ভবিষ্যতের নতুন ভাষা অ্যানিমেশন: রুবাইয়াত হাবীব
রুবাইয়াত হাবীব বড় হয়েছেন রাজশাহীতে। ছোটবেলায় থেকেই আঁকাআঁকির শখ ছিল, তার বাবা ভারত থেকে ড্রয়িং শেখার বই এনে তাকে উপহার দেওয়ার পর থেকে।
৭১তম টেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এমি অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন রুবাইয়াত ও তার দল। তার পিএইচডি থিসিস থেকে বানানো অ্যাপ 'স্কেচবুক মোশন' পেয়েছিল আইপ্যাডের বছরসেরা অ্যাপের খেতাব। বর্তমানে অ্যানিমেশনের যোগাযোগের ক্ষমতাকে টিভি ফিল্মের বাইরে মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে গবেষণা করছেন। বর্তমানে কাজ করছেন অ্যাডোবিতে, সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসাবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়াশোনার সময় আগ্রহ ছিল কমিকস আঁকা নিয়ে, চতুর্থ বর্ষে থাকা অবস্থায় আরও তিনজন বন্ধুর সাথে প্রকাশিত হয়েছিল তার 'ভাক্ষোস'। কমিকসকেই তার একান্ত নিজস্ব ভুবন মনে হতো।
স্থিরচিত্র বা স্থির কোনো মাধ্যমে কোনো চরিত্রের অনুভূতি তুলে ধরার সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারেন দ্রুতই। পিক্সার এনিমেশন দেখে অনুপ্রাণিত হন। কমিকসকে একটি আলাদা ভাষা হিসেবে চিন্তা করতে শুরু করেন তখন থেকেই।
কমিকসে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করেন, তবে এরপরই সিঙ্গাপুরে চলে যান পিএইচডি করতে, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্সে। তার পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিল কীভাবে ডায়নামিক মিডিয়ামকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজ করা যায়। পিএইচডির রিপোর্টটি করেছেন বিভিন্ন কমিকস, কার্টুন ব্যবহার করে। কম্পিউটার সায়েন্সে কমিকস আকারে লেখা প্রথম পিএইচডি থিসিস এটিই।
দ্য পিক্সার স্টোরি ডকুমেন্টারি দেখে তার চিন্তার ধরন বদলে যায়। শিল্প আর বিজ্ঞানের সমন্বয়ে এ খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
তবে, সৃষ্টিশীল কাজ আর নতুন উদ্ভাবনের জন্য বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের মানুষের একত্রে কাজ করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। নতুন নতুন উদ্ভাবনের জন্য চাই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের একসাথে কাজ করার সুযোগ।
'বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইন্টার ডিসিপ্লিনারি শিক্ষা আর চিন্তার অভাব একটি বড় সীমাবদ্ধতা। আমি অনার্সে পড়ার সময় অন্য ডিপার্টমেন্টের কারো সঙ্গে কাজের সুযোগ পেলে হয়তো আরও অনুপ্রাণিত হতাম, ভিন্নভাবে দেখতে শিখতাম।"
রুবাইয়াত জানালেন, দেশের বাইরে যাওয়ার আগে অ্যানিমেশন নিয়ে সেভাবে কাজ করার কথা ভাবেননি তিনি। ভাবতেন, কম্পিউটার সায়েন্সের কাজের জায়গা খুব ছোট। কিন্তু বাইরে পড়তে গিয়ে এ ধারণা বদলে যায় তার, একাধিক ডিসিপ্লিনের মানুষের একসাথে কাজ করা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করেন।
'সবার জন্য অ্যানিমেশন'
২০১০ সালের দিকে কম্পিউটার সায়েন্সের খাতে অ্যানিমেশন শুধু বড় ফিল্ম কোম্পানিগুলোর জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক কিছু ছিল না। তখন থেকেই এ নিয়ে তার কাজ শুরু।
রুবাইয়াত মনে করেন, অ্যানিমেশন স্কেচিং এর মতো সহজ হওয়া উচিৎ। কথা, অঙ্গভঙ্গি, স্কেচ এসবের মাধ্যমে অ্যানিমেশন করতে পারবে মানুষ, এ নিয়ে কাজ শুরু করেন।
তার পিএইচডিতে এই ধারণা থেকেই স্যান্ড আর্ট নিয়ে কাজ করেন, কীভাবে স্যান্ড আর্টকে ডিজিটাল মিডিয়ামে নিয়ে আসা যায় এনিয়েই এগোয় তার কাজ।
অ্যানিমেশন টুল হলেও মনে হবে ড্রয়িং টুলের মতোই, যাতে ড্রয়িংয়ের মতোই সহজভাবে করা যাবে অ্যানিমেশনও। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি দিয়েই করা যায় অ্যানিমেশন। প্রথাগত অ্যানিমেশনের জন্য না এটি।
"পেশাদার কাজ না শুধু, সাধারণ মানুষও এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে সহজেই অ্যানিমেশন তৈরি করতে পারবে,"
তার এই গবেষণা গোল্ডেন মাউস অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট টপ অ্যাওয়ার্ড পায়। আমেরিকান সফটওয়্যার কোম্পানি অটোডেস্কে কাজ করতেন সে সময়, সফটওয়্যারটি নিয়ে দুই বছর কাজ করেন রুবাইয়াত ও তার সহকর্মীরা। তারপর কোম্পানির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসায় সফটওয়্যারটি বাজারে ছাড়েনি অটোডেস্ক। সে সময়ই এক কনফারেন্সে অ্যাপটির ডেমো প্রদর্শনের সময় অ্যাপলের ভিপি, আইপ্যাডের হেড এটি দেখে মুগ্ধ হন। তারপর আইপ্যাডে 'স্কেচবুক মোশন' নামে অ্যাপটি লঞ্চ হয়।
লঞ্চ হওয়ার সপ্তাহেই এটি অ্যাপলের ফিচারড অ্যাপ হয়। সে বছরেই ১০ লাখ অ্যাপের মধ্যে আইপ্যাডের 'অ্যাপ অফ দ্য ইয়ার' নির্বাচিত হয় স্কেচবুক মোশন। তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছিলেন, প্রকৌশলী, স্থপতি, শিক্ষক সবাই নিজ নিজ কাজে অ্যাপটি ব্যবহার করছেন। দুঃখজনকভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ব্যবসায়ক নীতির কারণে অ্যাপল অ্যাপটি এক স্টার্ট-আপের কাছে বিক্রি করে দেয়।
এর কিছুদিন পর অ্যাডোবিতে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসাবে যোগ দেন রুবাইয়াত।
স্পর্শ, অঙ্গভঙ্গি এসবের মাধ্যমেই অ্যানিমেশন তৈরির টুল তৈরি নিয়ে কাজ করেন অ্যাডোবিতেও।
মাত্র দুই মাস আগেই অ্যাডোবির ড্রয়িং টুল অ্যাডোবি ফ্রেসকো'তেও অ্যানিমেশন তৈরির টুল যোগ হয়। এর মাধ্যমে স্ক্রিনে স্ক্র্যাচ দিয়ে ডিজাইন করা সম্ভব। প্রথম প্রচলিত অ্যানিমেশন পদ্ধতির ডাইরেক্ট ম্যানিপুলেশন, প্রসিডিউরাল ও কিফ্রেমিং এর সমন্বয় ঘটানো হয়েছে প্রথম ভার্সনে।
অ্যাডোবি রিসার্চ গ্রুপের ক্যারেক্টার অ্যানিমেটর এমন আরেকটি সফটওয়্যার। এই সফটওয়্যারই টেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এমি অ্যাওয়ার্ডে এমি অ্যাওয়ার্ড পায়।
'স্ক্রিনের সামনে আপনি যেভাবে নাড়াচাড়া করবেন সেভাবেই স্ক্রিনের ক্যারেক্টার নারাচাড়া করবে। এর মাধ্যমে অ্যানিমেশন তৈরি আরও সহজ হয়ে গেলো,"
"টেলিভিশন আর ফিল্মের জন্য এমন প্রযুক্তি আগেও ছিল। কিন্তু তা বেশ জটিল। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এই অ্যাপের জন্য গায়ে সেন্সরসহ অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াই অ্যানিমেশন তৈরি সম্ভব," বলেন রুবাইয়াত।
ভবিষ্যতের নতুন ভাষা অ্যানিমেশন
অ্যানিমেশনকে তিনি শুধু নতুন কোনো টুল না সম্পূর্ণ নতুন মাধ্যম বা ভাষা হিসেবে দেখেন।
"আমি বিশ্বাস করি সামনের দিনগুলোতে কম্পিউটার প্রযুক্তি আকারে আরও ছোট হয়ে আসবে। এখনই অনেকে মনে করছেন, মোবাইল ফোনেরই আর দরকার হবে না হয়তো," বলছিলেন রুবাইয়াত।
"অডিও-ভিজ্যুয়ালের গুরূত্ব তো দিনদিন বাড়ছেই। এক সময় আসবে, যখন মানুষ কথা বলতে বলতেই গ্রাফিক্যাল কন্টেন্ট ব্যবহার করবে। এখানে জাদুর মতো কাজ করবে ডায়নামিক মাধ্যম,"
শুধু সুদূর ভবিষ্যৎ না। বর্তমান সময়েও যে কোনো খাতের মানুষের কাজ সহজ করে দিতে পারে অ্যানিমেশন। স্থিরচিত্র দিয়ে যে কোনো কিছু উপস্থাপনে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। সেসব ক্ষেত্রে অ্যানিমেশনের মতো ডায়নামিক মিডিয়াম ব্যবহার করে যে কোনো খাতের কাজ, ভাব প্রকাশ অনেকটা সহজ হয়ে আসে।
"স্কেচবুক মোশন লঞ্চ হওয়ার পরে দেখেছিলাম, জীববিজ্ঞানের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বোঝানোর সুবিধার জন্য অ্যাপটি ব্যবহার করে অ্যানিমেশন তৈরি করেছেন। নিজেদের নকশা, পরিকল্পনা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশের জন্য এর ব্যবহার করেন প্রকৌশলী, স্থপতিসহ নানা খাতের মানুষ," বলেন রুবাইয়াত।
"অ্যানিমেশনের ক্ষমতার কারণেই আগামী দিনে একটি আলাদা ভাষার মতো হয়ে উঠবে এটি। সহজ হয়ে উঠবে সবার কাজ। কিন্তু, সেজন্য আবার প্রয়োজন সাধারণ মানুষের জন্য এর ব্যবহার সহজ করে তোলা। এ নিয়েই আমার কাজ।"
অ্যাডোবিতে তার পরবর্তী প্রকল্প এআর (অগমেন্টেড রিয়েলিটি) ভিআর (ভার্চুয়াল রিয়েলিটি) নিয়ে, যা কম্পিউটিংয়ের তৃতীয় প্যারাডাইম। এ কাজে আছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও।
"কি-বোর্ড, মাউস বা স্কেচের মাধ্যমে অ্যানিমেশন করি এখন। কিন্তু অঙ্গভঙ্গি দিয়ে কীভাবে করব? মুখের কথা আর অঙ্গভঙ্গি দিয়েই, পারফরমেন্সের মাধ্যমেই অ্যানিমেশন তৈরির কাজ হবে,"
মানুষের অঙ্গভঙ্গিকে কম্পিউটার কীভাবে বিশ্লেষণ করে, প্রতিটি ছোটখাটো নাড়াচাড়া থেকে কি তথ্য বুঝে নেয়, এসব আরও বিস্তারিতভাবে গবেষণা করে অ্যানিমেশন টুলকে আরও সহজ করে তুলতে কাজ করছেন বর্তমানে।
"অ্যানিমেশনকে শুধু ফিল্ম না ভেবে ইউনিভার্সাল ল্যাঙ্গুয়েজ বা মিডিয়াম হিসেবে দেখতে হবে। আর এর ব্যবহারের মাধ্যমে যাতে সবাই উপকৃত হতে পারে সেজন্য দরকার একে সার্বজনীন করে তোলা," বলেন তিনি।
টিকটকের প্রসঙ্গ এনে রুবাইয়াত বলছিলেন, টিকটক ভিডিও কন্টেন্ট তৈরিকে এতো সহজ করে আনায় এতো জনপ্রিয় করেছে। এই সহজ করে তোলা দরকার অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রেও।
"অ্যানিমেশন শুধু আর্টিস্টদের জন্য নয়, এটি একটি ভাষার মতোই। সবার জন্যই দরকার। এজন্য আমি এখন অ্যানিমেশনকে অ্যানিমেশন না, ভাষা হিসেবে দেখি। কিন্তু সীমাবদ্ধতার কারণে, রিসোর্সের অভাবে সবাই এই ভাষায় কথা বলতে পারছে না সবাই।"
'অ্যানিমেশন বদলে দিতে পারে সবকিছু'
কথায় কথায় তিনি বলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কার্টুনিস্ট নাসরিন সুলতানা মিতুর কথা। হাই-স্কুলের ফিজিক্সের সূত্রগুলো কমিক আকারে নিয়ে আসেন এই কার্টুনিস্ট।
'আমি এই কাজ কমিকের বাইরে এনে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে আনতে চাই। কিন্তু সে সুযোগ তো নেই," মিতু আক্ষেপ করে বলেছিলেন রুবাইয়াতকে।
"আমাদের হাই-স্কুলের শিক্ষাদানকে আমূলে বদলে দিতে পারে অ্যানিমেশনের ব্যবহার। মিতুরই যদি এই সুযোগ থাকতো, বা কোনো অ্যানিমেটর তার সঙ্গে কাজ করতো অসাধারণ কাজ হতো,"
"আর আমাদের যোগাযোগও তো ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। আমাদের যোগাযোগ, তথ্যের আদান-প্রদান যেমন আর এখন শুধু টেক্সট নির্ভর নয়, অডিও-ভিজ্যুয়াল নির্ভর হয়ে যাচ্ছে।"
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিক্ষা, ব্যবসা কিংবা গণমাধ্যম- সবক্ষেত্রে অ্যানিমেশন ও ডায়নামিক মিডিয়ামের ব্যবহার আমাদের ভাব প্রকাশকে আরও সহজ করে তুলবে এমনটাই বিশ্বাস তার। আর যেভাবে দ্রুত গতিতে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিত্য-নতুন পরিবর্তন আসছে এরই হাত ধরে এক সময় অ্যানিমেশনও যোগাযোগের নতুন মাধ্যম হয়ে উঠবে বলে মনে করেন তিনি।
আর এই অ্যানিমেশনকে সর্বজনীন করে তোলা দরকার বলে মনে করেন রুবাইয়াত। জীবনের সবক্ষেত্রে অ্যানিমেশনের মতো ডায়নামিক ভিজ্যুয়াল মিডিয়ামকে আরও বিস্তৃত করতেই কাজ করছেন রুবাইয়াত ও অ্যাডোবিতে তার সহকর্মী গবেষকরা।
তার কাজের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ বিভিন্ন সমস্যা শুরুতেই গাণিতিকভাবে চিন্তা করলেও, তিনি প্রথমে ভিজ্যুয়ালি চিন্তা করেন। আর তার ভিজ্যুয়ালি চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরিতে তাকে সাহায্য করেছিল তার ছোটবেলার আঁকাআঁকির অভ্যাস।
রুবাইয়াত মনে করেন, তার এই দীর্ঘ যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার আর সফল হওয়ার পেছনে অন্যতম অবদান তার পরিবারের সমর্থনের। ছোটবেলা থেকেই তার ও তার ভাইয়ের আগ্রহের কাজে পরিবারের সমর্থন ছিল, সাহায্য ছিল। ছোটবেলায় শিশুদের সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনাকে যাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়, কারো আগ্রহের বিষয়কে যাতে দমিয়ে ফেলা না হয় এ বিষয়টির ওপর জোর দেন রুবাইয়াত।