এই ঘনঘোর বাদল দিনে বাংলা ছাতা না, চীনা ছাতাই যখন ভরসা!
পুরান ঢাকার চক মোগলটুলিতে ১৯৫৪ সালে তাজ উদ্দিন আহমেদ ছাতা বিক্রি শুরু করেন। মনে করা হয়, বাংলাদেশে ওটাই ছিল ছাতার প্রথম বাজার।
শুরুটা ভারত থেকে আমদানি করা ছাতা দিয়ে হলেও, কয়েক বছরের মধ্যে দেশেই ছাতা বানানো শুরু করেন আহমেদ।
ছাতার বিভিন্ন অংশ তিনি ভারত ও দেশের বাজার থেকে সংগ্রহ করতেন। ভারত থেকে আনা হতো হাতল, শিক, রানার (যেটা টেনে ছাতা খোলা বা বন্ধ করা হয়), স্ট্রেচার ইত্যাদি। দেশের বাজার থেকে মিলতো ছাতার শীর্ষভাগের খাঁজ, কালো কাপড় (তুলা আর পলিয়েস্টারের), কাঠের হাতল, হাতলের বাঁকা অংশ ইত্যাদি। এসব বিভিন্ন অংশ নিজের দোকানে বসে জোড়া লাগিয়ে ছাতা বানিয়ে দেশের বাজারে বিক্রি করতেন আহমেদ।
আরও কয়েক বছর পরে 'তাজ উদ্দিন ছাতা' নামে নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করেন তিনি। এর মধ্যে শরীফ ও আলম-এর মতো নতুন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। সে সময় বাজারে কেবল এ ধরনের কালো রঙের, হাত দিয়ে খোলা-বন্ধ করার বাংলা ছাতাই পাওয়া যেত।
তাজ উদ্দিনের পর তার ছেলে শামসুদ্দিন আহমেদ দোকানের হাল ধরেন। এরপর নাতি সায়েম আহমেদ দোকান চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু 'চীনা প্রভাবের' কারণে তাদের ছাতার ব্যবসা আর আগের মতো রমরমা নেই।
সায়েম এখনো তাজ উদ্দিন ছাতা বিক্রি করেন, তবে সংখ্যায় তা খুবই কম। তার ২৫ হাজার ছাতার বার্ষিক বিক্রির বেশিরভাগ অংশই এখন চীনের তৈরি রেডিমেড ছাতা বা দেশের ভেতরে বসে তৈরি করা চীনা ছাতার দখলে।
সায়েম জানান, ছাতার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির যে বাজার তাও এখন চীনা পণ্যের নিয়ন্ত্রণে। 'চীনের তৈরি খুচরা অংশ দিয়ে তৈরি করা ছাতা দিয়েই আমার ব্র্যান্ড চলে,' বলেন তিনি।
একটা সময় ছাতা তৈরিকে কুটিরশিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চীনা ছাতার আধিপত্যের কারণে সে শিল্প এখন পুরোপুরি হারিয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড স্ট্যাটিস্টিকস অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৬ লাখ ১০ হাজারের বেশি সংখ্যক ছাতা ও ৩১০০ মেট্রিক টন ছাতাসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয়েছে চীন থেকে।
কিন্তু কীভাবে স্থানীয় কুটিরশিল্প থেকে আমদানিনির্ভর হয়ে উঠলো ছাতার বাজার? চক মোগলটুলির ব্যবসায়ীরাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন।
চক মোগলটুলির বাজারে এখনও ব্যবসায়ী, কুলিদের হট্টগোল আগের মতোই আছে। যদিও ছাতার কারিগরদের এখন আর বিশেষ কোনো উপস্থিতি নেই এখানে। তবে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা এখনো দেশের প্রধান পাইকারি ছাতার বাজার হিসেবে চক মোগলটুলিকেই চেনে।
বাইরে থেকে দোকানগুলোর দিকে তাকালে চোখে পড়ে রংবেরঙের নানা ছাতা। ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে ছাতাগুলো। দোকানের ভেতরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম লেখা কার্টন থরে থরে সাজানো। মেঝেতে গোছায় গোছায় ছাতার বিভিন্ন অংশ জায়গা দখল করে রেখেছে।
তবে এখন ছাতা কেনাবেচার ভরা মৌসুম, তাই দোকানিদের একটু ফুরসত নেওয়ার জো নেই। বিক্রেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্টে, বর্ষাকালের এ সময়টাতে ছাতার বিক্রি সর্বোচ্চ হয়।
২০০৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা আমব্রেলা মার্চেন্ডাইজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন হাকিম ট্রেড সেন্টারের মালিক মো. এমএ সিদ্দিক। তিনি বলেন, বর্তমানে ছাতার বাজারের ৮০ শতাংশ চীনা পণ্যের দখলে।
সিদ্দিকের বাবা মোহাম্মদ হাকিম চক মোগলটুলিতে ১৯৭৪ সালে ছাতার পাইকারি ব্যবসা শুরু করেন। সিদ্দিক তার বাবার ব্যবসায় যোগ দেন ১৯৮৭ সালে।
এ ব্যবসায়ী জানান, বাংলা ছাতার বড় ক্রেতা ছিলেন গ্রামীণ মানুষেরা। শহরের মানুষেরা কেবল বর্ষাকালে ছাতা ব্যবহার করলেও, রোদ-বৃষ্টি দুটো থেকে বাঁচার জন্যই ছাতা ব্যবহার করতেন গ্রামের মানুষেরা।
সে সময়ে গ্রামবাংলায় বাংলা ছাতা সম্মানের ব্যাপার ছিল। ছাতার মালিকানা ধনী বা শিক্ষিত ও সাধারণ লোকের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিত।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অতীতে যখন রাস্তাগুলো কাঁচা ছিল, তখন কোথাও যাওয়ার জন্য মেঠোপথ ধরে হাঁটার সময় ছাতা ছিল গ্রামীণ মানুষের পরম বন্ধু। এরপর রাস্তাগুলো পাকা হলো, মোটরগাড়িও পৌঁছাল গ্রামের রাস্তায়। তখন আর মানুষের ছাতার দরকার পড়ল না।
'ঠিক ওই সময়টাতেই চীনা ছাতাগুলোও দেশের বাজারে পৌঁছাতে শুরু করলো। সেগুলোর বৈচিত্র্য ছিল দেখার মতো। এসব ছাতার প্রধান আকর্ষণ ছিল একাধিক স্তরে ভাঁজ করার পদ্ধতি, যার কারণে এগুলো ব্যাগে নিয়েও ঘোরা যেত। এই সুবিধাটির কারণে বাজারে দারুণ গতিতে ছড়িয়ে পড়লো ছাতাগুলো,' বলেন সিদ্দিক।
বর্তমানে চীনা ছাতার পাইকারি মূল্য প্রতিটি ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। এ দাম নির্ভর করে মান ও ভাঁজক্ষমতার ওপরে। বাংলা ছাতা কেনা যায় ১২৫ থেকে ১৪৫ টাকা দিয়ে।
অ্যাটলাস আমব্রেলা ফ্যাক্টরির বাংলা ছাতার কথা এখনো অনেক ব্যবহারকারী মনে করতে পারবেন। এক সময়ে বাংলা ছাতার প্রখ্যাত ব্র্যান্ড ছিল এটি। তবে চক মোগলটুলির অ্যাটলাসের কেন্দ্রীয় দোকানের ম্যানেজারেরাই বলছেন, অ্যাটলাস এখন আর আগের মতো বিখ্যাত নয়।
'আমরা এখন কম পরিমাণে তুলনামূলক নিম্নমানের বাংলা ছাতা তৈরি করি। অ্যাটলাস ট্যাগ থাকা যেসব ভালো মানের পণ্য তৈরি করা হয়, সেগুলো সবই চীনা যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি,' জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ম্যানেজার।
বাজারের সমঝদার লোকজনের মতে, এ মুহূর্তে ছাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হলো শংকর ছাতা।
যদিও ক্রেতাদের মধ্যে একটা সাধারণ বিশ্বাস রয়েছে যে শংকর একটি ভারতীয় ব্র্যান্ড, তবে এটি মূলত এসএস ট্রেডিং-এর একটি পণ্য। ১৯৮৯ সালে শংকর বিকাশ সাহা নামের একজন বাঙালি এটি চালু করেন।
তবে নিজেদের বিক্রি করা রংবেরঙের ও ভাঁজযোগ্য ছাতাগুলো কিন্তু এসএস ট্রেডিং তৈরি করে না। বর্তমানে শংকরের ২৫ রকমের ছাতা পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে দুই-তিন-চার-পাঁচ ভাঁজের ছাতা, বাগানে বসানোর ছাতা, ও ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বড় করা যায় (প্রায় ২৬ ইঞ্চি পর্যন্ত) এমন রকমের ছাতা ইত্যাদি।
এসএস ট্রেডিং তাদের কার্যাদেশ চীনে পাঠায়। এরপর সেখান থেকে ছাতাগুলো তৈরি করে দেশে এনে বিক্রি করা হয়। মুন ও রহমান ব্র্যান্ডের ছাতাও এভাবেই তৈরি ও বিক্রি হয়।
ছাতা ব্যাপারীরা বলতে পছন্দ করেন, এখনকার ছাতাগুলোর চেয়ে বাংলা ছাতার মান অনেক ভালো ছিল। কিন্তু আমদানি করা পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারেনি স্থানীয় ছাতাশিল্প।
হাকিম ট্রেডিং সেন্টারের মালিক সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশে ছাতার বাজার প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। এ পরিমাণ টাকার মধ্যে কর্মী খরচ হিসেবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কেবল ১০ কোটির মতো আয় করতে পারে।
কিন্তু স্থানীয় ছাতাশিল্প কেন বাড়েনি? সিদ্দিক বলেন, ভালো মানের ভাঁজযোগ্য ছাতা তৈরি করার জন্য প্রয়োজন বড় মাপের বিনিয়োগ। সস্তাদামে ছাতা আমদানি করার সহজ সুবিধার মাঝেও গতানুগতিক ধারার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে এখনো অনিচ্ছুক।
এ শিল্পে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ-এরও অনুপস্থিতির কথা তুলে ধরেন সিদ্দিক। ভাঁজযোগ্য ছাতার প্রতিটি অংশ চীন থেকে আমদানি করতে হয়।
'এতসব সত্ত্বেও যদি সরকার নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা ও ছাতার খুচরা অংশ আমদানির ক্ষেত্রে করমুক্ত সুবিধা দেয়, তাহলে এখানে ছাতা জোড়া লাগানোর শিল্পটি উন্নতি করার বিশাল সুযোগ রয়েছে,' বলেন সিদ্দিক।
তিনি বিশ্বাস করেন, ছাতা জোড়া লাগানোভিত্তিক কুটিরশিল্প গড়ে উঠলে ৫০০ কোটি টাকার প্রায় অর্ধেক পরিমাণ অর্থ বাইরের বাজারে চলে যাওয়া ঠেকানো যাবে।