যে ৬ কারণে বেকায়দায় আছে জাকারবার্গের মেটা
সম্প্রতি নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দরপতন দেখেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোম্পানি মেটা। ব্যক্তিগত সম্পদ কমেছে প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গেরও।
গত বৃহস্পতিবার মেটার স্টক বাজার মূল্যে এক আকস্মিক ধস নামে। একদিনেই ২৩ হাজার কোটি ডলার হারায় জাকারবার্গের কোম্পানি। মোট স্টকের ২৬ শতাংশই উবে যায়।
পূর্বে ফেসবুক নামে পরিচিত মেটার এই আকস্মিক দরপতনের আগে, গত বুধবার জাকারবার্গ জানান, সামাজিক যোগাযোগ থেকে কথিত মেটাভার্সে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতায় ভুগছে কোম্পানিটি। এরপর বৃহস্পতিবার মেটার এক মুখপাত্র তাদের বিগত বছরের আয়ের অঙ্ক জানান। এবং এ ব্যাপারে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন সামনে মেটার রাস্তা আরও বন্ধুর হতে চলেছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম কোম্পানি, মেটা কেন এতো অস্বস্তিতে আছে, তার ছয়টি কারণ তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে-
সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে ব্যবহারকারীর সংখ্যা
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এতদিন ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা শুধু বেড়েছেই। ফেসবুকের স্টকে মানুষের বিনিয়োগ করার অন্যতম একটি কারণ এটি। তবে অবশেষে ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা সিলিংয়ে গিয়ে ঠেকেছে।
যদিও বুধবার জাকারবার্গ জানিয়েছেন, তার তথাকথিত অ্যাপ পরিবারে (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ) নতুন ব্যবহারকারী সংখ্যা এখনও সামান্য বর্ধমান। কিন্তু মূল অ্যাপ 'ফেসবুক' গত বছরের শেষ তিন মাসে পাঁচ লাখ ব্যবহারকারী হারিয়েছে।
কোম্পানিটির ১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘটেছে এমন ঘটনা। মূলত নতুন ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতাই ফেসবুককে এতো শক্তিশালী করেছে। নেটিজেনদের মাঝে ফেসবুকের এই জনপ্রিয়তা হ্রাস তাই স্বাভাবিকভাবেই জাকারবার্গের কপালে ভাঁজ ফেলছে।
মেটা অবশ্য জানিয়েছে, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে তারা। এই মেসেজিং পরিষেবা থেকে এখনও তেমন আয় করতে পারেনি কোম্পানিটি। তবে আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টাও এখন মাত্র প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
এদিকে, ফেসবুকের মতো ইন্সটাগ্রামের ব্যবহারকারীর সংখ্যা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কিত বিনিয়োগকারী। সেই শঙ্কা বাস্তবে পরিণত হলে আরও বিনিয়োগ হারাবে মেটা।
অ্যাপলের পরিবর্তন ধস নামাচ্ছে মেটার ব্যবসায়
গত বছর আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমে 'অ্যাপ ট্র্যাকিং ট্রান্সপারেন্সি' চালু করে অ্যাপল। এর মাধ্যমে আইফোন ব্যবহারকারীরা দেখতে পারেন কোন অ্যাপ তাদের অনলাইন কার্যক্রমে নজরদারি চালাচ্ছে। এবং ফেসবুকের মতো অ্যাপগুলোর ক্ষেত্রে এই নজরদারি বন্ধও করে দিতে পারেন ব্যবহারকারীরা। গোপনীয়তা রক্ষার এই নীতি মেটার ব্যবসাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং সামনেও করবে।
ব্যবহারকারীদের উপর নজরদারি চালিয়ে তাদের আচরণ ট্র্যাক করা এবং তা ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দেওয়াই ফেসবুকের মূল ব্যবসায়িক মডেল। এখন প্রাথমিক তথ্য যোগাড় (বা চুরি) করাটাই যেহেতু ব্যবহারকারীদের অনুমতির ওপর নির্ভর করছে, এবং অনেক ব্যবহারকারীই অনুমতি দিচ্ছেন না, অ্যাপলের ডিভাইস থেকে ফেসবুকের আয় করাটা তাই কঠিনই হয়ে পড়েছে।
পূর্বের রেকর্ড বলছে, আইফোন ব্যবহারকারীরা অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের তুলনায় ফেসবুকের বিজ্ঞাপনে বেশি প্রভাবিত হন ও সে অনুযায়ী খরচ করেন। অর্থাৎ আইফোন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি আয় করত ফেসবুক।
বুধবার মেটার পক্ষ থেকে বলা হয়, অ্যাপলের এই গোপনীয়তা নীতির জন্য সামনের এক বছরে এক হাজার কোটি ডলার রাজস্ব হারাবে তারা।
অনলাইন বিজ্ঞাপনের দখল নিয়ে নিচ্ছে গুগল
ফেসবুকের দুর্ভাগ্য থেকে এখন সুবিধা লুটছে এর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো।
বুধবার মেটার প্রধান অর্থবিষয়ক কর্মকর্তা ডেভিড ওয়েনার জানান, অ্যাপলের নীতি পরিবর্তনের জন্য বিজ্ঞাপনদাতা হারাচ্ছে ফেসবুক। অনেকেই এখন ফেসবুকের বদলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন গুগলের মতো প্লাটফর্মগুলোতে।
এ সপ্তাহেই আবার গুগল জানিয়েছে, সম্প্রতি তাদের ইন্টারনেট বাজারে সর্বোচ্চ বিক্রির রেকর্ড হয়েছে। আর এতে বিশেষ অবদান রেখেছে ই-কমার্স নির্ভর বিজ্ঞাপনগুলো। এই খাতেই গত বছরের শেষ তিন মাসে আয় কমেছে মেটার।
এদিকে, অ্যাপলের সঙ্গেও একটি বাণিজ্যিক চুক্তি করেছে গুগল। চুক্তি অনুযায়ী আইফোনের সাফারি ব্রাউজারে ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে থাকবে গুগল। যার মানে এখন থেকে গুগলের সার্চ অ্যাডগুলো আরও বেশি জায়গায় প্রদর্শিত হবে। ফলশ্রুতিতে আরও বিক্রয়যোগ্য ডাটা পাবে গুগল।
এটি দীর্ঘমেয়াদে মেটার জন্য একটি বড়সড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে। সম্ভাবনা আছে, বিজ্ঞাপনদাতারা সামনে ফেসবুকের বদলে গুগল সার্চ অ্যাডকেই বেশি প্রাধান্য দিবে।
টিকটকের চ্যালেঞ্জ
জাকারবার্গ বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছেন, এ মুহূর্তে তাদের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক। ছোট ছোট ভিডিওর সমাহার টিকটক ব্যবহারকারীদের আসক্ত করতে বেশ পটু। চীনা এই অ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন একশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
টিকটকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মেটা ইন্সটাগ্রামেও প্রায় একইরকম একটি ফিচার এনেছে, যার নাম ইন্সটাগ্রাম রিল। জাকারবার্গ জানান, ইন্সটাগ্রাম রিলই এখন এই অ্যাপের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিচার।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ইন্সটাগ্রাম রিল থেকে তেমন আয় করতে পারে না মেটা। কারণ, ভিডিও অ্যাড থেকে আয় করাটা কঠিন (যেহেতু সেগুলোকে সাধারণত স্কিপ করে যায় মানুষ)। সুতরাং, বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এমন- ইন্সটাগ্রাম ব্যবহারকারীদের রিলের প্রতি বেশি আকর্ষিত করছে মেটা, এবং এর ফলে তাদের ব্যবহারকারী বাড়লেও কমছে আয়।
মেটাভার্সের আকাশচুম্বী বাজেট
জাকারবার্গ বিশ্বাস করেন, ইন্টারনেটের পরের প্রজন্ম হচ্ছে মেটাভার্স। ভার্চুয়াল জগতে নিজস্ব সত্ত্বা থাকবে মানুষের এবং সেখানে সবকিছু করতে পারবে তারা; এই তাত্ত্বিক ধারণা বাস্তবায়নে বিশাল পরিমাণে বিনিয়োগও করছেন তিনি।
২০২১ সালেই এর পেছনে এক হাজার কোটি ডলার খরচ করেছেন জাকারবার্গ। সামনে এই খরচের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু জাকারবার্গের এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হবে, সেরকম ইঙ্গিত মিলছে না এখনও। অগমেন্টেড রিয়েলিটি হেডসেটের মতো ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তিগুলো এখন শুধু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের নাগালের মধ্যে আছে। বিদ্যুৎ বেগে এসব প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, সেই সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ।
ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে- জাকারবার্গ এখন তার কর্মচারী, ব্যবহারকারী এবং বিনিয়োগকারীদের বলছেন তার মেটাভার্স ভিশনের উপর বিশ্বাস রাখতে। কিন্তু এই চাওয়াটাই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। জাকারবার্গের ভিশনের উপর সামনের বছরগুলোতে কোটি কোটি ডলার খরচ করবে কোম্পানিটি। কিন্তু আদৌ সেটি ফলপ্রসূ হবে কি না তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ফেসবুক
ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারকদের কাছে মেটা ইতোমধ্যে একটি ভিলেন প্রতিষ্ঠান।
মেটার বিরুদ্ধে বর্তমানে একাধিক তদন্ত চলছে। প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে একচেটিয়া বাজার দখলের অভিযোগে মেটাকে তদন্ত করছে নতুন গঠিত ফেডারেল ট্রেড কমিশন ও একাধিক রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতর।
মার্কিন কংগ্রেস ইতোমধ্যে একটি অ্যান্টি ট্রাস্ট বিল পাস করানোর উদ্যোগও নিয়েছে।
জাকারবার্গ যদিও বলে আসছেন, টিকটক, অ্যাপল, গুগলের মতো কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মারাত্মক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে তার কোম্পানি। কিন্তু অ্যান্টি ট্রাস্ট বিল পাশ হলে আর ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মতো পরিষেবাগুলো কিনে ব্যবহারকারী বাড়াতে পারবে না মেটা।
এসব চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের জন্য এখন মেটাকে উদ্ভাবনের দিকেই নজর দিতে হবে। উদ্ভাবনের জন্য পূর্বে সবাই জাকারবার্গের উপর বিশ্বাস রাখলেও বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলছে, এখন আর তার উপর সেই বিশ্বাস নেই বিনিয়োগকারীদের।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।