ফ্যাশনকে প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তর করছে তারা
জামা-কাপড়, গয়নাকে শুধু ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবেই নয় প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবেও বেছে নিয়েছেন তারা। আংটিতে 'থামুন', খোপার কাঁটায় 'কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেন?', টিশার্টে 'গা ঘেঁষে দাড়াবেন না', শাড়ির আঁচলে 'সুবোধ যদি পালিয়ে যায় তাহলে ভোর আনবে কে?'- নানান বার্তায় প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন নতুন ভাবনার খোরাক জোগাতে। চার ভাই-বোন মিলে গড়া তোলা উদ্যোটির নাম দিয়েছিলেন বিজেন্স। আট বছর ধরে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তারা দেশীয় ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করছেন নতুনভাবে।
কিছুদিন আগেই বিজেন্স উদযাপন করলো প্রতিষ্ঠানের অষ্টম জন্মদিন। সে উপলক্ষে বিজেন্স নিয়ে সুহৃৎদের মতামত-সমালোচনা জানতে বেনামী বার্তা আহ্বান করেছিলেন তারা। সেসব বার্তায় বিজেন্স নিয়ে গ্রাহকদের আবেগ অনুভূতিই জানিয়ে দেয় আর দশটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কেন আলাদা বিজেন্স। কেউ লিখেছেন বিজেন্সের পোশাক তাদের মনোবল-আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় আবার কেউ লিখেছেন প্রিয়জনের সঙ্গে ম্যাচিং করে বিজেন্সের পোশাক পরার স্বপ্ন বুনছেন তারা। গ্রাহকদের অসংখ্য স্মৃতির সঙ্গে মিশে থাকা এই বিজেন্সের অন্যতম দুই উদ্যোক্তা নুসরাত জাহান জিসা ও জিনাত জাহান নিশার সাথে কথা হয় বিজেন্স নিয়ে।
যেভাবে পথ চলা শুরু
বিজু, জিসা, নিশা, শুভ। চার ভাইবোনের সবাই বড় হয়েছেন মায়ের নকশা করা, হাতে বানানো জামা-কাপড় পরে। মায়ের পর বড়বোন বিজুর কাঁধে ছিল এই দায়িত্ব। পোশাকের পাশাপাশি গয়না-ব্যাগসহ অন্যান্য অনুষঙ্গও নিজেরাই বানাতেন। পারিবারিক পরম্পরাতেই সৃজনশীলতার চর্চা হয়েছে সদস্যদের মাঝে। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে চট্টগ্রাম, সিলেটের নানা প্রান্তে কেটেছে তাদের শৈশব-কৈশোর।
নব্বইয়ের দশকের আর দশটা পরিবারের মতো ঈদ এলেই কার্ড দেওয়া-নেওয়ার চল ছিল ভাইবোনদের মাঝে। নিজের হাতেই নানারকম নকশায় সেসব কার্ড বানাতেন চারজন। হবিগঞ্জে থাকাকালীন একবার ঈদের আগে সেসব কার্ড পাড়ার দোকানে নিয়ে গেলেন বিক্রির জন্য। কার্ডের পেছনে বড়বোন বিজু চারজনের নামের অদ্যাক্ষর মিলিয়ে লিখে দিলেন BJNS। স্বপ্নের শুরু মূলত সেখান থেকেই।
ব্যবসা হিসেবে অনলাইনে পদযাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালে। নিশা বলেন, "একদিন বাসায় বসে জিসা আপু আর আমি নিজেদের জন্য মালা বানাচ্ছিলাম। গল্পের ছলেই নিজেদের বানানো গয়না নিয়ে ফেসবুক পেইজ খোলার কথা ভাবছিলাম। ঘরে থাকা নানা উপকরণ 'রিমেক' করে গয়না বানিয়ে বিক্রি করার চিন্তা ছিল। দিদি (বড়বোন বিজু) অফিস থেকে ফেরার পর তার তাকে বললে সে-ই আমাদের একটা ফেসবুক পেইজ খুলে দেয় বিজেন্স নাম দিয়ে। বাসার একটা মাটির থালায় দিদি চক দিয়ে এঁকে দিয়েছিলেন BJNS। সেটিই ছিল আমাদের লোগো। এটা থেকেই পরে ডিজিটাল লোগো বানিয়েছিলাম আমরা।"
