতে হয়।
হ্যাম রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি সুনির্দিষ্ট তবে সুবিধা হলো এর মাধ্যমে পৃথিবীজুড়েই অন্য সব লাইসেন্সধারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। তা টেক্সট, ভয়েস, ছবি এবং ডাটা দিয়েও। যোগাযোগ স্থাপন করা যায় মহাশূণ্যেও। একে বলে অ্যামেচার রেডিও ব্যান্ড। অ্যামেচার রেডিও পরিচালনা ও সমন্বয় করে থাকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যামেচার রেডিও ইউনিয়ন। ২০১১ সালের এক জরীপে দেখা গেছে সারা বিশ্বে কমপক্ষে ৩০ লাখ লোক অ্যামেচার রেডিওর সঙ্গে যুক্ত। আমেরিকা এবং জাপানে অপারেটরর সংখ্যা বেশি আর ইউরোপের চেয়ে বেশি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায়।
হ্যাম কী, কেন, কীভাবে
ডিজিটাল পদ্ধতিতে এখন কাজ করা গেলেও মূলতেই অ্যানালগ পদ্ধতিতে কাজ করে হ্যাম রেডিও। আদি কমিউনিকেশন সিস্টেম। হ্যাম রেডিও ওয়াকিটকির মতোই। আমাদের দেশেই এমনটাই প্রচলিত। একজন অপারেটর ফ্রিকোয়েন্সি পাঠায় বায়ুমণ্ডলে, সেখান থেকে দূরবর্তী স্টেশন বা অপারেটর তা সংগ্রহ করে। মোবাইল ফোন কাজ করে অপারেটর টু অপারেটর। হ্যাম রেডিও কাজ করে স্টেশন টু স্টেশন। দুর্যোগকালে যখন বিদ্যুৎ থাকে না কিংবা মোবাইল টাওয়ার ভেঙে পড়ে তখন হ্যাম অপারেটররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। হ্যাম অপারেটরদের হ্যান্ডসেট যেমন থাকে আবার অনেকের কাছে থাকে বেইজ স্টেশন। হ্যান্ডসেট দিয়ে সাধারণত ৩-৫ কিলোমিটারের মধ্যে যোগাযোগ করা যায়। তবে যদি আবহাওয়া ভালো থাকে এবং কোনো বড় বাধা না থাকে (মানে লাইন অব সাইট যদি ফ্রি থাকে) তবে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত যোগাযোগ গড়ে তোলা যায়। যেমন সাগরে নৌকা থেকে নৌকা। আবার বেইজ স্টেশন থেকে দেশ-বিদেশে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ হয়। একজন অপারেটরের স্বপ্ন থাকে একটি বেইজ স্টেশন স্থাপনের। কিন্তু এটি অনেক ব্যয়বহুল।
অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অনুপ ভৌমিক জানালেন, বেইজস্টেশনে বড় আকারের বেইজ রেডিও, বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির অ্যান্টেনা (আল্ট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সি, ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি ইত্যাদি), অ্যান্টেনা টিউনার, ক্যাবলস ইত্যাদি থাকে। এগুলোর বেশিরভাগই হ্যামাররা নিজেরা পছন্দমতো তৈরি করে থাকেন। বাংলাদেশে মোট লাইসেন্সধারী আছেন ৬০০ এবং বেইজস্টেশনধারী আছেন প্রায় ৫০জন।
হ্যাম অপারেটর হতে আগ্রহী (২য় বীচ রেডিও ক্যাম্প ২০২১ এ অংশগ্রহণকারী) আতাউর রহমান খান রীপন বললেন, এটি একটি শখ। একজন অপারেটর রেডিও সেট করা, অ্যান্টেনার ডিরেকশন ঠিক করা, অ্যান্টেনা টিউন করা ইত্যাদি চর্চা করে চলেন। বলা চলে, শব্দ ধরার খেলা এটি। অনেকসময়ই শব্দ ভালো পাওয়া যায় না আর তখনই অপারেটর টার্গেট নেন শব্দ ভালো করার। ক্যাম্পগুলোতে ওসবই প্রাকটিস করানো হয়। তবে কেউ কেউ নিজে নিজেও সিলেবাস দেখে, চর্চা করে বিটিআরসিতে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারেন। অপারেটরদের জন্য নীতিমালাও নির্ধারিত—ফ্রিকোয়েন্সি ব্রেক না করা একটি বিশেষ নীতিমালা। যেমন নিরাপত্তাবাহিনীর জন্যও ফ্রিকোয়েন্সি নির্ধারিত আছে, শখের অপারেটরের তাতে প্রবেশ করা কিন্তু নীতিমালা লংঘন। উল্লেখ্য দূতাবাস বা জাদুঘর এমনকি গাড়িতেও ব্ড় বড় অ্যান্টেনা দেখবেন। একই রকম অ্যানালগ কমিউনিকেশন সিস্টেম এটি। তারাও দুর্যোগকালের জন্য এমন প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।
সৌখিন ও অন্য রেডির ফারাক
রেডিও বলতে আমরা বাংলাদেশ বেতার, বিবিসি, আকাশবাণী ইত্যাদিই বুঝি বেশি। এগুলো এএম বা এফএম রেডিও। আমাদের দেশে দুই দশক ধরে প্রাইভেট এফএম রেডিও হয়েছে অনেক। অধুনা যোগ হয়েছে কমিউনিটি রেডিও। এগুলোকে কমন রেডিও বলা হয়। এছাড়া পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের কাছে থাকে সেফটি রেডিও। অ্যামেচার হলো টু ওয়ে রেডিও। কমন রেডিও সাধারণত ওয়ান ওয়ে হয়ে থাকে। এগুলোতে নির্দিষ্ট স্টেশন থেকে ভয়েস প্রচার করা হয় আর এগুলো বাণিজ্যিক যেমন অলাভজনকও হতে পারে। কমন রেডিওর কাজের পরিসর বাড়াতে অনুমতি দরকার হয় আর হ্যাম রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি দীর্ঘ হয় বলে পৃথিবীজুড়েই যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারে। উল্লেখ্য এএম বড় করে হয় এমপ্লিটিউট মডুলেশন। পরীক্ষামূলকভাবে এএম ট্রান্সমিশন শুরু হয় ১৯০০ সালে। তবে এটি জনপ্রিয় হতে সময় নেয় ১৯২০ সাল পর্যন্ত। পরের ত্রিশ বছর ধরে এএম রেডিও যোগাযোগের ক্ষেত্রে দোর্দন্ড প্রতাপ বজায় রেখেছিল। তারপর পঞ্চাশের দশকে টেলিভিশন এলে এর দাপট কিছু কমে। এফএম রেডিও আসার পর এর দাপট আরো কমে যায়। তবে বলা যায়, হ্যাম রেডিওর আভিজাত্য দিনে দিনেই বেড়েছে।
হ্যামের ইতিহাস
অ্যামেচার বা হ্যাম রেডিওর বয়স একশোর কম হবে না। তবে ঠাট্টামূলক শব্দ ছিল হ্যাম উনিশ শতকে। যারা মোর্স কোডে (উইলিয়াম মোর্সের নাম থেকে এসেছে, টেলিগ্রাফ আবিস্কারকদের একজন তিনি, ডট,ড্যাশ ইত্যাদি দিয়ে তিনি মোর্স কোড তৈরি করেছিলেন) দুর্বল ছিল তাদের বলা হতো হ্যাম। রেডিও আবিস্কারের পরেও হ্যাম শব্দটি চালু ছিল। হ্যাম মানে দাঁড়ায় সৌখিন বা অদক্ষ। পরের দিকে অ্যামেচার রেডিও কমিউনিটি হ্যাম শব্দটিকে আনন্দের সঙ্গে বেশি বেশি ব্যবহার করতে থাকে এবং ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটি ঠাট্টা-বিদ্রুপ থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। হ্যাম রেডিও অপারেটর কিন্তু চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও কোনো কোনো ছবিতে। ২০১৩ সালে এবিসি টেলিভিশনের লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিংয়ে যার মাইক বেক্সটার চরিত্রটি করেছেন টিম অ্যালেন ছিলেন একজন হ্যাম অপারেটর।
বিখ্যাত হ্যাম অপারেটর
১৯৬১ সালে প্রথম মহাশূণ্যে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন ইউরি গ্যাগারিন। তিনি বিখ্যাত হ্যাম অপারেটরদের তালিকায় ওপরের দিকে আছেন। তারপর আছেন স্কটল্যান্ডের লে হ্যামিল্টন। তিনিই প্রথম ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ড (দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে আটলান্টিক মহাসাগরে ব্রিটেনের অধীনস্ত দ্বীপসমষ্টি) দ্বীপ দখল করেছে। তখন ব্রিটেনে একমাত্র তিনিই দ্বীপবাসীদের সঙ্গে রেডিও দিয়ে যুক্ত ছিলেন। তারপর জন স্কালির নাম আসে। তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন পেপসিকোর প্রেসিডেন্ট আর অ্যাপলের সিইও হয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে। তারপর বলা দরকার কাবুস বিন সাইদ আল সাইদের নাম। তিনি ওমানের সুলতান ছিলেন। তিনি হ্যাম রেডিও চালাতে ভালোবাসতেন। হুয়ান কার্লোসের কথা বলা হয় তার পরেই। ২০১৪ সালে হুয়ান কার্লোস স্পেনের রাজার পদ ত্যাগ করেন। অবশ্য তিনি রাজত্ব করেছেন প্রায় চল্লিশ বছর। তাঁর কলসাইন হচ্ছে ইএজিরোজেসি। গডফাদার ছবির মার্লোন ব্রান্ডো বেশিরভাগেরই চেনা। ব্রান্ডোও একজন লাইসেন্সধারী হ্যাম অপারেটর।
হ্যামিল্টন যেভাবে খবর পেয়েছিলেন
১৯৮২ সালের এপ্রিল মাস। মার্গারেট থ্যাচার তখন ব্রিটেনে গদীনসীন। আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আইরেসে তখন উৎসব চলছে। স্বৈরশাসক জেনারেল গ্যালটিয়েরি ঘোষণা দিলেন, অবশেষে আর্জেন্টিনার মানুষের আকাঙ্খা পূরণ হয়েছে। রেক্স হান্ট ছিলেন ফকল্যান্ডের গভর্নর। তিনি রেডিও মারফত লন্ডনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। কারণ আর্জেন্টাইরা ফোন ও রেডিও নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিল। হ্যামিল্টন ১৫ বছর বয়স থেকেই হ্যাম রেডিও সঙ্গে রাখেন। ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে বসে চেষ্টা করেন অন্য অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে অথবা ভাঙা ভাঙা খবর জোড়া দিতে। পশ্চিম ফকল্যান্ডের টোনি পোল ইভানস তাঁর একজন হ্যাম বন্ধু। গুজ গ্রিনে থাকেন তাঁর আরেক বন্ধু বব ম্যাকলিয়ড। ' ১০ বছর হয় আমি টনির সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কথা বলি, ২ এপ্রিল আসার আগে থেকেই টনি বলছিল, কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে ফকল্যান্ডে। আর তার পর পরই ম্যাকলিয়ড জানালো, স্ট্যানলির গভর্নর হাউজে আর্জেন্টিনার পতাকা উড়ছে।'
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে খবরটি পৌছালেন হ্যামিল্টন। তাঁরা অনুরোধ করল যেন হ্যামিল্টন ফকল্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। টোনির সঙ্গে কথা বলে বলে হ্যামিল্টন সেনাবাহিনীকে বম্ব রেইডের কথা জানালো। আরো জানালো, কোথায় মাইন পোতা হয়েছে আর কোথায় আর্জেন্টাইন সৈন্য রাখা হয়েছে। 'আমরা তখনও কিন্তু একাজের এতো গুরুত্বের কথা বুঝতে পারিনি, ব্রিটিশ ইন্টিলিজেন্স বলেছিল এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর মার্গারেট থ্যাচারও চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।' বলছিলেন হ্যামিল্টন।
একজন দারুণ দেশী অপারেটর
২০০৮ সালে লাইসেন্স পেয়েছেন সৈয়দ শামসুল আলম তুহীন। তাঁর বয়স ৪৭। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কোভিড সাপোর্ট টিমে কাজ করেন। ইলেক্ট্রনিক্সে তাঁর আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই । রেডিও শুনতেন ঘণ্টা ঘণ্টা, সার্কিট দেখতেন, টিভি – ভিসিআরের মাদারবোর্ড দেখতেন ইত্যাদি। অডিও ক্যাসেটের প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল অনেক। তারপর ২০০২ সালে হ্যাম রেডিওর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। সরকারী বিজ্ঞাপন দেখেই তিনি হ্যাম অপাররেটর হওয়ার পরীক্ষায় বসেন এবং পাশ করে লাইসেন্স পান। দিল্লীতে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তাঁর হ্যাম প্রথম বিদেশে যুক্ত হয়। ততদিনে অবশ্য ২০১০ সাল পেরিয়ে গেছে। তারপর ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ২০১৫ সালের নেপাল ভূমিকম্পের খবর তিনি আর আলফা রোমিও নামের আরেক অপারেটর প্রথম জানতে পারেন বাংলাদেশে। তারপর তারা খবরটি রিলে (ছড়িয়ে দেওয়া) করতে থাকেন। বললেন, আসলে একজন অপারেটর সিগন্যাল আদান-প্রদান করেন মানে ধরুন একজন বললেন নেপালে ভূমিকম্প হচ্ছে, আরেকজন তা শুনতে পাচ্ছেন না কিন্তু আমি ঠিক ঠিক শুনতে পাচ্ছি, তখন আমি বললাম ব্রেক ব্রেক.. নেপালে ভূমিকম্প হচ্ছে, এতে যে শুনতে পাচ্ছিল না সে হয়তো আমাকে শুনতে পেল। আসলেই এ শখের দাম লাখ টাকা। আমি হাই ফ্রিকোয়েন্সির হ্যাম চালাই। আমার দুটি অ্যান্টেনা বসাতে হয়েছে ছাদে। সেগুলো পুরনো টেলিভিশন অ্যান্টেনার মতোই। যাদের নিজেদের বাড়ি নেই তারা এটা সহজে পারবেন না। আমি ভাড়া নেওয়ার আগেই যেমন মালিকের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। আবার যারা ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সির হ্যাম চালায় তাঁদের অনেক বেশি অ্যান্টেনা লাগতে পারে। সাধারণ একটি হ্যাম রেডিওর দাম ১৫-২০ হাজার টাকা। কিছুটা ভালো রেডিওর দাম লাখ টাকাও ছাড়ায়। তবে আমাদের দেশের হ্যাম পরিস্থিতি অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এখন অবশ্য আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে, আশাকরি সামনে ভালো দিন আসবে।'
বাংলাদেশ হ্যাম চিত্র
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) অ্যামেচার রেডিওর কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। সে স্থগিতাদেশ উঠতে দেশ স্বাধীন হতে হলো। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও লীগ। তবে হ্যাম রেডিও ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। একানব্বই সালে দেশ বড়সড় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়লে তখনকার সরকার হ্যাম রেডিওর গুরুত্ব বেশি করে বুঝতে পারে। অনেক নিয়মকানুন বেঁধে দিয়ে একানব্বইয়ের ২৯ আগস্ট হ্যাম রেডিও স্বীকৃতি লাভ করে। পরে ২০০৪ সালে আবার লাইসেন্স দেওয়া স্থগিত করা হয়। আর অনেক দেনদরবার শেষে ২০০৮ সালে সে স্থগতিতাদেশ তুলে নেওয়া হয়। এছাড়া আছে বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও ক্লাব। আরো আছে অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি অব বাংলাদেশ (এআরএসবি)। সংগঠনটি ২৫ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারে আয়োজন করেছে হ্যাম রেডিও ক্যাম্প। এ উপলক্ষে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কথা হয় অনুপ কুমার ভৌমিক (S21TV), সাধারণ সম্পাদক, অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি অফ বাংলাদেশ এর সঙ্গে।
২০১৮ সালে তাদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠা। দেশের অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের নিয়ে এ সংগঠন গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, 'আমরা মূলত অপেশাদার রেডিও বা শখের রেডিও অপারেটর। শখের রেডিও গবেষণা এবং চর্চার মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন অ্যামেচার রেডিও স্টেশনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে থাকি। স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন আমাদের একটি মজার কার্যক্রম। হাতে রেডিও নিয়ে এন্টেনা সরঞ্জামাদি তৈরি করা আর তা দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করা একজন রেডিও অপারেটরের দক্ষতার পরিচায়ক। পাশাপাশি দুর্যোগের সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরার মুহূর্তগুলোতে আমরা সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারকে রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনে সহযোগিতা দিয়ে থাকি। এআরএসবি'র সদস্যরা নিজেদের ভেতর এবং বহির্বিশ্বে লাইসেন্সধারী অপারেটরদের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ চালিয়ে যায়। এছাড়া দেশের নতুন আগ্রহী অপারেটরদের সঙ্গে নিয়ে অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্প আয়োজন করে।'
ক্যাম্প নিয়ে বলুন।
শুরু হয়েছিল ২৫ ডিসেম্বর। ৩০ ডিসেম্বর শেষ হলো ২য় বীচ রেডিও ক্যাম্প ২০২১। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হয়েছে এআরএসবি'র এ আয়োজন। সংগঠনের সদস্য ছাড়াও নতুন ১৬ জন এতে অংশ নিয়েছেন। ক্যাম্পে অ্যামেচার রেডিও চর্চার ব্যবহারিক ও কারিগরি বিভিন্ন দিক দেখানো হয়েছে। দুর্যোগকালে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনে নানান কৌশলের মহড়া ও অনুশীলনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্প থেকে এশিয়া মহাদেশের ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, ইউরোপের রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, স্পেন এবং মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোয় যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছে। স্যাটেলাইট থেকে ডাটা নিয়ে এসে তা প্রসেস করে আমরা স্থানীয় আবহাওয়ার ছবি দেখেছি। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে এস এস টিভি ( স্লো স্ক্যান টেলিভিশান) রেডিও সংকেত গ্রহণ করে কথা বলতে পারা যায় নভোচারীদের সঙ্গে। প্রেরিত ওই সংকেত ডিকোড করে ছবিতে রুপান্তর করার উপায়ও শিখল অংশগ্রহণকারীরা। একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার উপায় নিয়েও আমরা পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি।
মূলত নতুন প্রজন্মের রেডিও অপারেটরদের দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি দেশ ও জাতির জন্য একটি মাদকমুক্ত যুবসমাজ তৈরির লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছে এআরএসবি । আমাদের এবারের মূল প্রতিপাদ্য, রেডিও অপারেটর হওয়া ও তার চর্চার মাধ্যমে কীভাবে একজন সুনাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠা যায়।
হ্যাম অপারেটরদের বিশ্ব পরিস্থিতি বলুন।
সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ লক্ষ উপর লাইসেন্সধারী অ্যামেচার রেডিও অপারেটর আছেন। অ্যামেচার রেডিও মূলত একটি সৌখিন চর্চা। এর জন্য বিশ্বব্যপী কিছু প্রক্রিয়া ও নিয়ম-কানুন আছে। বাংলাদেশে যেমন ন্যূনতম ১৮ বছর বয়সী হতে হবে এবং কমপক্ষে এসএসসি উত্তীর্ণ হতে হবে। বিটিআরসিতে আবেদন পূর্বক পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হলেই লাইসেন্স এর জন্য আবেদন করা যায়। লাইসেন্স অর্জনের পরেই মিলে কল সাইন। কল সাইন বিশ্বব্যাপী একজন অপারেটরের একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি, আমার কল সাইন যেমন S21TV।
যে দেশে অ্যামেচার রেডিও অপারেটরের সংখ্যা যত বেশি, সেই দেশ তত উন্নত। সেই লক্ষ্যে এআরএসবি কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যারা আগ্রহী আছেন তাদের জন্য আমাদের সহযোগীতার দ্বার উন্মুক্ত। সকলের আন্তরিক সহযোগিতা এবং সম্মিলিত চর্চায় বাংলাদেশও অন্য অনেক দেশের মতো এগিয়ে যাবে বলেই আশাবাদী আমরা ।