আমাদের পায়ের নিচের গোপন প্রাণিজগৎ রহস্যময়, বিস্ময়কর—এই গ্রহের প্রাণভোমরা লুকানো সেখানে!
কখনো ভেবেছেন কি আমাদের পায়ের ঠিক নিচেই আছে এমন একটা জগত যেখানে রয়েছে পৃথিবীর উপরিভাগের মতোই চমৎকার এক বাস্তুসংস্থান? মাটির মধ্যে থাকা এই বাস্তুসংস্থান একটা রেইনফরেস্ট বা প্রবালপ্রাচীরের চাইতে কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়, এমনকি এটি আমাদের কল্পনারও বাইরে! আমাদের খাদ্যের ৯৯ শতাংশের জন্যই 'মাটি'র উপর নির্ভরশীল থাকলেও, এই মাটি সম্পর্কেই আমরা কত কম জানি!
ভূগর্ভের মধ্যস্তরের এক কিলোমিটার বিশুদ্ধ মাটি এবং যার উপরিভাগে ক্ষতিকর কিছু নির্মিত হয়নি, তা লাখ লাখ প্রাণীর আবাসস্থল হতে পারে। এদের মধ্যে ৯০ ভাগ প্রাণী প্রজাতিরই এখনো নামকরণ করা হয়নি। এরকম এক গ্রাম মাটি, অর্থাৎ এক চামচেরও কম মাটিতে এক কিলোমিটার ফাঙ্গাল ফিলামেন্ট বা আঁশ রয়েছে।
যেদিন এক চামচ মাটি নিয়ে খুব শক্তিশালী একটা লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখলাম, আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। কারণ সেখানে আমি দেখেছি হাজার হাজার প্রাণের সমাহার। পোকার মতো দেখতে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্প্রিংটেইল (এক প্রকার পাখাবিহীন পোকা) এবং সেসবেরও আবার ডজন ডজন আকার-আকৃতি রয়েছে। গোল গোল অতি ক্ষুদ্র কণাও কোনো কোনো মাটিতে প্রতি বর্গমিটারে প্রায় অর্ধমিলিয়নের মতো থাকে।
এরপরে দেখা গেল এমন সব প্রাণী ওই মাটিতে লুকিয়ে যা আগে কখনোই আমি দেখিনি। যেটাকে আমি একটা ক্ষুদ্র কেন্নো ভেবেছিলাম, দেখা গেল সেটি সিমফিলিড নামক একেবারেই নতুন একটি প্রাণী। কিছু জিনিস দেখে মনে হলো জাপানি এনিমেশন ছবি থেকে উঠে আসা, লম্বা এবং মাথার সামনে-পেছনে দুটো অ্যান্টেনা; মনে হচ্ছিলো যেন একটা অদ্ভুত ড্রাগন কিংবা উড়ন্ত ঘোড়া! পরে জানতে পারলাম এই ছূচালো প্রাণীটি আসলে একটি ব্রিস্টেলটেইল।
আস্তে আস্তে আমার সংগৃহীত মাটির মধ্যে আরো প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। প্রাণীবিদ্যায় একটি ডিগ্রি থাকার পরেও সেসব প্রাণীর নাম কখনো আগে শুনিনি! মাত্র এক কিলোগ্রাম মাটি দুই ঘন্টা ধরে পরীক্ষা করেই বিশাল এক প্রাণিরাজ্যের সন্ধান পেলাম যা এক সপ্তাহ একটা সাফারিতে ঘুরে বেড়ালেও পেতাম না!
তবে মাটির বৈচিত্র্যতা ও প্রাচুর্যের চাইতেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে- মাটি আসলে কী? বেশিরভাগ মানুষের কাছেই মাটি হচ্ছে পাথর-কণা, মৃত গাছপালার জৈব মিশ্রিত একটা স্তূপ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মাটি আসলে একটি জীবতাত্ত্বিক কাঠামো এবং এর মধ্যে জীবন্ত প্রাণী রয়েছে যারা মানুষেরই মতো টিকে থাকার সংগ্রাম করে। মাইক্রোবস বা জীবাণুরা কার্বন থেকে সিমেন্ট তৈরি করে যার সঙ্গে খনিজ কণাগুলো একসাথে আটকে থাকে। সেই সঙ্গে ছোট ছোট ছিদ্রও তৈরি করে যার মাধ্যমে পানি, অক্সিজেন এবং অন্যান্য পরিপোষক পদার্থ ভেতরে প্রবেশ করে।
মাটি একটি বিশাল জায়গাজুড়ে বিস্তৃত থাকলেও এর কাঠামোর মধ্যে দৃঢ়তা রয়েছে। ব্যাক্টেরিয়া, ফাঙ্গি, গাছপালা এবং মাটির মধ্যে থাকা প্রাণীকুল নিজেদের অজ্ঞাতসারেই একটি প্রচন্ডরকম সূক্ষ্ম, বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত একটি কাঠামো তৈরি করে। এই জীবতাত্ত্বিক কাঠামো বন্যা ও খরার সময় মাটিকে নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়। মাটি যদি শুধুই একদলা পাথর-কণা হতো তাহলে তা পানির সাথে সাথেই একেবারে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
আবার কৃষিকাজের সময় কেন সহজেই জমির মাটি ভেঙে যায়, সে রহস্যও বেরিয়ে এসেছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে যখন কৃষকেরা নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করে মাটিতে, তখন মাটিতে থাকা জীবাণুরা কার্বনের দহনে সাড়া দেয়। তখন মাটিতে থাকা ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়, মাটি ভিজে যায় এবং বায়ুমুক্ত হয়ে একত্রে সন্নিবেশিত হয়। ফলে চাষের সময় মাটি সহজেই ভেঙ্গে পড়ে।
কিন্তু মাটির চমৎকার ক্ষমতা এর মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায় না। গাছপালা মাটিতে ১১ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চিনি নিঃসরণ করে। আর এটা দৈবক্রমে নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই ঘটে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নিঃসরণের আগে কিছু চিনি যৌগ পদার্থে পরিণত হয়।
কিন্তু এই রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করতে গাছেরও যথেষ্ট শক্তি ব্যয় হয়। তবুও গাছপালা এটি কেন করে? চিনিকে জটিল যৌগে পরিণত করার সাথেসাথেই গাছপালা এটিকে তাদের শেকড়ের আশেপাশের মাটিতে নিঃসরণ করে। মাটির এই স্তরকে বলা হয় রাইজোস্ফিয়ার। গাছ ও মাটির মধ্যকার সম্পর্ক বজায় রাখতেই এই চিনি নিঃসরণ করা হয়।
মাটি ব্যাক্টেরিয়ায় পরিপূর্ণ, এ তথ্য এতদিনে অনেকেই জানেন। মাটির সোঁদা গন্ধ আমাদের অনেকেরই ভালো লাগে, কিন্তু এই গন্ধ কোথেকে আসে তা কি জানেন? মাটিতে যেসব যৌগ জন্ম নেয়, সেগুলো এক হয়ে এই গন্ধ তৈরি করে। গাছপালা যে রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে নির্গত করে, তা মাটিতে থাকা যৌগকে সংকেত দেয়। কিন্তু গাছ শুধুমাত্র সেসব ব্যাক্টেরিয়াকেই জাগ্রত করে যেগুলো গাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এমনকি গাছেদের মধ্যেও ব্যবহৃত হয় একটি সুচারূ রাসায়নিক ভাষা। শুধুমাত্র গাছ যেসব জীবাণুর সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে চাইবে, তারাই এই ভাষাটি বুঝবে!
গাছপালা ব্যাক্টেরিয়াকে নিজ সংকেত দেওয়ার সাথে সাথেই মাটির মধ্যে একটা কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। গাছ যেই চিনি নিঃসরণ করেছে, ব্যাক্টেরিয়া তাতে সাড়া দেয় এবং সবচেয়ে ঘন মাইক্রোবায়াল কমিউনিটি তৈরি করে। মাত্র এক গ্রাম রাইজোস্ফিয়ারের মধ্যে এক বিলিয়ন ব্যাক্টেরিয়া থাকতে পারে। এব ব্যাক্টেরিয়া তখন গাছেদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি নির্গমন করে যা গাছকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। এমনকি মাটি কখনো খুব শুষ্ক বা লবণাক্ত হয়ে গেলেও ব্যাক্টেরিয়ার সাহায্য নেয়।
মানুষের বুকের দুধে যেমন অলিগোস্যাকারিডস নামক চিনি থাকে, যার উদ্দেশ্য শিশুর পেট ভরানো নয়, বরং শিশুর টিকে থাকার ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা, তেমনই কচি গাছপালাও মাটিতে বড় মাত্রায় সুক্রোজ নিঃসরণ করে যাতে নতুন মাইক্রোবায়োম তৈরি হয় এবং সেগুলো বেড়ে ওঠে। রাইজোস্ফিয়ারে থাকা জীবাণুগুলোই গাছের গোড়াকে সুরক্ষা দেয়।
বাইরে থেকে দেখতে মাটি খুব সুন্দর পদার্থ না হলেও, একবার আপনি এর কার্যপ্রণালী বুঝতে শুরু করলে তা আপনার চোখে সুন্দর রূপে ধরা দিবে।
আমরা এই মুহূর্তে যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন, তা হলো- পৃথিবীকে গ্রাস না করেই বিশ্বের সব মানুষকে খাওয়ানো। পৃথিবীতে প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের অন্যতম কারণ কৃষিকাজ, কিন্তু কৃষি না থাকলে মানুষের খাবারের চাহিদাও পূরণ হবে না। কৃষিকাজের ফলে বিশ্বে প্রাণীজগত বিলুপ্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি এবং বৈশ্বিক সংকট তৈরি হচ্ছে। একই সাথে এই শতকে বৈশ্বিক বন নিধনের ৮০ ভাগের জন্য দায়ী কৃষিকাজ। এই মুহূর্তে বিলুপ্ত হবার আশঙ্কায় আছে প্রায় ২৮,০০০ প্রজাতির প্রাণী। এর মধ্যে ২৪,০০০ প্রাণীর জীবনই কৃষিকাজের ফলে হুমকির সম্মুখীন।
শীঘ্রই কোনো পরিবর্তন না করা আসলে এ পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপের দিকে যাবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্যে আমরা আরো বেশি বেশি খাদ্য পাচ্ছি, কিন্তু কৃষকেরা যা জন্মান, তার অর্ধেক ক্যালরিই খামারের প্রাণীদের খাবারের পেছনে চলে যায়। এদিকে প্রাণীজ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের চাহিদা বেড়েই চলেছে। তাই আমাদের খাদ্যাভাসে একটি বড় রকম মৌলিক পরিবর্তন না আনলে ২০৫০ সালের মধ্যেই পৃথিবীকে আরো ৫০ শতাংশ বেশি শস্য উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণীকুলের বিলুপ্তি ব্যতীত সেটা কি সম্ভব?
আবার শস্য জন্মানোর জন্য প্রয়োজনীয় মাটিও দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধনী দেশগুলোতে মাটির ক্ষয়প্রক্রিয়া আরো বেশি। কারণ সেখানে শীতকালীন ঠান্ডা সরাসরি মাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধনী দেশগুলোতে মাটিতে অনেক বেশি কীটনাশক, সার ব্যবহার করায় মাটির ক্ষয় হয়। আবার দরিদ্র দেশে অতি বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি দুর্যোগের কারণে মাটির ক্ষতি হয়। বিশেষ করে মধ্য আমেরিকা, আফ্রিকার ক্রান্তীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৭০ শতাংশেরও বেশি মাটি মারাত্মক ক্ষতির মুখে রয়েছে যা ভবিষ্যতে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যহত করবে।
জলবায়ু পরিবর্তন এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন খরা, ঝড়ের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। খুব সূক্ষভাবে মাটির সহনশীলতা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। ভূমিধ্বস ও খরা চরম পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত হয়তো আমরা এ সমস্যা অনুধাবনই করতে পারবো না।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান