নিজেদের আবিষ্কারের হাতেই প্রাণ হারিয়েছেন যে আবিষ্কারকেরা
জীবনকে সহজ, সুন্দর ও আরামদায়ক করতে সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ আবিষ্কারের পেছনে লেগে আছে। এই আবিষ্কারের পথটা মানুষের জন্য কখনো সহজ ছিলো না। এজন্য তাকে দিতে হয়েছে প্রচুর ত্যাগ-তিতিক্ষা, শ্রম; এমনকি অনেক সময় নিজের জীবন পর্যন্ত।
বিমান আবিষ্কারের প্রথম অগ্রদূত ডি রোজারিও সম্পর্কে আমরা অনেকে না জানলেও- তার গ্যাস বেলুনের ঘটনাটি সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই জানি। আকাশপথে পাখির মতো চলার প্রচণ্ড শখ ছিলো ফ্রান্সের এই ফিজিক্স ও ক্যামিস্ট্রির শিক্ষকের। তাই একদিন হাইড্রোজেন গ্যাস ও গরম বাতাসের বেলুন নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে আকাশে উড়াল দেন। কিছুক্ষণ পর সেই বেলুনে আগুন ধরে যায়, এতে মৃত্যু হয় তার। রেডিয়েশন বা বিকিরণ নিয়ে কাজ করছিলেন মেরি কুরি, একদিন এই বিকিরণের কারণেই তার মৃত্যু হয়। এছাড়া, টাইটানিক জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা কি জানি এই জাহাজেই সমুদ্রে ডুবে মারা গিয়েছিলেন এটির প্রধান ডিজাইনার। এমন আরো বহু বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক রয়েছেন যারা তাদের আবিষ্কৃত জিনিসের দ্বারাই মৃত্যুবরণ করেছেন।
উইলিয়াম বুলক
আমেরিকার এই আবিষ্কারক লোহা কাটার লেদ মেশিন, জমিতে বীজ বপন করার কটন প্রেস, সিড প্ল্যান্টার ও গ্রেইন ড্রিল আবিষ্কার করে সাড়া জাগান। এরপর তিনি নজর দিলেন প্রিন্টিং প্রেসের দিকে। যদিও তার আগেই রোটারি প্রেস নামক একটি প্রিন্টিং মেশিন আবিষ্কার হয়েছে, তারপরও তিনি এটিকে আরও দ্রুতগতির করার জন্য এর অরিজিনাল ডিজাইনকে আরও উন্নত করার কাজে হাত দিলেন। এটি মূলত ছিল ওয়েব রোটারি প্রিন্টিং মেশিন যা একসাথে বিশাল আকারের এক রুল কাগজ মেশিনে ঢুকিয়ে নেবে এবং তার উপর লেখা ছাপিয়ে প্রয়োজন মতো কেটে বের করে দেবে।
৩ এপ্রিল, ১৮৬৭ সাল। বুলক তার আবিষ্কৃত প্রিন্টিং মেশিনটি দিয়ে ফিলোডেলফিয়া পাবলিক লেজার নামক একটি পত্রিকা প্রিন্টিংয়ের কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে মেশিনটির পুলি ঘুরানোর বেল্টটি খুলে যায়। বুলক মেশিনটি অফ করে এটি ঠিক করার বদলে তার পা দিয়ে বেল্টটি লাগাতে যায়। আর এতে মুহূর্তের মাঝেই তার পা ও পায়ের নিচের অংশ মেশিনে আটকে গিয়ে থেঁতলে যায়।
ডাক্তাররা তার পা বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেন। একটা সময় তার পায়ে গ্যাংগ্রিন ধরে যায়। পরবর্তীতে তার জীবন বাঁচানো ও কৃত্রিম পা লাগানোর জন্য তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয় এবং অপারেশনের সময়ই তার মৃত্যু হয়।
হোরেস লসন হুনলি
হুনলি ছিলেন মূলত একজন উকিল, সাংসদ ও ব্যবসায়ী। ইঞ্জিনিয়ার জেমস ম্যাকক্লিনটক ও বাক্সটার ওয়াটসন সাবমেরিন বানানোর কাজে হাত দিলে তিনি তাদের সাথে যোগ দেন।
হুনলি ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি সাবমেরিন দিয়ে জাহাজ ধ্বংস করেছিলেন। ১৮৬৪ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় কার্লসটন হারবারে ইউএসএস হোস্টনিক যুদ্ধজাহাজটিকে তার তৈরি সাবমেরিনের মাধ্যমে ধ্বংস করেন। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো- সফল আক্রমণ শেষ করে ফেরার পথে এটি ডুবে যায়। তিনি তার ৮ সহযোগীসহ সাবমেরিনেই মারা যান।
থমাস মিজলে জুনিয়র
থমাস মিজলে জুনিয়র একজন বুদ্ধিমান আবিষ্কারক ও বিজ্ঞানী ছিলেন। তবে তার আবিষ্কারগুলো পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে তিনি প্রায়ই সমালোচিত হন। তিনি ইঞ্জিন নকিং সমস্যা সমাধানের জন্য গ্যাসোলিনের সাথে টেট্রাথিল ব্যবহারের ধারণা দিয়েছিলেন। যদিও এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি ছিল- তবে এটি ছিল একটি ক্ষতিকর দূষণের মিশ্রণ যা ইঞ্জিনের নির্গমণ ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতো।
