যেভাবে দরিদ্র-অনাথ বালক থেকে বিলিয়নেয়ার অলিগার্ক হলেন রোমান আব্রামোভিচ!
দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত শৈশব থেকে বিশ্বখ্যাত ইংলিশ ফুটবল ক্লাব চেলসির মালিক—রোমান আব্রামোভিচের জীবনটা গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়! খোদ রাশিয়ার নাটকীয় রূপান্তরের সঙ্গেই যেন তুলনা করা যায় তার জীবনকে। দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক পটপরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে ভাগ্য বদলেছে আব্রামোভিচেরও।
বিলিয়নেয়ার অলিগার্ক হিসেবে বরাবরই আলোচনায় ছিলেন রোমান আব্রামোভিচ। রাশিয়ার শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রভাবসম্পন্ন শিল্পপতিদের অলিগার্ক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ডামাডোলে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে উচ্চারিত হচ্ছে এই রুশ ধনকুবেরের নাম। রাশিয়ার আগ্রাসনের জবাবে প্রভাবশালী রুশ বিত্তবানদের উপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ চালিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। সেই গ্যাঁড়াকলেই ফেঁসেছেন আব্রামোভিচ। বাজেয়াপ্ত হয়েছে তার সব আর্থিক সম্পদ, এমনকি চেলসি বিক্রি করার অনুমতি পর্যন্ত পাননি!
কিন্তু কীভাবে দরিদ্র-অনাথ বালক থেকে বিশ্ববাসীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এলেন আব্রামোভিচ? কেমন ছিল তার এই উত্থান-পতনের সফর? ২০১২ সালে নিজের সাবেক মেন্টর বরিস বেরেজোভস্কির দায়ের করা মামলা চলাকালীন ইংলিশ হাইকোর্টেই আব্রামোভিচ জানিয়েছিলেন নিজের জীবনের নানা সত্য। কীভাবে ধাপে ধাপে ক্যারিয়ারে সাফল্যের চূড়ায় উঠেছেন এবং বিলিয়নেয়ার হওয়ার পথে এগিয়ে গেছেন, সেই গল্পই পুরোদস্তুর 'রাশিয়ান ভঙ্গি'তে বয়ান করেছেন চেলসি-মালিক।
প্রথম জীবন ও ক্যারিয়ার
রোমান আব্রামোভিচের জন্ম ১৯৬৬ সালে। মাত্র তিন বছর বয়সে মা-বাবা দুজনকেই হারান। রাশিয়ার উত্তরে কোমি রিপাবলিক অঞ্চলে আত্মীয়ের কাছে বড় হন তিনি। সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাটানোর পর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার উদ্দেশ্যে পড়াশোনা শুরু করেন। আব্রামোভিচের কর্মজীবন শুরু হয় মেকানিক হিসেবে।
রাশিয়ায় 'পেরেস্ত্রোইকা' আমলে অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করার সুযোগ ছিল। সে সময় আব্রামোভিচ বাচ্চাদের খেলনা তৈরি করতেন। লোকশ্রুতি আছে, মস্কোতে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বসে বাচ্চাদের খেলনা প্লাস্টিকের হাঁস তৈরি করতেন তিনি।
রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের অবসানের পর তেল ও অন্যান্য শিল্পজাত পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন আব্রামোভিচ। আদালতের বিচারিক রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে এক ক্যারিবিয়ান নৌ ভ্রমণে যখন বেরেজোভস্কির সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, ততদিনে আব্রামোভিচ মোটামুটি সফল একজন ব্যবসায়ী।'
'সিবনেফট' প্রতিষ্ঠা
আব্রামোভিচের ঈর্ষণীয় সম্পত্তি-ভাগ্যের পেছনে বড় ভূমিকা আছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান 'সিবনেফট' (বর্তমানে গাজপ্রম নেফট)-এর।
অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে আগে থেকেই টাকাকড়ি ভালোই ছিল আব্রামোভিচের পকেটে। তাছাড়া রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার পাশাপাশি ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে বেরেজোভস্কি ছিলেন তার জন্য আদর্শ ব্যক্তি। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ঘোর বিরোধী ছিলেন বেরেজোভস্কি। তিনি তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনকে আব্রামোভিচের আইডিয়া জানান।
প্রস্তাবটি ছিল এরকম—সরকার আব্রামোভিচ-বেরেজোভস্কির কাছে 'সিবনেফট' পরিচালনার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে; বিনিময়ে বেরেজোভস্কি সেখান থেকে পাওয়া আয় দিয়ে একটি ইয়েলৎসিনপন্থী প্রোপাগান্ডা টিভি স্টেশন প্রতিষ্ঠা করবেন।
১৯৯৫ সালের আগস্টে এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে 'সিবনেফট' প্রতিষ্ঠা করেন ইয়েলৎসিন। তখন আব্রামোভিচের বয়স মাত্র ২৯ বছর। পরপর বেশ কয়েকটি নিলামের মাধ্যমে এই বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানটি আব্রামোভিচের কাছে বিক্রি করা হয়। তবে কারো কারো দাবি, নিলামের দর নিয়ে কারচুপি হয়েছে এবং অন্য নিলামকারীদের বিভিন্ন উপায়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আব্রামোভিচ ২৪০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সিবনেফট-এর ৯০ শতাংশ কেনেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এর পেছনে তার নিজের সম্পদ থেকে ব্যয় করতে হয়েছে মাত্র ১৮.৮ মিলিয়ন ডলার!
