লেডি উইথ অ্যান আরমাইন: ৫০০ বছর পরেও যেভাবে টিকে আছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সবচেয়ে রহস্যময় পোট্রেট!
মনোমুগ্ধকর চাহনি, প্রাণবন্ত চেহারা আর সূক্ষ্ম মুখাবয়ব- ৫০০ বছর আগে সিসিলিয়া গ্যাল্লিরানির এই সৌন্দর্য্য স্বয়ং লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকেও মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল, যখন তিনি এই নারীর ছবি আঁকতে বসেছিলেন!
মিলানের প্রাসাদীয় পটভূমিতে তরুণ ভিঞ্চিকে বলা হয়েছিল ডিউক অব মিলান, লুডোভিকো স্ফরজার উপপত্নী সিসিলিয়ার একটি পোট্রেট আঁকতে। ডিউকের প্রতি তার ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সাদা রঙ এর বেজিজাতীয় একটি প্রাণী কোলে নিয়ে ভিঞ্চির চিত্রকর্মের জন্য মডেল হয়েছিলেন এই নারী। তার কোলের প্রাণীটি 'হোয়াইট আরমাইন' নামে পরিচিত। কিন্তু সেদিন ছবি আঁকার সময় কি এক মুহূর্তের জন্যও ভিঞ্চি ভেবেছিলেন যে তার এই পোট্রেটকে পার হতে হবে শত শত বছরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সময়?
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ভিঞ্চির আঁকা মাত্র ৪টি 'নারী চিত্রকর্ম' টিকে আছে; যার মধ্যে 'লেডি উইথ অ্যান আরমাইন' একটি। নিজের লেখা বই 'হোয়াট দ্য আরমাইন স'-তে এই তথ্য দিয়েছেন লেখক এডেন কলিনসওর্থ। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হলো, ভিঞ্চির আঁকা এই চিত্রকর্মের ৫০০ বছরের যাত্রা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন এডেন। আর তাতেই বেরিয়ে এসেছে এই চিত্রকর্মকে ঘিরে ইউরোপ, ফ্রান্স, পোল্যান্ড ও জার্মানিজুড়ে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও ক্ষুদ্ধ ইতিহাস!
দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ থাকা সিসিলিয়া গ্যাল্লিরানির পোট্রেটটি একে একে হাতবদল করে পোলিশ রাজকুমারী ইজাবেলা জারটোরিস্কির ব্যক্তিগত সংগ্রহ ভান্ডারে, ফ্রান্সে নির্বাসিত এক ব্যক্তির কাছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর কাছে।
পোল্যান্ডে এক গৃহকর্মীর কাছে রক্ষিত থাকার পর হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী এটি চুরি করে। হ্যান্স ফ্রাংক নামক এক উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তার হাতে যাওয়ার পর চিত্রকর্মটি প্রায় ধ্বংসই করে ফেলা হচ্ছিলো!
২০ শতকের নানা ঝড়-ঝাপ্টা পেরিয়ে আসার পর এই মুহূর্তে চিত্রকর্মটির জায়গা হয়েছে ক্রাকো এর জারটোরিস্কি জাদুঘরে, যেখানে পোল্যান্ডের সবচেয়ে মূল্যবান জাতীয় সম্পদগুলো রাখা হয়।
কিন্তু পাঠকের নিশ্চয়ই জানার আগ্রহ হচ্ছে, ভিঞ্চির এই চিত্রকর্ম আঁকার পেছনের গল্পটা কী? ১৪৮৬-৯০ সালের মধ্যে তরুণ শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি স্ফরজার প্রাসাদে আসেন। ধারণা করা হয়, সে সময় সিসিলিয়ার বয়স ছিল ১২ বছর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ডিউকের প্রতি তীব্র ভালোবাসা সত্ত্বেও তার নববিবাহিত স্ত্রীর ঈর্ষার শিকার হয়ে প্রাসাদ থেকে নির্বাসিত হতে হয় সিসিলিয়াকে। প্রাসাদ ত্যাগের সময় সাথে করে নিয়ে যান নিজের পোট্রেটকে, যদিও তিনি মারা যাওয়ার পর এটি সামলে রাখার মতো কেউ ছিলনা তার। ফলে হঠাৎ করেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ভিঞ্চির এই চিত্রকর্ম।
প্রায় ২৫০ বছর নিখোঁজ থাকার পর পোলিশ রাজকুমারী ইজাবেলা ডরোটা জারটোরিস্কার হাতে আসে 'লেডি উইথ অ্যান আরমাইন'। ১৭৪৬ সালে পোলিশ সাম্রাজ্যে জন্মগ্রহণ করা ইজাবেলার বাবা ছিলেন ডাচি অব লিথুয়ানিয়ার সংরক্ষক। রাজকুমারীর বাবা তার প্রয়াত মায়ের চাচাতো ভাই প্রিন্স অ্যাডাম কাজিমেরজ জারটোরিস্কের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেন।
১৭৯৬ সালে ইজাবেলা পোল্যান্ডের পুলাওয়ি জাদুঘরে বেশকিছু শিল্পের প্রদর্শনীর আয়োজন করেন, যা পরে জারটোরিস্কি জাদুঘর হিসেবে পরিচিত হয়। এর দুবছর বাদে, ইজাবেলার ছেলে অ্যাডাম জেরজি জারটোরিস্কি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির 'লেডি উইথ অ্যান আরমাইন' চিত্রকর্মটি কিনে নিজের মাকে উপহার দেন। আর এভাবেই ইজাবেলা এটির মালিক হন। কিন্তু ইজাবেলা এটিকে প্রথম ফ্রান্সিসের উপপত্মী হিসেবে ভুল বুঝেছিলেন।
যাহোক, ১৮৩০ সাল পর্যন্ত ইজাবেলার মালিকানায় থাকার পর রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র বিপ্লব জাগ্রত হওয়ায় ৮৪ বছর বয়সী ইজাবেলা এটিকে পুলাওয়ি জাদুঘর থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। তিনি চিত্রকর্মটি সিনিয়াওয়াতে নিজেদের পারিবারিক এস্টেটে লুকিয়ে রাখেন।
কিন্তু বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর রাশিয়া-অধ্যুষিত পোল্যান্ড নিজেদের স্বায়ত্ত্বশাসন হারায় এবং রুশ সাম্রাজ্যের শাসনে চলে আসে। সেই সাথে বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য ইজাবেলার স্বামীকে নির্বাসন দেওয়া হয়। এরপর কালের পরিক্রমায় ইজাবেলার স্বামী অ্যাডাম জারটোরিস্কি লন্ডনে কিছুকাল থেকে অবশেষে প্যারিসে স্থায়ী হন। তিনি সেখানে হোটেল ল্যাম্বার্ট ক্রয় করেন এবং এই হোটেলেই ১৮৬১ সাল পর্যন্ত ভিঞ্চির 'লেডি উইথ অ্যান আরমাইন' রক্ষিত ছিল।
এদিকে অ্যাডামের মৃত্যুর পর, ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের ডামাডোলের সময় তার ছেলে ভ্লাদিস্লাও চিত্রকর্মটি নিরাপদে রাখার জন্য জার্মানির ড্রেসডেনে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ড্রেসডেনে নেওয়ার আগে তা একবার ক্রাকোতে নেওয়া হয়। কিন্তু ড্রেসডেনেও নিরাপদ ছিল না চিত্রকর্মটির ভাগ্য! জার্মান শিল্প ঐতিহাসিক হ্যান্স পজ এর লোলুপ দৃষ্টি ছিল এর উপর। ফলে ১৯২০ সালে তিনি এটি ক্রাকোতে ফেরত দিতে বিলম্ব করেন।
এরপর কেটে যায় দুই দশক। ১৯৩৯ সালের শুরু হয় অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর তাণ্ডব। হিটলারের নির্দেশে হ্যান্স পজকে জার্মানি-অধ্যুষিত পোল্যান্ড থেকে চুরি যাওয়া শিল্পকর্মের দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। 'ফিউরারমিউজিয়াম' প্রকল্পের চালানোর দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন শিল্পকর্ম বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে হিটলারের নিজস্ব সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করা। ভবিষ্যতে অস্ট্রিয়ার লিনজ শহরে নিজ জন্মভূমিতে সেগুলো প্রদর্শনের পরিকল্পনা ছিল হিটলারের।
এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ শুরু হয় মিউনিখ থেকে। সেখানে জার্মান ইহুদিদের মালিকানায় থাকা শিল্পকর্ম বাজেয়াপ্ত করে একটি ডিপোতে রাখা হয়েছিল। হ্যান্স পজ এই ডিপো থেকে সেরা শিল্পকর্মগুলো বেছে নিতে শুরু করেন। শুধুমাত্র ভিয়েনা থেকেই তিনি ৮০০০ শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেন।
তবে হিটলারের এই প্রকল্প চলাকালীন 'লেডি উইথ অ্যান আরমাইন' ছিল ভ্লাদিস্লাওয়ের নাতি অগাস্টিন জোজেফ জারটোরিস্কি ও তার মা মারিয়া লুডভিকা ক্রাসিনস্কার হাতে। ক্রাসিনস্কাই মূলত তাদের পারিবারিক শিল্পকর্মগুলোর সুরক্ষার ভার নিয়েছিলেন তখন।
ক্রাসিনস্কা জাদুঘরের ভেতরে বালুর বস্তা, ফার্স্ট এইড কিট এবং কর্মীদের জন্য গ্যাস মাস্ক বরাদ্দ রেখেছিলেন। তাদের উপর নির্দেশ ছিল, যেকোনো মূল্যে এসব শিল্পকর্ম আগলে রাখা! ক্রাসিনস্কা পরিবারের তিনটি সর্বোচ্চ মূল্যবান শিল্পকর্মের মধ্যে ছিল ভিঞ্চি, রাফায়েল ও রেমব্রন্ট এর চিত্রকর্ম। এবং আবারও এগুলো সিনিয়াওয়াতে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
অগাস্টিন, তার স্ত্রী ও মা পারিবারিক এস্টেট ছেড়ে অন্য প্রাসাদে লুকিয়ে পড়ার সময় সিনিয়াওয়াতে রেখে যান শুধুমাত্র গৃহপরিচারিকাকে। গৃহপরিচারিকার কোনো ধারণাই ছিল না যে এখানে মূল্যবান চিত্রকর্ম রয়েছে।
জার্মান সৈন্যরা জারটোরিস্কিদের এস্টেটে তিন দিনের ক্যাম্প করে এবং বাড়ির বিভিন্ন অংশ তছনছ করে। গৃহপরিচারিকা জোফিয়া অবাক হয়ে দেখে যে ভাঙাচোরা জিনিসপত্রের সাথে পড়ে আছে মূল্যবান চিত্রকর্মগুলোর কাঠের বাক্স। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, জার্মান সৈন্যদের তখনো কোনো ধারণা ছিল না যে এসব চিত্রকর্ম কতটা মূল্যবান! তারা বরং ছোটখাটো দামি জিনিস চুরি করে চলে যায়। ভিঞ্চির 'লেডি উইথ অ্যান আরমাইন'কে তারা জুতোর দাগসহ দেয়ালের একপাশে ফেলে রেখে যায়!
এরপর স্থানীয় দুই পোলিশ নারীর সাহায্যে জোফিয়া চিত্রকর্মটি থেকে জুতোর ময়লা পরিস্কার করে এবং দুটি বালিশের কভার জোড়া দিয়ে সেলাই করে এটি ঢেকে রাখে। জার্মান সৈন্যরা আবারও বাড়িতে হানা দেওয়ার আগেই অগাস্টিন চলে আসেন।
কিন্তু এত চেষ্টার পরেও নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পায়নি ভিঞ্চির এই ছবিটি। এবার মাঠে নামেন ক্রাকোতে হিটলারের প্রতিনিধি হ্যান্স ফ্রাংক এবং তিনি ভিঞ্চির চিত্রকর্মের দিকে নজর দেন। একপর্যায়ে এটি গেস্টাপোর চোখে পড়ে এবং তারা এটি ছিনিয়ে নেয়। এরপর চিত্রকর্মটি একে একে ক্রাকো, ওয়ারশ এবং পরে ড্রেসডেনে হ্যান্স পজের কাছে পাঠানো হয়।
কিন্তু এখানেও আছে টুইস্ট! হিটলারের ব্যক্তিগত সংগ্রহে না পাঠিয়ে হ্যান্স ফ্রাংক এটি বার্লিনে পাঠিয়ে দেন নিরাপদে রাখার জন্য। ১৯৪১ সালে হ্যান্স চিত্রকর্মটি ক্রাকোতে তার ঘাটি, ওয়াওয়েল রয়্যাল ক্যাসলে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এখানে তিনি নিজের ডেস্কে ছবিটি ঝুলিয়ে রাখেন। আর এই ডেস্কে বসেই তিনি ইহুদিদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করতেন!
পোলিশ সংস্কৃতির ভিত্তি গুড়িয়ে দিতে নাৎসি বাহিনী দেশজুড়ে লুটপাট চালায়। তারা ৭৫,০০০ পান্ডুলিপি, ২৫,০০০ মানচিত্র, ৯০,০০০ বই ধ্বংস করে।
১৯৪৪ সালে সোভিয়েত বাহিনী পূর্ব পোল্যান্ডে এগিয়ে আসতে থাকলে হ্যান্স তার প্রাসাদ খালি করার প্রস্তুতি নেন এবং চিত্রকর্মটি অন্যত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি বাভারিয়াতে তার গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপনের বাড়িতে চিত্রকর্মটি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বাভারিয়ান স্টেট মিউজিয়ামের পরিচালক তাকে নির্দেশ দেন, চিত্রকর্মটি গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখতে, যদিও কারো দেখা না পাওয়ায় হ্যান্স নিজের কাছেই রাখেন এটি।
হিটলারের উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রিয়ার আলটজে একটি টানেলের ভেতর বোমাবর্ষণ করে ভিঞ্চির 'লেডি উইথ অ্যান আরমাইন' ধ্বংস করা। তার এই পরিকল্পনা সফল হলে ভিঞ্চির চিত্রকর্ম ছাড়াও, মাইকেলএঞ্জেলোর ম্যাডোনা অব ব্রুজ, জ্যান ফন আইক এর ঘেন্ট আলটারপিস এবং ভারমিরের অ্যাস্ট্রোনমা-এর মতো বিখ্যাত চিত্রকর্ম পুড়ে ছাই হয়ে ধুলোয় মিশে যেত। কিন্তু তা হয়নি।
১৯৪৫ সালে মে মাসে হ্যান্স ফ্রাংককে গ্রেপ্তার করে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের আওতায় আনা হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফ্রাংক গ্রেপ্তার হবার পর ভিঞ্চির চিত্রকর্মটি মিউনিখের একটি ওয়্যারহাউজে রাখা হয়। পরে তা সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ডে এবং ক্রাকোর একটি ওয়্যারহাউজে পাঠানো হয়।
অবশেষে ক্রাকোর ওয়্যারহাউজ থেকে 'লেডি উইথ অ্যান আরমাইন'-এর জায়গা হয় ক্রাকোর জাতীয় জাদুঘরে। পরবর্তীতে এটি আবার ফিরে আসে ওয়ারশতে এবং পরে চলে যায় রাশিয়ার পুশকিন মিউজিয়ামে।
১৯৯১ সালে পোলিশ আদালত চিত্রকর্মটিকে অ্যাডাম ক্যারল জারটোরিস্কির পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে আইনি রায় দেন। বিশ্বব্যাপী বহু জাদুঘরে প্রদর্শনীর পর ২০১৬ সালে মাত্র ১০৫ মিলিয়ন ডলারে জারটোরিস্কি পরিবার এটি পোলিশ সরকারের কাছে বিক্রি করে দেয়। ধারণা করা হয়, চিত্রকর্মটির আসল মূল্যের মাত্র ৫% দামে বিক্রি করা হয়েছে এটি।
মাইকেল কলিনসওর্থ এর লেখা 'হোয়াট দ্য আরমাইন স: দ্য এক্সট্রাঅর্ডিনারি জার্নি অব লিওনার্দো দা ভিঞ্চি'স মোস্ট মাইস্টেরিয়াস পোট্রেট' বইটি প্রকাশিত হবে আগামী ২৪ মে।
সূত্র: ডেইলি মেইল