নাস্তা তৈরি নিয়ে হত্যাকাণ্ড যেভাবে ভারতে স্ত্রী প্রহারের মনোভাব উন্মোচিত করে দেয়
গত মাসে ভারতীয় পুলিশ স্ত্রী-হত্যার অভিযোগে ৪৬ বছর বয়সী একজনকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সকালের নাস্তায় লবণ বেশি হওয়ায় স্ত্রীকে খুন করেছিলেন তিনি।
বিবিসিকে পুলিশ কর্মকর্তা মিলিন্দ দেশাই বলেন, সাবুদানা খিচুড়িতে লবণ বেশি হওয়ায় নিকেশ ঘাগ নামের ওই ব্যাংক কেরানি ৪০ বছর বয়সী স্ত্রীকে রাগের মাথায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।
ওই দম্পতির ১২ বছর বয়সী ছেলে এ খুনের স্বাক্ষী ছিল। তার বয়ানে জানা যায়, নিকেশ লবণ বেশি হওয়া নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে করতে স্ত্রী নির্মলার পেছন পেছন শোবার ঘরে ঢুকেন। এরপর তাকে প্রহার করতে শুরু করেন।
পুলিশ অফিসার দেশাই জানান, ওই সময় তার ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে থামতে বললেও নিকেশ না থেমে প্রহার চালিয়ে যান ও দড়ি দিয়ে স্ত্রীর গলা চেপে ধরেন।
নির্মলাকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। নিকেশ পরে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি পুলিশকে জানান, তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। পুলিশ তাকে কারাগারে পাঠায়।
ভারতে নিয়মিতই খাবার নিয়ে ঝগড়ার কারণে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে হত্যার খবর পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি খুনের কথা জানা যাক।
গত জানুয়ারি মাসে নয়ডাতে রাতের খাবার না দেওয়ার কারণে স্ত্রী হত্যার দায়ে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
২০২১ সালের জুন মাসে উত্তর প্রদেশে একজনকে আটক করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল খাবারের সাথে সালাদ না দেওয়ায় স্ত্রীকে খুন করে বসেন তিনি।
এর চার মাস পরে ঠিকমতো ফ্রায়েড চিকেন রান্না না করার দরুণ ব্যাঙ্গালোরের এক স্বামী তার স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করেন।
২০১৭ সালে বিবিসির খবরে জানা যায়, খাবার দেওয়াতে দেরি হওয়ায় ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করেন।
বছরের পর বছর, ভারতে গৃহ-সহিংসতা নারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত সহিংস অপরাধের একটি হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে এসেছে। দেশটিতে আইনের ভাষায় এটিকে 'স্বামী বা তার আত্মীয়স্বজন কর্তৃক নৃশংসতা' হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ২০২০ সালে দেশটির পুলিশ এক লাখ ১২ হাজার ২৯২ জন নারীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন করে নারী নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন।
তবে এ ধরনের সহিংসতা কেবল ভারতের স্বতন্ত্র কোনো দিক নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতি তিন নারীর একজন জেন্ডার-সম্পর্কিত সহিংসতার শিকার হন। এর বেশিরভাগই আসে স্বামী বা পার্টনারের কাছ থেকে।
ভারতে এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করা অধিকারকর্মীদের দুইটি বিষয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। এগুলো হচ্ছে এ ধরনের সহিংসতা নিয়ে নীরবতার সংস্কৃতি ও সহিংসতার পক্ষে প্রবল সমর্থন।
ভারতের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের (এনএফএইচএস৫) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ৪০ শতাংশ নারী ও ৩৮ শতাংশ পুরুষ মনে করেন কিছু কারণে স্ত্রীকে প্রহার করাতে দোষের কিছু নেই। এ কারণগুলো হচ্ছে স্ত্রী কর্তৃক শ্বশুর-শাশুড়িকে অসম্মান করা, ঘর বা সন্তানদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন, না বলে বাইরে বের হওয়া, সহবাসে রাজি না হওয়া, এবং ঠিকমতো রান্না না করা।
দেশটির চার রাজ্যে ৭৭ শতাংশের বেশি নারী স্ত্রী-প্রহারকে সমর্থন জানিয়েছেন। বেশিরভাগ রাজ্যেই পুরুষের চেয়ে নারীরা স্ত্রী-প্রহারে কোনোপ্রকার সমস্যা দেখতে পাননি। কেবল কর্ণাটক বাদে, বাকি সব রাজ্যে পুরুষের চেয়ে বেশি নারী মনে করেন, রান্না খারাপ হলে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে মারাতে কোনো দোষ নেই।
তবে এ সংখ্যা পাঁচ বছর আগের জরিপের চেয়ে কিছুটা কমেছে। তখনকার জরিপ অনুযায়ী ৫২ শতাংশ নারী ও ৪২ শতাংশ পুরুষ স্ত্রী-প্রহারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। অক্সফাম ইন্ডিয়া'র জেন্ডার জাস্টিস প্রোগ্রাম-এর পরিচালনাকারী অমিতা পিত্রে বলেন, সংখ্যা কমলেও মানসিকতা বদলায়নি।
'নারীর প্রতি সহিংসতা ও এর ন্যায্যতা প্রদানের মূল জড়িয়ে আছে পিতৃতন্ত্রে। জেন্ডার-সম্পর্কিত সহিংসতাগুলোতে এখানে বেশি সমর্থন দেখার কারণ হলো ভারতবর্ষে নারীকে অধস্তন জেন্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়,' বলেন তিনি।
অমিতা বলেন, 'এখানের সামাজিক ধারণাই হচ্ছে নারী সবসময় পুরুষের অধস্তন হিসেবে থাকবে। আর এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা। নারী পুরুষের সিদ্ধান্তে বাধা দেবে, পুরুষকে সেবা করবে, পুরুষের চেয়ে তাকে অবশ্যই কম আয় করতে হবে ইত্যাদি ধারণাই এখানকার সমাজে প্রচলিত। এর বিপরীতের ধারণাগুলো গ্রহণ করার হারও এখানে খুব কম। তাই, যদি কোনো নারী এ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেন, তার স্বামীর অধিকার আছে ওই নারীকে 'তার স্থান' দেখিয়ে দেওয়ার।'
পিতৃতন্ত্র বিভিন্ন জেন্ডারের প্রথাসিদ্ধ আচরণগুলো আরও বেশি করে বলবৎ করে দেয় এবং নারীরা ওই ধারণাগুলোকেই নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেন। তাদের নিজস্ব বিশ্বাসগুলো পরিবার ও সমাজের বিশ্বাসের কাছে চাপা পড়ে যায় বলে মন্তব্য করেন অমিতা পিত্রে।
উত্তর ভারতের বুন্দেলখণ্ড-এর একটি দাতব্য সংস্থা হচ্ছে ভানাঙ্গানা। এটি প্রহারের স্বীকার নারীদের নিয়ে কাজ করে। এর প্রতিষ্ঠাতা মিস কুকরেজা বলেন, নববিবাহিতা নারীকে একটি উপদেশ দেওয়া হয়- 'পালকিতে চড়ে তুমি স্বামীর গৃহে যাচ্ছ, কেবল মরণের পরই ও বাড়ি থেকে বেরিও'। তাই বেশিরভাগ নারী নিয়মিত সহিংসতার স্বীকার হলেও সেগুলোকে নিজেদের নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়ে কোনো অভিযোগ দাখিল করেন না।
কুকরেজা বলেন, 'গত দশকে আগের চেয়ে অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। তাও ভারতে স্ত্রী-প্রহার এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগোচরে থেকে যায়। অনেক লোক এখনো বলেন, 'ঘরের কথা যেন বাইরে না যায়'। তাই নারীরা পুলিশের কাছে যাওয়ার সাহস পান না।'
তিনি আরও বলেন, স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলে নারীদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। 'কলঙ্কের ভয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা মেয়েদের গ্রহণ করতে চান না মা-বাবা। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্রেফ গরীব বলে বাড়তি আরেকটি অন্নসংস্থানের দায়িত্বও নিতে চান না তারা।
এ ধরনের নারীদের জন্য বিশেষ কোনো সহায়তামূলক ব্যবস্থাও নেই। অল্প কিছু আশ্রয়কেন্দ্র আছে, আর স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের জন্য ক্ষতিপূরণ খুবই যৎসামান্য- ৫০০ থেকে ১৫০০ রুপির মধ্যে। এ অর্থ দিয়ে তাদের নিজের চলাই অসম্ভব, সন্তান লালনপালন তো আরও দূরের কথা,' বলেন কুকরেজা।
ভানাঙ্গানার প্রধান পুষ্পা শর্মা গত মাসে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনার কথা জানান। নারীদের মেরে তাদের ছোট ছোট সন্তানসহ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় তাদের স্বামীরা।
'দুটো ক্ষেত্রেই স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এসে প্রতিবেশীদের সামনে হেনস্তা করেন। তাদের দাবি ছিল, ওই স্ত্রীরা ঠিকমতো রান্না করেনি। তবে এটা কেবল একরাশ অভিযোগের একটি অংশমাত্র। খাবার হচ্ছে পুরুষদের সহিংস হয়ে ওঠার ট্রিগার পয়েন্ট,' বলেন পুষ্পা।
তিনি আরও জানান, 'কেবল 'পুরুষ উত্তরাধিকারীর' বদলে মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণেও স্ত্রী পেটানো হয়। স্ত্রী সুন্দর না হলে, গায়ের রঙ কালো হলে, স্ত্রীর বাড়ি থেকে যথেষ্ট পরিমাণে যৌতুক না এলে, স্বামী মাতাল থাকলে, স্বামী বাড়ি ফেরার পর দ্রুত খাবার বা পানি এনে না দিলে, খাবারে লবণ বেশি হয়ে গেলে বা লবণ দিতে ভুলে গেলে ইত্যাদি কারণেও স্ত্রীদের প্রহার করা হয়।'
১৯৯৭ সালে ভানাঙ্গানা মানুষকে গৃহ-সহিংসতা নিয়ে সংবেদনশীল করার উদ্দেশ্যে 'মুঝে জবাব দো' (আমাকে জবাব দাও) নামের একটি পথনাট্যের আয়োজন করে।
ওই পালা শুরু হতো 'আরে, ডালে লবণ হয়নি...' বলে, জানান কুরকেজা। তিনি আরও বলেন, 'আমাদের ২৫ বছরের ক্যাম্পেইনে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। এর কারণ হচ্ছে, আমরা বিয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দেই। বিয়ে বাঁচানোর জন্য এখানে সব করা যায়- বিয়ে অলঙ্ঘনীয়, এটাকে সবসময় টিকিয়ে রখতে হবে।'
'এই চিন্তাভাবনার পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। তাদের পড়ে পড়ে মার খাওয়ার কোনো মানে নাই,' বলেন তিনি।
অনুবাদ- সুজন সেন গুপ্ত