শুরুতে মাসখানেক শুধু হাতে বানানো গয়না-ই ছিল বিজেন্সের পণ্য। ঘরে থাকা উপকরণ দিয়ে একদম শূন্য পুঁজিতে শুরু করে ধীরে ধীরে আগান তারা। এরপর ব্যবসার জমানো টাকা দিয়েই আনেন নিজস্ব ডিজাইনের শাড়ি-কুর্তি, ফতুয়া।
নিশা বলেন, "শুরু থেকেই রূট লেভেলে গিয়ে কাঁচামাল জোগাড় করা, নানা জায়গায় যোগাযোগ করাসহ সবকাজই নিজেরা করতে চেয়েছি। সহজে করার চিন্তায় পরিচিত কোনো জায়গা থেকে সাহায্য নেইনি আমরা। এই কাজে প্রায়ই নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কাঁচামাল সোর্সিং এর জন্য তিন বোন যখন দেশের নানা প্রান্তের গ্রাম বা মফস্বলে যেতাম শুধু মেয়েদের দেখে অনেকসময়ই খুব বেশি দাম চাইতো ব্যবসায়ীরা। একই জায়গায় কোনো ছেলে সঙ্গীকে নিয়ে গেলে দামের ব্যবধান হতো আকাশ-পাতাল। এরকম অভিজ্ঞতা খুব ভোগাতো আমাদের।"
"এখন অবশ্য এই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কারিগররা নিজেরাই তাদের কাজ নিয়ে ধর্ণা দেন আমাদের কাছে আজকাল," যোগ করেন জিসা।
চার ভাই-বোন শুরু থেকেই বিজেন্সের জন্য একসাথে কাজ করতেন। জিসা বলেন, "নিশা কখনো কারো অধীনে কাজ করতে চাইতো না। তার মনে হতো এতে নিজের ক্রিয়েটিভিটি থাকে না। আমরা অন্য ভাই-বোনেরা বিভিন্ন সময় বাইরে নানা জায়গায় কাজ করলেও নিশা সবসময় বিজেন্সের সবদিক দেখাশোনায় থাকতো।"
পড়াশোনার দিক থেকে এই চারজনের ব্যাকগ্রাউন্ড চার রকম। বিজু পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, জিসা পড়েছেন নাট্যতত্ত্বে, নিসা চারুকলায় আর শুভ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। বিচিত্র ব্যাকগ্রাউন্ড বিজেন্সের কাজে নতুন মাত্রা আনে সবসময়। ব্যবসায়িক পেইজ হলেও বিজেন্স যেন এক আর্ট গ্যালারি।
ফ্যাশনে প্রতিবাদের ভাষা
২০১৯ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিজেন্সের একটা টিশার্টের ছবি ভাইরাল হয়। টিশার্টে লেখা "গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না"। নানা শ্রেণীর মানুষ টিশার্টের লেখাটি নিয়ে নানারকম প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার এডিট করে টিশার্টের লেখা মুছে নানা আপত্তিকর কথা ছড়াতে থাকে। সেখান থেকে সমালোচনার ঝড় ওঠে ফেসবুক জুড়ে। টি-শার্টটি যারা বানিয়েছিলেন তারা তখন মেলায় স্টল নিয়ে ব্যস্ত। ফেসবুকের ভাইরালকাণ্ড নিয়ে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।
নিশা জানান, "গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না" বার্তাটি বিজেন্সে যোগ হয়েছিল তার নিজের সাথে হয়ে যাওয়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ হিসেবে।
"২০১৮ সালে একদিন ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনের রাস্তায় এক বয়স্ক লোকের কাছ থেকে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছিলাম আমি। ওই মুহূর্তে জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেও কেউ আমার পাশে দাঁড়ায়নি। সেদিন বাসায় ফিরে রাগে-ক্ষোভে পরোক্ষ প্রতিবাদ হিসেবে নিজের খোঁপার কাঁটায় এঁকেছিলাম 'গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না' কথাটি। পরবর্তীতে বিজেন্সের জন্য খোঁপার কাঁটা ডিজাইন করি এই লেখা নিয়ে। নিজের ক্ষোভের কথা লিখে পেইজে শেয়ার করেছিলাম কাজটা। তখন সেটা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। এর এক বছর পর টিশার্টে লেখাটি আনি আমরা," স্মৃতিচারণ করছিলেন নিশা।
"ভাইরাল হওয়া বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য কোনোটাই ছিল না আমাদের। যাদের এই সাধারণ প্রতিবাদটুকু নেওয়ার সক্ষমতা ছিল না তারাই নেগেটিভিটি ছড়াচ্ছিল এটা নিয়ে। পার্সোনালি আমরা এমনই। আগে ক্লাসওয়ার্কগুলোতে নিজস্ব চিন্তার ছাপ রাখতাম আর এখন সেট করি বিজেন্সের কাজে," যোগ করেন তিনি।
জিসা বলেন, "আমাদের পরিবার থেকেই সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শিক্ষাটা পেয়েছি। যার চর্চাটা সবসময় করি।"
'গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না' কিন্তু বিজেন্সের প্রতিবাদমূলক প্রথম কাজ নয়। টিএসসিতে পহেলা বৈশাখে যৌন হয়রানীর ঘটনার প্রতিবাদ করতে তারা আংটিতে আর মালায় এঁকেছিলেন 'থামুন'। ঢাকার দেয়ালে সুবোধের গ্রাফিতি দেখে শাড়ির আঁচলে এঁকেছিলেন 'সুবোধ পালিয়ে গেলে ভোর আনবে কে?'
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কবি' উপন্যাসের বিখ্যাত লাইন 'কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেন?'- লেখা হয়েছিল বিজেন্সের খোঁপার কাঁটায়। বেনামি বার্তায় এক গ্রাহক জানিয়েছেন গায়ের কালো রঙ নিয়ে তার সংগ্রামে সেই খোঁপার কাঁটা কীভাবে 'কনফিন্ডেন্স বুস্ট' করেছে। বিজেন্সের উদ্যোক্তারা জানান এই গল্পগুলোতেই তাদের কাজের সার্থকতা খুঁজে পান তারা।
গ্রাহক হিসেবে চান 'সুস্থ মানসিকতার মানুষ'
ব্যবসার খাতিরেও নিজেদের আদর্শের সাথে আপোষ করতে রাজি নন বিজেন্সের উদ্যোক্তারা। তাই গ্রাহক নির্বাচনে রেখেছেন অভিনব কৌশল। বিজেন্সের গ্রাহকদের নিয়ে ফেসবুক গ্রুপ 'বিজেন্স- গ্যালারি অফ আর্ট'- এ ঢুকতে হলে শুরুতেই দুইটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। প্রথম- 'ধর্ষনের জন্য দায়ী কি?' উত্তরের তিনটি অপশনে থাকে- পোশাক, বিচারহীনতা, অবশ্যই ধর্ষক। আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো- পাকিস্তানি পোশাক পরা হয় কি না।
এই দুই প্রশ্নের উতর থেকে শুরুতেই গ্রাহকের মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নেন বিজেন্স কর্তৃপক্ষ। নিজেদের আদর্শের সাথে সংঘর্ষপূর্ণ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে হয় এমন মানুষকে তারা গ্রাহক হিসেবে চান না।
এ প্রসঙ্গে নিশার ভাষ্য, "আসলে ঠিক কাস্টমার চাই না আমরা, সুস্থ মানসিকতার কিছু মানুষকে চাই। আমাদের পেইজে যেহেতু নারী-পুরুষ সবার জন্যই পণ্য আছে তাই ফেসবুক গ্রুপকেও জেন্ডার নিউট্রাল রাখতে চেয়েছি। ভালো মানসিকতার যেকেউ এখানে সদস্য হতে পারেন।"
নানুবাড়ির মরচে পড়া জানলা থেকে গয়না
অপ্রচলিত ধাতু দিয়ে অভিনব নকশায় মিনিমালিস্টিক গয়না বিজেন্সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
"মার্কেটে বেশিরভাগ সময় গতানুগতিক ডিজাইনের গয়না দেখি আমরা। ব্র্যান্ড হিসেবে আলাদা কিছুর ছাপ রাখতে চেয়েছিলাম। হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। গয়নায় জামদানি মোটিফ প্রথমবার আমরাই এনেছিলাম। একটা গয়না দেখেও কীভাবে বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায় সেই চিন্তা থাকে আমাদের সবসময়," বলছিলেন নিশা।
"নানুবাড়ির ঘরে পুরোনো জানালার শিকে মরচে পড়া দেখে গয়নায় মরচে পড়া ধাতু ব্যবহারের চিন্তা এসেছিল। একটা 'রাস্টিক ভাইব' এসেছে এই মরচে পড়া ধাতুর গয়নায়।"
মায়ের প্রথম উপার্জন
"মায়ের কাজের মাধ্যমে আমাদের সবার রক্তে মিশে ছিল এইসব সৃজনশীলতা," বলেন জিসা।
"মায়ের বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে। এরপর সংসারের দায়িত্ব আর আমাদের চার ভাইবোনকে স্বাধীনভাবে মানুষ করতে করতে গৃহিণী হিসেবেই পার করে দিচ্ছিলেন জীবন। নিজে কখনো উপার্জনের স্বাদ পাননি তিনি। মা খুব ভালো রান্না করতে পারেন। তার এক্সপার্টিজের জায়গা থেকেই কীভাবে তাকে প্রথম রোজগারের অনুভূতি দেয়া যায় তা ভাবছিলাম আমরা।
"২০২০ সালে লকডাউনের সময় সবাই যখন ঘরে বন্দী তখন মায়ের বানানো সন্দেশ বিজেন্সের মাধ্যমে বিক্রি করার উদ্যোগ নেই। তার ক্ষীরের হরলিক্স সন্দেশ বেশ সাড়া ফেলেছিল বিজেন্সের গ্রাহকদের কাছে। প্রথমবার যখন মায়ের হাতে তার উপার্জনের টাকা তুলে দিয়েছিলাম খুব আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আমরা পেইজে সেই সন্দেশের এলবামের নাম দিয়েছিলাম 'লিলি তোমার জন্য'। লিলি আমার মায়ের নাম," বলছিলেন জিনাত জাহান নিশা।
বয়সের কারণে মা কিছুটা অসুস্থ থাকায় আর কাজের চাপে অন্য সদস্যরাও ব্যস্ত থাকায় ক্ষীরের হরলিক্স সন্দেশ আর তৈরি হচ্ছেনা এখন বিজেন্সে।
যেমন চলছে এখন বিজেন্স
আট বছরে বিজেন্সের প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয়েছে অসংখ্য গ্রাহকের ভালোবাসা। গ্রাহকদের কাছ থেকে বিজেন্সের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা সবসময় সাদরে গ্রহণ করেন তারা। গ্রাহকদের চাহিদা আর স্বাচ্ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে চেষ্টা করেন নিজেদের কাজকে প্রতিনিয়ত ঝালাই করে নিতে। চার ভাইবোনসহ এখন বিজেন্সের স্থায়ী কর্মী ২০ জন।
শম্ভু আচার্যের আঁকা গাজিরপট নকশায় শাড়ি-পর্দা, দেশীয় লুঙ্গির নকশায় জামা-শাড়ি, বেহুলার কাহিনী গাঁথায় শাড়ি-বিজেন্সের সিগনেচার কাজ। যেকোনো নকশায় নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখেন তারা।
স্বপ্ন দেখেন অনলাইন মাধ্যমেই দেশের আনাচে-কানাচে সবার কাছে পৌঁছে যাবে বিজেন্স। সবধরনের মানুষের পছন্দ অনুযায়ী পণ্য থাকবে এখানে। 'একটু অন্যরকম' করেই যেন বিজেন্সকে দেখে এর সুহৃৎ-রা সে চেষ্টাই করেন জিসা-নিশার দল।
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রবাসেও বাঙালিদের পছন্দের নাম হয়ে উঠেছে বিজেন্স। সীমানার বাঁধা ডিঙিয়ে দেশের সংস্কৃতিকে কীভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করা যায় তা-ই লক্ষ্য বিজেন্সের।