৬৪ জেলা ঘুরে রেকর্ড গড়া বায়েজিদের স্বপ্ন এখন বিশ্বজয়ের
আমরা যখন ছুটি পাই বা অবসরে থাকি তখন পরিকল্পনা করি কোথাও ঘুরতে যেয়ে সময় কাটালে কেমন হয়! বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বছরে এক বা একাধিকবার শীতকালীন সময়টাতে ঘুরতে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু সেখানে একবছরেই দেশের প্রায় সবগুলো জেলা ভ্রমণ করে রেকর্ড গড়েছে বায়েজিদ সরকার।
বায়েজিদ পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু ভ্রমণের নেশা তার এতো বেশি যে, নিজের জমানো বৃত্তির মাত্র ২০ হাজার টাকা নিয়ে দেশ ভ্রমণে বের হয়ে গেলেন।
ভ্রমণ নিয়ে তিব্বতের বিখ্যাত ধর্মগুরু 'দালাই লামার' একটি উক্তি আছে, "প্রতিবছর এমন একটি জায়গায় ভ্রমণ করা উচিত যেখানে এর আগে কখনোই যাওয়া হয়নি"। প্রতিবছর নয়, বায়েজিদ মাত্র ১৫ মাসে দেশের ৬৪টি জেলা ঘুরে শেষ করেছেন। তার এই যাত্রা বাগেরহাট থেকে শুরু হয়ে ফেনী ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছিল। ২০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলেও পুরো দেশ ভ্রমণে বায়েজিদের খরচ হয়েছে প্রায় ২ লাখ টাকার মতো।
অদম্য ইচ্ছাশক্তি
কিশোর বয়স থেকেই বায়েজিদের স্বপ্ন ছিল তিনি একদিন বাংলাদেশটা ঘুরে দেখবেন। বন্ধুদের সাথে মাঝেমধ্যে টুরিস্ট স্পটগুলোতে ঘুরতে গেলেও বায়েজিদের দেশ ভ্রমণের ইচ্ছাটা তীব্র হয় করোনা মহামারিতে ঘরেবন্দী জীবন কাটানোর সময়। সবার মতো সে সময় তিনিও ভাবতে থাকলেন কী তাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করে? তখন তিনি ছোটবেলার কথা মনে করলেন, যখন বইয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বিখ্যাত স্থানের নাম পড়তে পড়তে ভাবতেন একদিন সারাদেশে ঘুরে বেড়াবেন। তারপর যে ভাবনা সেই কাজ, বেরিয়ে পড়লেন দেশ ঘুরার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে।
বায়েজিদ বললেন, "বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের কথা এতোদিন বইয়ে, গানে, কবিতায় শুনতাম কিন্তু নিজ জেলা নরসিংদী ও ঢাকার বাইরে তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি। প্রথমে আমার উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলো ঘুরে দেখবো। যখন আমি কোন একটা জেলায় যেতাম-তখন সেখানকার স্থানীয় মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা করতাম এবং সবসময় নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করতাম। ঐ অঞ্চলের মানুষদের জীবন-যাপন, সংস্কৃতি, বিখ্যাত খাবার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতাম। আমি বলবো ভ্রমণ আমাকে শুধু আনন্দিত করে না, এর মাধ্যমে আমি অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পেরেছি"।
"প্রথমদিকে আমি যখন আমার ভ্রমণ পরিকল্পনার কথা সবাইকে বলি, পরিবার ও বন্ধুদের অনেকেই মনে করতে থাকে এটা টাকা নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই না। পরিবার থেকে বলা হতো- এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমি যেন পড়াশোনা ও চাকরী পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলাম, তাই নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে নিজের জমানো বৃত্তির টাকা নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। তারপর ধীরে ধীরে পরিবার বুঝতে পারে আমি আমার দেশকে জানতে চাচ্ছি এবং এর মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে ও মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি। তখন পরিবার থেকেও আমাকে সাপোর্ট দিতে শুরু করে"।
বায়েজিদ সরকার একাই দেশের বেশিরভাগ জেলায় ও বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন। নির্দিষ্ট কিছু টুরিস্ট স্পটে যেমন কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেট, সেন্টমার্টিনের মতো জায়গাগুলোতে বন্ধুদের সাথে ঘুরলেও, তার সেই বন্ধুরা অন্য জেলাগুলোতে যেতে চায়নি। আমরা যেমন ছুটিতে বা বেড়াতে যাবার সময় এই জায়গাগুলোকেই ঘুরার জন্য বেছে নেই। সবার মতো তার বন্ধুরাও এই জায়গাগুলোর বাইরে যাওয়ার মতো আগ্রহ পায়নি। তাই অন্য জেলাগুলোতে বায়েজিদ একাই ঘুরে বেড়িয়েছে। তার ঘুরার সঙ্গী তখন কাঁধের ব্যাগ আর হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি । সেটি দিয়েই সে যেখানে যেত সেখানকার অপরূপ সৌন্দর্যের ছবি তুলে রাখতো।
প্রচলিত, পরিচিত কিংবা অপরিচিত অনেক জায়গায় ঘুরেছেন বায়েজিদ। তার কাছে যে স্থানগুলো ভালোলাগার শীর্ষে ছিল সেগুলো হলো-বান্দরবান, ভোলার কুকরি মুকরি চর, সুনামগঞ্জ থেকে জামালপুর বর্ডার সড়ক, নীলাদ্রি লেক, টাঙ্গুয়ার হাওর, নিঝুম দ্বীপ, মনপুরা দ্বীপ।
বায়েজিদ বলেন, "বান্দরবানের প্রকৃতি ও পরিবেশ এতোটা স্নিগ্ধ ও মনোরম যে কাউকে আকর্ষিত করবে। এবং বর্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য অপরূপ। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল ঘুরে ভালো লেগেছে। কিছু কিছু মধ্যাঞ্চল যেমন মাদারীপুর, শরীয়তপুর এই জেলাগুলোতে তেমন কোন আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান ছিল না, তবে মানুষের সাথে কথা বলে ভালো লেগেছে। আমার অভিজ্ঞতায় এযাবত যতোগুলো জেলায় গিয়েছি, সেখানকার স্থানীয় মানুষেরা খুব আন্তরিক ছিল এবং বিভিন্নভাবে তারা আমাকে সাহায্য করেছে"।
বিয়ার গ্রিলসের অ্যাডভেঞ্চারাস ভ্রমণ ও ঘুরে বেড়ানো দেখে বায়েজিদ অনুপ্রাণিত হতো। তাই নিজেও অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করতে চলে যেতেন পাহাড়ি এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি জানান, "নাফাকুম- আফিয়াকুম আমি পুরো রাস্তাটা হেঁটে পাড়ি দিয়েছি। ৬ দিনের এই ভ্রমণে ৪ দিন আমাকে অনবরত শুধু হাঁটতে হয়েছিল। আর সেখানে কোনরকম ইন্টারনেট ও বৈদ্যুতিক সুবিধা না থাকায় আমি বলতে গেলে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এখানে যেতে যাত্রাপথে আমি ৩টা আদিবাসী পাড়ায় থেকেছিলাম। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজন বেশ আন্তরিক ও সরল প্রকৃতির। ভাষা না বুঝলেও তাদের সাথে খুব ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং তারাও আমাকে আপন করে নিয়েছিল"।
"তারপর ভোলাতে চর কুকরি-মুকরিতে খোলা আকাশের নিচে চরের বুকে তাঁবু করে থাকাটা ছিল দারুণ অনুভূতি। সেখান থেকে ৩ ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে সাগরের মাঝখানে ঢালদ্বীপ নামের একটা ছোট দ্বীপ রয়েছে। চারিদিকে সাগর তার মাঝের ছোট্ট দ্বীপে তাঁবু টানিয়ে ছিলাম। মানুষজন এইরকম জায়গাগুলোতে তেমন ঘুরতে যায় না। আবার এসব জায়গায় যাতায়াত ও থাকাটা খুব সহজ ব্যাপার নয় এবং এখানে থাকার মতো ঝা-চকচকে সুবিধাসম্বলিত হোটেল নেই। কিন্তু আমার কাছে এইরকম অ্যাডভেঞ্চারাস ভ্রমণ করতে অন্যরকম ভালো লাগে এবং আকর্ষণ বোধ করি। সাগরের মাঝে দ্বীপে ,পাহাড়ের চূঁড়ায় কাটানো দিনগুলোর কথা এখন মনে করলে একরকম শিহরণ অনুভব করি। আর তখন কাটানো সেই দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকি নতুন উদ্যমে নতুন কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে"।
যাতায়াত ও প্রতিবন্ধকতা
ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে গণপরিবহনই ছিলো বায়েজিদের বাহন। কখনো বাস, কখনো ট্রেন, কখনো অটোরিকশা বা সিএনজি। ৫ ধাপে তিনি ৬৪ জেলা ভ্রমণ সম্পন্ন করেছেন। কোথাও ভ্রমণের পূর্বে তিনি পরিকল্পনা করে নিতেন যে, এই ১৫ দিনে এই কয়টা জেলায় যাবেন।পাশাপাশি গুগল দেখে আর স্থানীয় বন্ধুবান্ধবদের সাথে কথা বলে সেখানে যাওয়ার একটা রোডম্যাপ করে নিতেন। এভাবে বায়েজিদ মাঝে ২-৩ মাস বিরতি দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়তেন ভ্রমণে।
তিনি বলেন, "আমি পরিকল্পনা করার সময় পাশাপাশি অবস্থিত জেলাগুলোকে একত্রে রাখি। যেমন টাঙ্গাইল, পাশে ময়মনসিংহ তারপর জামালপুর এভাবে ম্যাপ করতাম। আমি যদি ময়মনসিংহ ঘুরে এসে রাঙামাটি যেতাম এবং সেখান থেকে তারপর জামালপুর যাই, তাহলে দেখা যেত এতো স্বল্প সময়ে আমি সম্পূর্ণ দেশ ভ্রমণ করে শেষ করতে পারতাম না। আবার এক্ষেত্রে যাতায়াতেই আমার অনেক সময় চলে যেত"।
ভ্রমণ নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বায়েজিদ বলেন, "ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক ভালো ঘটনা যেমন আছে, আবার কিছু খারাপ ঘটনারও সম্মুখীন হয়েছি। খারাপ ঘটনাগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে। আবার কোথাও কোথাও টুরিস্ট পুলিশের খামখেয়ালির জন্য কিছু অসাধু লোকজন সিন্ডিকেট করে ঘুরতে আসা লোকজনের থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলো।"
"একটা ঘটনা হয়েছিল আমার সাথে, ভোলাগঞ্জে সাদাপাথর দেখতে গিয়ে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হাঁটলেই পৌঁছে যেতে পারতাম, কিন্তু পথিমধ্যে বিপত্তি করল একদল যুবক। তারা বললো হেঁটে যাওয়া গেলেও সেখানে কাউকে হেঁটে যেতে দেওয়া হয় না। তাই তারা আমাকে হুমকি- ধামকি দিয়ে একরকম বাধ্য করলো অতিরিক্ত ভাড়ায় তাদের নৌকা করে যাওয়ার জন্য। আশেপাশে থাকা কয়েকজন স্থানীয় জানালো, এখানে এরা রাজনৈতিক দলের প্রভাবে সিন্ডিকেট করে মানুষকে জোর করে এভাবে নৌকায় যেতে বাধ্য করে।"
"আরেকটি ঘটনা আছে সিলেটের রাতারগুল ভ্রমণের। সেখানে নৌকা ভাড়া মাত্র আধঘণ্টার জন্য ৮০০-১০০০ রাখা হয়, যেখানে আপনি চর কুকরি-মুকরিতে সারাদিন নৌকায় ঘুরলেও ১২০০ টাকার মতো পড়বে। আমাদের দেশের টুরিস্ট স্পটগুলোতে মানুষের বিচরণ বেশি তাই তাদের থেকে এইরকম অন্যায়ভাবে অর্থ নেওয়া হচ্ছে, যা হয়তো অনেকে প্রথম প্রথম বুঝতে পারেন না। আবার অনেকে জানার পরেও বাধ্য হয়ে দিচ্ছেন সেখানে ঘুরতে গিয়ে। তাই এই বিষয়গুলোতে যদি টুরিস্ট পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিত তাহলে ঘুরতে গিয়ে মানুষকে এতো ভোগান্তির শিকার হতে হতো না"।
"আর বেশিরভাগ ঘোরার জায়গাতে ক্যামেরা বিজনেস চালায় একদল লোক। তারা এসে ছবি তুলে দিতে চাইবে। প্রথমে খুব বিনয়ের সাথে বললেও যখন কেউ একইরকম একাধিক ছবি নিতে চাইবে না বা সেগুলোর জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে রাজি হবে না- তখন তারা অনেকে একত্রিত হয়ে মোবাইল, টাকা সবকিছু রেখে দেওয়ার হুমকি দেয়। আমি ঘুরতে যেয়ে অনেক মানুষকে এইরকম সমস্যার মধ্যে পড়তে দেখেছি। কিছু কিছু স্থানে স্টুডেন্টদের জন্য টিকেট মূল্য কম রাখার নিয়ম থাকলেও তা রাখেনি। এইরকম নানা সমস্যার মুখোমুখি আমার হতে হয়েছিল।"
বায়েজিদের ইচ্ছা ভবিষ্যতে তিনি একটি ট্রাভেল এজেন্সি খুলবেন, যেখানে ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা ঘুরার ক্ষেত্রে সবরকম সুযোগ-সুবিধা পাবে। তিনি নিজে যে সমস্যাগুলোর মধ্যে পড়েছেন, সেরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা যেন অন্যদের না হয় সেটা নিশ্চিত করতে চান তিনি। বায়েজিদ এখন শখের বশে ঘুরে বেড়ান এবং মাঝেমধ্যে ফ্রিল্যান্সিং টুরিস্ট গাইড হিসেবেও অন্যদের গাইড করছেন। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে শেয়ার করার জন্য সম্প্রতি তিনি ' বায়েজিদ ট্রাভেলস এন্ড ফটোগ্রাফি' নামের একটি ফেসবুক পেজ খুলেছেন,যেখানে তিনি বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের ভিডিও ও ছবি তুলে পোস্ট করেন।
বায়েজিদ সরকার এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সমগ্র বিশ্বভ্রমণ করে রেকর্ড গড়তে চান তিনি। সেই লক্ষ্যে পাসপোর্ট করার প্রক্রিয়াও ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছেন বায়েজিদ। তিনি বলেন, "প্রথমে আমি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ঘুরার পরিকল্পনা করেছি। তারপর ধীরে ধীরে অন্য মহাদেশগুলো ঘুরবো। বাংলাদেশ ভ্রমণে বের হয়ে আমি জানতে পেরেছি আমার দেশ কতো সুন্দর আর মায়া দিয়ে ঘেরা। দেশকে জানতে হলে তাই দেশটা ঘুরে দেখতে হবে, মানুষের সান্নিধ্যে যেতে হবে।"