এদিকে আদালতের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার জন্য আব্রামোভিচ নাকি বেরেজোভস্কিকে ব্যক্তিগতভাবে টাকা দিতেন! আদালতের ভাষ্যে, তাদের দুজনের মধ্যে এই গোপন চুক্তিসহ বেরেজোভস্কির গোটা রাজনৈতিক লবিং কার্যক্রমই ছিল চরম দুর্নীতিগ্রস্ত।
আব্রামোভিচের আইনজীবী স্বীকার করেন, ওই সময় তার মক্কেল দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। তবে তিনি এ-ও জানান, তৎকালীন রাশিয়ায় এভাবেই বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক
আব্রামোভিচের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণ অনুসন্ধান করেছেন যারা, তাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্কের জেরেই আজ তাকে কোণঠাসা করা হয়েছে। ইয়েলৎসিনের পর তার উত্তরসূরি পুতিনের সঙ্গেও আব্রামোভিচের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
২০০৩ সালে রাশিয়ার অ্যালুমিনিয়াম শিল্প খাতে একটি মোটা অংকের লেনদেন করেন রোমান আব্রামোভিচ। রাশঅ্যাল অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানির ২৫ শতাংশ শেয়ার ১.৯ বিলিয়ন ডলারে আরেক শিল্পপতি ওলেগা দেরিপাসাকার কাছে বিক্রি করে দেন তিনি। পরবর্তীতে আরও ২৫ শতাংশ বিক্রি করেন ৫৪০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে।
একবিংশ শতাব্দীর এই তুমুল প্রতিযোগিতামূলক দুনিয়ায় আব্রামোভিচ বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন ইংলিশ ফুটবল ক্লাব চেলসি কেনার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে এই ক্লাবটির মালিকানা চলে আসে আব্রামোভিচের হাতে।
এদিকে ২০০৫ সালে আব্রামোভিচের কোম্পানি সিবনেফটের ৭৩ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম। এর বিনিময়ে রুশ ধনকুবেরের হাতে চলে আসে ৭.৪ বিলিয়ন ডলার!
এভরাজ
বিলিয়নেয়ার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোমান আব্রামোভিচের জীবনযাপনের ধরনও বদলেছে। কিনেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, ব্যক্তিগত বিমান, ইয়ট, দ্রুতগতির গাড়ি। ১.৫ বিলিয়ন ডলার তিনি ব্যয় করেছেন চেলসির পেছনে, অন্যান্য খাতেও ছিল বিনিয়োগ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় লন্ডনভিত্তিক স্টিল উৎপাদনকারী ও খননকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এভরাজের কথা। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, প্রতিষ্ঠানটির ২৯ শতাংশ শেয়ার কিনেছেন আব্রামোভিচ। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় এভরাজের স্টিল উৎপাদন কারখানা রয়েছে। ২০২১ সালে এখান থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন ডলার। আব্রামোভিচের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পেছনে এভরাজকেও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। আর সবরকম কাজকে ছাপিয়ে পুতিনের সাথে তার 'দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক'র বিষয়টি তো আছেই!
শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ সরকার এভরাজকে রাশিয়ায় পণ্যসামগ্রী পাঠানোর অপরাধে অভিযুক্ত করেছে। ব্রিটিশ সরকার বলে, 'রুশ সেনাবাহিনীকে স্টিল সরবরাহ করেছে এভরাজ, যা তারা ট্যাংক নির্মাণের কাজে লাগিয়েছে।' তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে এভরাজ জানিয়েছে, তারা শুধুমাত্র অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণ কাজে ব্যবহারের উপযুক্ত লং স্টিল সরবরাহ করেছে।
কিন্তু রাজনৈতিক টানাপড়েনের জেরে ২০২১ সালেই এভরাজের বাজারমূল্য ৮৬ শতাংশ কমে গেছে! আব্রামোভিচের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার লেনদেনও স্থগিত করা হয়েছে।
তবে আব্রামোভিচ বরাবরই পুতিনের সঙ্গে তার দারুণ সুসম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। ৫৫ বছর বয়সি এই বিলিয়নেয়ার অলিগার্ক মনে করেন, তিনি এমন কিছুই করেননি যাতে করে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাজ্য সরকার।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান