ইউনিকর্ন নিয়ে অজানা যত রহস্য!
ইউনিকর্ন কথাটি শুনলেই বেশিরভাগ মানুষের কল্পনায় ভেসে ওঠে, পৌরাণিক মধ্যযুগীয় শিংওয়ালা এক ঘোড়ার ছবি। চীনাদের বিশ্বাস, ইউনিকর্ন সম্পদ ও সমৃদ্ধির বাহক। পৌরাণিক কাহিনি ব্যতিরেখেও, আমাদের অনেকের মধ্যেই যে ইউনিকর্নের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ কাজ করে তা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। বাস্তবে কি এর অস্তিত্ব ছিল? নাকি কেবল কল্পকাহিনির মধ্যেই এর অস্তিত্ব সীমাবদ্ধ?
ইউনিকর্ন প্রাণীটি বাস্তবেই ছিল; কিন্তু যেভাবে কল্পকাহিনি বা পৌরাণিক ইতিহাসে এটিকে বর্ণনা করা হয়েছে, ঠিক সেভাবে নয়। এ বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরে চলেছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা। আর সেই গবেষণা আমাদেরকে 'ইলাসমোথেরিয়াম সিবিরিকাম' (সাইবেরিয়ান ইউনিকর্ন নামেও পরিচিত) সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে সাহায্য করেছে।
ইউনিকর্নের উৎপত্তির ইতিহাস
ই. সিবিরিকাম গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষের মধ্যে রয়েছে আজকের গণ্ডার প্রজাতিও। ইউনিকর্নের মাথার খুলির বিশ্লেষণে শিং পাওয়া না গেলেও, সেখানে একটি বিশাল খাদ দেখা যায় যেখানে একটি শিং থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একটি প্রাপ্তবয়স্ক গণ্ডারের ওজন সাধারণত ১,৫০০ থেকে ৩,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু সাইবেরিয়ান ইউনিকর্ন ছিল এরচেয়েও বৃহদাকৃতির। এমনকি এই প্রাণী গণ্ডারের আকারের দ্বিগুণ হতে পারে বলেও ধারণা করা হয়।
গণ্ডার চারণ প্রাণী হওয়ায় ধীর গতিতে চলে। এছাড়া, এদের সাইবেরিয়ান পূর্বপুরুষদের কাঁধে ছিল কুঁজ, যা থেকে ধারণা করা হয় এরা খোলা জায়গায় দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতো। সাইবেরিয়ায় পাওয়া জীবাশ্মের ওপর ভিত্তি করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, সাড়ে তিন লাখ বছর আগেই বিলুপ্তি ঘটেছে ই. সিবিরিকাম (ইউনিকর্নের বৈজ্ঞানিক নাম) প্রজাতির।
সাম্প্রতিক প্রমাণ
'নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশনে' প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, প্রায় ৩৫ হাজার বছর আগে পর্যন্ত বেঁচে ছিল ই. সিবিরিকাম। এটি নিশ্চিত করেছেন গবেষকরা। তাদের ধারণা, ইউনিকর্ন নিয়ান্ডারথাল এবং মনুষ্যজাতি আসার সময়কালেও বসবাস করত। গবেষকরা ইউনিকর্ন নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা আজ আমরা ইউনিকর্নের যেসব কল্পকাহিনির সঙ্গে পরিচিত সে সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে।
২০১৮ সালে বিজ্ঞানীরা ইউনিকর্ন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ২৩টি জীবাশ্ম পরীক্ষা করেছিলেন। সেই গবেষণায় বলা হয়, আজ থেকে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন বছর আগে অর্থাৎ, ইওসিন যুগ থেকেই আধুনিক গণ্ডার প্রজাতি থেকে জেনেটিক্যালি আলাদা হয়ে যায় ইউনিকর্ন। এ যুগে অনেক আধুনিক ও ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল। মূলত এ সময় থেকেই মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর হতে শুরু করে।
তবে একটি বিষয় এখনও অস্পষ্টই রয়ে গেছে। সাইবেরিয়ান ইউনিকর্নের বিলুপ্তির পিছনে সুনির্দিষ্ট কারণটি আসলে কি ছিল, তা জানা যায়নি এখনও। গবেষকদের ধারণা, মানুষের দ্বারা অতিরিক্ত শিকার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইউনিকর্নের বিলুপ্তি ঘটতে পারে। এছাড়া গবেষণায় উঠে এসেছে, ইউনিকর্ন কেবল ঘাস খেয়েই জীবন ধারণ করত; ঘাসই ছিল এই প্রাণীর ক্যালোরির একমাত্র উৎস। কিন্তু অতিরিক্ত শীতে ঘাসের অভাবের কারণেও ধীরে ধীরে ইউনিকর্নের বিলুপ্তি ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করেন গবেষকরা।
প্রায় ৪৩ মিলিয়ন বছর আগে বিবর্তনের ধারায় ইওসিন যুগে ই. সিবিরিকাম আধুনিক গণ্ডার থেকে আলাদা হয়ে যায়। গবেষণাগুলো ধারণা দেয়, ইউনিকর্ন ছিল আধুনিক গণ্ডারের একটি ক্রোনোসপিসিস। বিবর্তনের দীর্ঘ সময়ে ক্রোনোস্পেসিসগুলো সামান্য পরিবর্তিত হয়ে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে পরিণত হয়।
সাইবেরিয়ান ইউনিকর্নের বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ হয়তো তখন ছিলনা; আর এটিই হয়ত প্রাণীটিকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে গিয়েছিল। এই প্রক্রিয়াটি ঘটে যখন পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে কোনো প্রজাতি বিবর্তিত বেঁচে থাকে; যেমনটি ঘটেছে আজকের আধুনিক গণ্ডার প্রজাতির ক্ষেত্রে।
- সূত্র: ডিস্কভার ম্যাগাজিন