যেভাবে চরের নারীদের তৈরি শাড়ি-পোশাক ঢাকার হাইএন্ড মার্কেটে…
বনানীর ১২ নম্বর রোডের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল 'ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব দ্য চরস'- এর আউটলেটটির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখ আটকাল কাঠের তৈরি একটি নৌকার মিনিয়েচারের ওপর। সুন্দর-সাজানো সেই নৌকা থেকে চোখ না সরতেই দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সারি সারি শাড়ির ওপর।
সবগুলোই ন্যাচারাল ডাই বা প্রাকৃতিক রঙের শাড়ি। মিহি সুতোর বুনন। রঙগুলোও একেবারেই উৎকট নয়। আর স্পর্শে এতটাই আরামদায়ক, মোলায়েম- নিমিষেই আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। আমার চোখে-মুখে মুগ্ধতা দেখেই হয়তো আউটলেটের কর্মচারী আজিজ উপযাচক হয়ে জানালেন, চরের নারীরা নিজ হাতে তৈরি করেন এসব শাড়ি, পোশাক।
পরে আরো খোঁজখবর করতে গিয়ে জানলাম, চরের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করে ফ্রেন্ডশিপ নামের এনজিও। চরের নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজস্ব তাঁতে শাড়ি বুনতে শেখানোর ধারণা একদমই নতুন। এ বিষয়ে আউটলেটের ম্যানেজার ফয়সাল আহমেদকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আরও চমকপ্রদ তথ্য: চরের নারীদের তৈরি সম্পূর্ণ হাতে বোনা ও প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো এসব পোশাক শুধু ঢাকা বা দেশের ভেতরেই নয়, রপ্তানি হয় লুক্সেমবার্গ, ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো দেশেও!
ফ্রেন্ডশিপ কালার অব দ্য চরস- এর পেছনের গল্প
নদীভাঙনের পর নতুন করে জেগে ওঠা চরের মানুষের জীবনসংগ্রাম আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কাজ করছে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ এনজিও।
এনজিওটি ভাসমান হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করলেও চরাঞ্চলের কাজ শুরু করে ২০০৯ সাল থেকে। প্রথম দিকে চর এলাকার সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি বাল্যবিয়ে রোধের উদ্দেশে কাজ করতেন তারা। বিশেষ করে পঞ্চম শ্রেণির পরেই সামাজিক অবস্থার চাপে মেয়েদের যাতে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে না দেওয়া হয়, তার জন্য কিশোরীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যম খুঁজে বের করা ছিল এনজিওটির উদ্দেশ্য। আর সেজন্যেই তাঁতবুনন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সংস্থাটি।
চরে নারীদের অবস্থা তো সহজেই অনুমেয়, তাই পিছিয়ে পড়া কিশোরীদের অর্থ-আয় বিষয়ে তাদের অভিভাবকদের চিন্তামুক্ত রাখা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়।
"প্রথমে যখন ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়, ৩০ জনের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। কিছুদিন না যেতেই সেখানে প্রায় ৭০-৮০ জনের মতো আসতে শুরু করে। এসময় যাদের স্বামী ছেড়ে গেছে বা বিধবা নারীরাও প্রশিক্ষণ নিতে আসা শুরু করলে, তাদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে উইভিং, ডাইং ও ট্রেনিং দেওয়া হতো। পরে তিনমাসের টেইলারিং বা সেলাই শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে ফেন্ডশিপ কালারস অব দ্য চরস। যদিও আনু্ষ্ঠানিকভাবে সংস্থাটি বিনিয়োগ শুরু করে ২০১৫ সালের দিকে", এভাবেই বলছিলেন এনজিওটির উৎপাদন শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ আবদুল জব্বার।
তবে এরপরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি এনজিওর এ বিভাগটির। বর্তমানে হাজার খানেক নারী স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন এ সংস্থায় কাজের মাধ্যমে।
বাল্যবিয়ে বন্ধ থেকে এন্টারপ্রাইজে রূপ
শাহ মোহাম্মদ আবদুল জব্বার জানান, প্রথমদিকে নারীদের উৎসাহ দেখে বিনা সুদে প্রতি মাসে ২০০-৩০০ টাকা কিস্তিতে সেলাই মেশিন দেওয়া শুরু করে। এরপর তাদের কিছু পুঁজি দেয় এনজিওটি, যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের কাপড় বুনতে ও সেলাই করতে পারেন, আবার স্থানীয়ভাবে সেগুলো বিক্রিও করতে পারেন।
যদিও এরকম সময়ে অনেকেই আবার ঢাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানায় যোগ দিতে শুরু করেন। তবে স্থানীয়ভাবে যাতে এসব নারী যাতে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারে সেজন্য ধীরে ধীরে আরও বেশ কয়েকটি চরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন তারা।
২০০৯ সালে গাইবান্ধার সিদাইর চরে প্রথম উইভিং (বুনন), ডাইং (রং) ও প্রিন্টিং সেন্টার গড়ে তোলা হয়। এরপর ১২ বছরের মধ্যে আরও ৯টি চরে ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়েছে। কাজ চলছে আরও বেশ কয়েকটি চরে। বেড়েছে কাজের পরিধিও। কারুশিল্প বা ক্রাফটিং, কুশিকাটার কাজও শেখানো হচ্ছে।
অর্থাৎ আউটলেটটিতে প্রদর্শিত শাড়ির পাশাপাশি নজরকাড়া, মালা, কানের দুল, ছোট-ছোট কুশিকাটা পুতুল আর পার্সও চরের এসব নারীদেরই তৈরি। এসব বিক্রির তাকা সরাসরি চলে যায় বন্যাদুর্গতদের এলাকাগুলোয়, তাদের কল্যাণে।
রাজধানী ঢাকায় ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব দ্য চরস- এর ধানমন্ডি শোরুমেও দেখা মিলবে একই দৃশ্যের।
জানা গেল, এসব ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সবাইকে প্রথম মাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ৫০ টাকা করে দেওয়া হতে থাকে। আবার কাজের ওপর নির্ভর করেও টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে। পাশাপাশি রয়েছে সেলাই শেখার ব্যবস্থাও। এ পর্যন্ত প্রায় হাজার খানেক নারী এ বিভাগে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
বর্তমানে কাজের ওপর নির্ভর করে একেকজন নারী মাসে ১০ থেকে ১৮ হাজার টাকাও আয় করছেন। শুধু তাই নয়, যেসব নারীরা কাজ করতে আসেন, তাদের শিশুদের জন্য স্কুলও পরিচালনা করে সংস্থাটি।
যেখানে কয়েক বছর আগেও খাবারের অভাব ছিল এসব নারীদের নিত্যদিনের সঙ্গী, সেখানে শুধু স্বাবলম্বী হয়ে ওঠাই নয়; নিজ পরিবারকে সাহায্য করার সামর্থ্যও তৈরি হয়েছে নারীদের।
'ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব দ্য চরস' নামই কেন?
রামধনু থেকে লাল রং এনে প্রেয়সীর পায়ে আলতা পরাতে চেয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের মতো প্রেয়সীকে সাজানোর জন্য না হলেও প্রকৃতি থেকে পাওয়া রং শাড়িতে ব্যবহার করে হাজারও তরুণীর মন ঠিকই জয় করে নিয়েছে 'কালারস অব চরস'। আর চরের অবহেলিত নারীদের হাতের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠে যেসব পোশাক, তাদের নাম যে 'কালারস অব চরস' হবে, সে আর অস্বাভাবিক কী!
তবে তাদের কাজের প্রক্রিয়া মোটেই সহজ নয়। প্রথমে সম্পূর্ণ পিওর সুতা তাঁতে বুনে কাপড় তৈরি করেন চরের নারীরা। এরপর বিভিন্ন গাছ-গাছড়া, ফলমূল, গাছের বাকর, গাছের পাতা, কাঠের গুঁড়ো ও সবজি থেকে তৈরি রং ব্যবহৃত হয় এসব শাড়ি-পোশাকে।
শিল্পবিপ্লবের আগে প্রাচীন বাংলায় এ ধরনের রঙের প্রচলন থাকলেও কিছুদিন আগপর্যন্ত শুধু আদিবাসী ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে এ ধরনের রঙের ব্যবহার দেখা যেতো। যদিও ভারতের বেশকিছু এলাকায় এখনো প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার দেখা যায়। এসব উৎস থেকে গবেষণা করেই প্রাকৃতিক রং বা ন্যাচারাল ডাইয়ের ধারণা নেওয়া হয়েছে।
তবে ন্যাচারাল ডাইয়ের পোশাক তৈরি হতে সময় প্রয়োজন হয় কিছুটা বেশি। একেকটি পোশাক তৈরি হতে গড়ে ১৫-২০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
আবারও সেই স্লো ফ্যাশন
মূলত শিল্পবিপ্লবের পর থেকে পুরো বিশ্বেই বস্ত্রশিল্পে আসে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। সেসময় পোশাক সেলাইয়ের ধরন, বিশেষ করে হাতে বোনা কাপড়ের পরিবর্তে মেশিনে তৈরি পোশাক কারখানার জয়জয়কার ছিল চোখে পড়ার মতো। কৃত্রিম রংয়ের ব্যবহারও বাড়তে থাকে সমানতালে। তবে এতে পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়।
তাই বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবেশকে কৃত্রিম রঙের কারণে সৃষ্ট দূষণ থেকে মুক্ত রাখতে সম্পূর্ণ হাতে বোনা কাপড় তৈরি ও প্রাকৃতিক রং তৈরির উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। তাদের এ উদ্যোগ মূলত স্লো ফ্যাশন হিসেবেই পরিচিত।
রাসায়নিক রং মূলত দুই প্রকার- অ্যাজো কালার ও অ্যাজো ফ্রি কালার। আবদুল জব্বারের ভাষ্যমতে, অ্যাজো কালার মানবপরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে ক্যান্সার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা থাকে। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন এসব রং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, অ্যাজো ফ্রি কালার তুলনামূলকভাবে অনেকটাই নিরাপদ হওয়ায় প্রাকৃতিক রঙের পাশাপাশি এ ধরনের রং ব্যবহার করেন তারা। যার ফলশ্রুতিতে দেশের বাইরেও সমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কালারস অব চরস- এর পণ্য। লুক্সেমবার্গ বা ইতালি, লন্ডন কিংবা জার্মানি অথবা প্যারিস থেকে ওইসব দেশের নিজস্ব পণ্যর অর্ডার দেন তারা। ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব দ্য চরসের একটি আউটলেটও রয়েছে লুক্সেমবার্গে। আমাদের দেশের মেয়েদের হাতের ছোঁয়ায় ঝলমলিয়ে ওঠে সেসব দেশের বাজার।
শাড়ি ও পোশাকের বাইরে এখানে পাওয়া যায় দারুণ সুন্দর সব মিনিয়েচার নৌকা। একসময় যেসব নৌকা বাংলার নদীপথে চলাচল করতো, এখন নদীতে সেগুলোর দেখা মেলে না। বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেসব নৌকা।
'কালারস অব চরস'- এর পোশাক কেন কিনবেন?
অন্যান্য জায়গায় তাঁতের শাড়ি তৈরিতে কিছুটা সিন্থেটিকের ব্যবহার হলেও এ জায়গা থেকে কালারস অব চরস সম্পূর্ণ আলাদা। সম্পূর্ণ হাতে বোনা ও প্রাকৃতিক রং ব্যবহার হওয়ায় এসব শাড়ি-কাপড়গুলো যথেষ্ট আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব। তাই একই সঙ্গে ফ্যাশন ও পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিদের পছন্দ এখানকার পোশাক।
কালারস অব চরস- এ কটন, হাফসিল্ক ও বাটিক শাড়ি পাওয়া যাবে ২ হাজার থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। সুতি, তাঁত, কটনের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী জামদানিও তৈরি করে কালারস অব দ্য চরস। ১০০ থেকে ২০০ কাউন্টের শাড়িগুলোর দাম ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকার মধ্যে।
শুধু শাড়িই নয়, কুর্তি, স্কার্ফ এবং ছেলেদের পাঞ্জাবিও পাওয়া যায় কালারস অব চরস- এর আউটলেটে। প্রাকৃতিক রং ও হাতে বোনা কাপড়ে তৈরি কুর্তি, পাঞ্জাবি ও স্কার্ফ মান ও ডিজাইনের দিক থেকে বেশ ভিন্নধর্মী। ১৫০০-৭০০০ টাকার ভেতর মিলবে এসব কুর্তি, পাঞ্জাবি।
'ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব দ্য চরস' থেকে একবার একটা সুতি শাড়ি কিনি। শাড়িটা পড়ে নিজেকে আয়নায় দেখতে এতোটাই ভালো লাগছিল, আর এতোটাই আরামদায়ক যে এরপর থেকে অনেকবার তাদের অনলাইন পেজ থেকে শাড়িসহ অন্যান্য অনেক পণ্য কিনেছি, এভাবেই নিজের অনুভূতির কথা জানালেন ফারিহা রহমান নামে এক ক্রেতা।
প্রসঙ্গত, প্রাকৃতিক রং ব্যবহারের জন্য পরিচিতি পাওয়া এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সাল থেকে সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শুরু করেছে নীলচাষ।