আমরা সবাই জানি রেফ্রিজারেটর থেকে উৎপন্ন ক্লোরোফ্লোরোকার্বন বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে চলেছে। এটি মূলত উৎপন্ন হয় রেফ্রিজারেটরে ফ্রিয়ন গ্যাস ব্যবহারের কারণে। রেফ্রিজারেটরে ফ্রিয়ন গ্যাস ব্যবহারের ধারণাও এই থমাস মিজলে জুনিয়রই দিয়েছিলেন।
তবে তিনি তার আবিষ্কৃত রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মারা যাননি। মিজলের একটা সময় পোলিও রোগ হয়। এর ফলে ধীরে ধীরে তার শরীর অবশ হয়ে যায় এবং বিছানায় তার দিন কাটতে থাকে। বিছানা থেকে উঠে বাইরে ঘুরতে তিনি একটি পুলিনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র আবিষ্কার করলেন এবং এটি বেশ ভালো কাজ করতে লাগলো। একদিন এই যন্ত্রেই তিনি আটকে যান এবং মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
লুইস স্লোটিন
লুইস স্লোটিন ছিলেন একজন আমেরিকান পদার্থ ও রসায়নবিদ। লস আলামসে ম্যানহাটান প্রজেক্টে (পৃথিবীর প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির প্রকল্প) কাজ করার সময় তিনি তার নিজের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। একদিন তিনি তার সহকর্মীদের দেখাচ্ছিলেন কিভাবে গম্বুজ আকৃতির দুটি প্লুটোনিয়াম কোরকে আলাদা করা যায়। এটাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন 'ড্রাগনের লেজে সুড়সুড়ি' হিসেবে।
এই পরীক্ষাটি তিনি এর আগে বহুবার করেছিলেন। কিন্তু সেদিন তিনি আলাদা করার জন্য যে স্ক্রু ডাইভারটি ব্যবহার করছিলেন হঠাৎ সেটি তার হাত থেকে ফসকে দ্রবণটিতে পড়ে যায়। আর এটি পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেখানে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া শুরু হয় এবং এর তেজস্ক্রিয়তা লুইসের হাতে ও মুখে লাগে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
একটা সময় এই রেডিয়েশনের কারণে তার শরীরের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং ৩৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তার একজন সহকর্মীও এ দুর্ঘটনায় একইভাবে মারা যান।
ফ্রান্সিস ইজার স্ট্যানলি
ফ্রান্সিস ইজার স্ট্যানলি ও ফ্রিলেন ইজার স্ট্যানলি ছিলেন জমজ দুই ভাই। তারা একসাথে ছবি ছাপানোর একটি ড্রাই প্লেট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা থেকে তাদের বছরে প্রায় ১০ লাখ ডলার আয় হতো। তারা এই আয় থেকেই বিখ্যাত 'স্ট্যানলি স্টিমার অটোমোবাইল' নামে প্রাইভেট কার কোম্পানি গড়ে তোলেন। এই গাড়িটি গতির কারণে তখনকার সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল। ১৯০৬ সালে তারা এর একটি রকেট ভার্সন বাজারে নিয়ে আসেন- যা কিনা ঘণ্টায় ১২৭ মাইল গতিতে চলতো। এটি এতই জনপ্রিয় ছিলো যে, তখনকার সময়ে গাড়িটির অর্ডার পূরণ করতে কোম্পানিকে হিমশিম খেতে হতো।
১৯১৮ সালের কোনো একদিন ম্যাচাচুয়েটসে ফ্রান্সিস তার নিজ কোম্পানির একটি গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সামনে কোনো একটি বাধা দেখে তিনি পাশ কাটাতে গেলে গাড়িটি গিয়ে রাস্তার পাশে রাখা কাঠের স্তুপে আঘাত হানে। গুরুতর আহত অবস্থায় ফ্রান্সিসকে হাসপাতালের নেওয়ার সময় পথেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তারপর ১৯২৪ সালে তাদের এই গাড়ির কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়।
- সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন