অনাবিষ্কৃত করোনাভাইরাস? রহস্যময় রাশিয়ান ফ্লু
সময়টা ১৮৮৯ সাল। মধ্য এশীয় শহর বুখারা তখন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। হঠাৎ করেই একদিন অজ্ঞাত কোনো রোগে শহরটির বাসিন্দারা অসুস্থ হতে লাগলেন, মৃত্যুও হানা দিল তারপর।
শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণকারী ভাইরাসসৃষ্ট ওই রোগকে সে সময় নাম দেওয়া হয়— 'রাশিয়ান ফ্লু'। দ্রুতই সেটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতালগুলোয় রোগী উপচে পড়ে। সবচেয়ে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর শিকার হন বয়োবৃদ্ধরা।
বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও কর্মী অসুস্থ হওয়ায় বিদ্যালয় ও কারখানাগুলো বন্ধ রাখা হয়। ভাইরাসে আক্রান্তদের অনেকেই ঘ্রাণ ও স্বাদের অনুভূতি হারানোর কথা বলেছেন। রোগমুক্ত অনেকের দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি ও অবসাদের কথা উল্লেখ রয়েছে ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রে।
কয়েক বছর পর দুনিয়াজুড়ে রাশিয়ান ফ্লু'র অবসান ঘটে। এসময়ে অন্তত তিনটি বড় সংক্রমণ ঢেউয়ের কথা জানা যায়।
অজ্ঞাত রোগটি সংক্রমণের ধরন ও লক্ষণ অনেকটাই চলমান মহামারির মতোন। তাই ভাইরোলজিস্ট ও ঐতিহাসিকদের মনে প্রশ্ন জেগেছে- রাশিয়ান ফ্লু কি কোনো অনাবিষ্কৃত করোনাভাইরাসের ধরন? তাই যদি হয়- তবে অতীতের ওই মহামারির গতিপ্রকৃতি কী আমাদের বর্তমান মহামারি কতদিন চলবে বা কবে নাগাদ শেষ হবে-তার ইঙ্গিত দিতে পারবে?
রাশিয়ান ফ্লু যদি করোনাভাইরাস জনিত রোগ হলে- এসব বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, এখনও তার বংশজ আমাদের চারপাশের পরিবেশে কোনো না কোনোভাবে রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য দায়ী চারটি করোনাভাইরাস ধরনের- একটি হয়তো এরই উত্তরসূরি। তবে সেটি ১৮৮৯ সনের ফ্লু মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাসের ধরন থেকে অনেকটাই আলাদা। আর মাঝেমধ্যেই (দীর্ঘসময় পর পর) তা নতুন ধরনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়ে নতুন মহামারিও জন্ম দিচ্ছে। যেমনটা হয়েছে বর্তমান বিশ্বমারির ক্ষেত্রে।
তাদের এমন অনুমান সত্যি হলে—তা মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে। কিন্তু, আরেকটি শঙ্কাও দেখা দিয়েছে তার সঙ্গে। বর্তমান করোনাভাইরাস ওই ফ্লুর মতো আচরণ করলে তার আরেক অর্থ দাঁড়ায় -মানবদেহের শ্বাসযন্ত্রের ব্যাধি প্রতিরোধের ক্ষমতা সময়ের সাথে সাথে কমছে। এই বাস্তবতায় আমাদের সবাইকে হয়তো প্রতিবছর কোভিডের টিকা নিতে হবে।
কিছু ঐতিহাসিক অবশ্য রাশিয়ান ফ্লু নিয়ে দেওয়া এই 'হাইপোথিসিস' মেনে নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ফ্র্যাঙ্ক স্নোডেন বলেন, "এনিয়ে তথ্যের পরিমাণ খুবই কম। বলতে গেলে নির্ভরযোগ্য ডেটা নেই বললেই চলে।"
অবশ্য রহস্যের জট খোলার উপায়ও রয়েছে। মলিউক্যুলার বায়োলজিস্টদের কাছে এখন রয়েছে অত্যাধুনিক অনেক সরঞ্জাম; যা দিয়ে তারা রাশিয়ান ফ্লুতে আক্রান্তদের ফুসফুসের সংরক্ষিত টিস্যু থেকে ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করতে পারবেন। ফলে তাদের পক্ষে জানাও সম্ভব হবে- এটি আসলে কোন ভাইরাস ছিল।
ইতোমধ্যেই কিছু গবেষক সংরক্ষিত এমন টিস্যুর সন্ধানে বিভিন্ন মিউজিয়াম ও মেডিকেল কলেজে অনুসন্ধান করছেন।
রাশিয়ান ফ্লু:
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের টম ইওয়িং- এর মতো হাতেগোণা কয়েকজন ঐতিহাসিক রাশিয়ান ফ্লু নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। তারা বলছেন, চলমান করোনাভাইরাস মহামারির সাথে তারা এর অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন।
যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থল বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগীর চাপের মতো মিলগুলো উল্লেখ করেন তিনি।
ইওয়িং বলেন, "আমি বলব, হয়তো এটা করোনাভাইরাসই ছিল।"
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. স্কট পোডলস্কি এই ধারণাকে "সম্ভাবনাময়" বলে উল্লেখ করেন।
ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের মহামারিবিদ্যা ও বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আর্নল্ড মোন্টোর মতে, "অনুমানটি খুবই চমকপ্রদ।"
তিনি বলেন, "করোনাভাইরাসগুলো কোথা থেকে এলো- তা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে ভাবছি। তাহলে কি অতীতেও কোনো করোনাভাইরাসের মহামারি হয়েছে?"
জার্নাল মাইক্রোবায়োলজির সম্পাদক এবং অবসরপ্রাপ্ত সুইস মাইক্রোবায়োলজিস্ট হ্যারাল্ড ব্রুসেউ ২০০৫ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ওসি৪৩ (0C43) নামক করোনাভাইরাসের একটি ধরন বর্তমানে তীব্র সর্দিকাশির জন্য দায়ী। ১৮৯০ সালের দিকে এ ভাইরাস গরু থেকে মানবদেহে প্রথম ছড়াতে পারে। বলাই বাহুল্য তার উল্লেখ করা সময়সীমার চেয়ে মাত্র এক বছর আগেই বুখারাই হানা দেয় রাশিয়ান ফ্লু।
সর্দিকাশির জন্য দায়ী সংক্রামক আরো তিন ধরনের করোনাভাইরাস মানবদেহে দীর্ঘদিন ধরে ছড়াচ্ছে। এরমধ্যে যেকোনো একটি বা ওসি৪৩ যে রাশিয়ান ফ্লু মহামারির অবশিষ্টাংশ (বংশজ) হতেই পারে।
এনিয়ে সন্দেহের অবকাশ করার সুযোগ রয়েছে, সেকথা উল্লেখ করলেও ডা. ব্রুসেউ মনে করেন রাশিয়ান ফ্লু করোনাভাইরাসের কারণেই হয়েছিল।
রাশিয়ান ফ্লু আক্রান্ত রোগীরা ঘ্রাণ ও স্বাদের অনুভূতি হারানোর মতো যে উপসর্গগুলো সে সময়ের চিকিৎসকদের কাছে জানিয়েছেন তা ডা. ব্রুসেউ এর অনুসন্ধানের কারণেই আলোচনায় এসেছে।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ১৯ শতকে প্রচলিত ফরাসি শব্দ 'ফিন ডে সেলে' বা 'শতাব্দীর অন্ত' হয়তো রাশিয়ান ফ্লু মহামারির শেষ সময়ের প্রভাবকেই তুলে ধরে।
তারা মনে করেন, এগুলো সাধারণ ফ্লু মহামারির লক্ষণ নয়।
ডা. ব্রুসেউ তাঁর প্রতিবেদনে বলেছেন, কোভিডের মতই রাশিয়ান ফ্লু শিশু বা তরুণদের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বয়োবৃদ্ধদের প্রাণ কেড়েছে।
১৮৯০ সনের যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট রাজ্যের স্টেট বোর্ড অব হেলথের রেকর্ড পরীক্ষা করে ডা. ইওয়িং একই ধরনের ঘটনার প্রমাণ পান। রেকর্ডগুলো যথাযথ হলে- বোঝা যায় ১৮৯০ সনের বিশ্বমারির ভাইরাস সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার নয়। কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি বয়স্কদের পাশাপাশি যাদের বয়স খুব কম- তাদেরও মৃত্যু ঘটায়।
তবে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. স্নোডেন বলছেন, পুরো বিশ্ব দীর্ঘকাল ধরে নয়া-করোনাভাইরাস মহামারিতে জর্জরিত হচ্ছে, সমাজ কাঠামো বদলে যাচ্ছে। রাশিয়ান ফ্লুর ভিত্তিতে এখনই তেমন অনুমান হবে 'কাল্পনিক'।
তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হসপিটালের ইকাহন স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক ও ফ্লু গবেষক পিটার পালিসি। তিনি বলেন, রাশিয়ান ফ্লু করোনাভাইরাসের কারণে হয়েছে তা এখনও অনুমানের পর্যায়ে। করোনাভাইরাসের সাথে এটির সম্পর্ক বা ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে আলাদা হওয়ার ব্যাপারে তেমন জোরালো কোনো যোগসূত্র এখনও মেলেনি।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস