বাংলাদেশে ব্যতিক্রমী এক লাইব্রেরি—যেখানে কোনো বই নেই, আছে শুধু মানুষ
লাইব্রেরি কথাটি শুনলেই গৎবাঁধা চিন্তা থেকে আমাদের মাথায় আসে সারি সারি বই দিয়ে সাজিয়ে রাখা একটি ঘর, যেখানে পাঠকেরা নিঃশব্দে পছন্দের বই পড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু লাইব্রেরি মানেই কি শুধু ছাপানো বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পড়ে যাওয়া! জড়ো পদার্থ বইয়ে লেখা গল্পগুলো নিজেরা কথা বলতে পারে না, পাঠক গল্পগুলো পড়ার সময় নিজেদের কল্পনার মাধুরী দিয়ে সেগুলোকে জীবন্ত রূপ দেন। কিন্তু কেমন হতো যদি বই নিজেই নিজের গল্প বলতো?
'হিউম্যান লাইব্রেরি' অর্থাৎ মানুষের গ্রন্থাগার- যেখানে কাগজের ছাপানো বইয়ের পরিবর্তে থাকে 'জীবন্ত বই'। প্রতিটি মানুষের জীবনে এক ও একাধিক না বলা গল্প থাকে। নিজেদের জীবনের নানান চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প বলতে আসা গল্পকাররা এখানে বই হিসেবে থাকেন। পাঠক বা লাইব্রেরিতে আগতদের সামনে সেই গল্পের সংক্ষিপ্ত কাহিনী দেওয়া থাকে এবং কাহিনী পড়ার পর নিজেদের পছন্দমতো 'বই'কে বেছে নেন তারা।
লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবকেরা পাঠকদের তাদের পছন্দের বইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর মানব বইয়ের সাথে পাঠকরা গোল হয়ে বসে পড়েন, তার মুখ থেকে তার জীবনের গল্প শোনার জন্য; এবং পরবর্তী ২০/৩০ মিনিটের জন্য পাঠকরা যেন মানব বইয়ের গল্প শুনতে শুনতে তার জীবনের সাথে মিশে যান।
কমবেশি প্রায় প্রতিটি লাইব্রেরিতে লিখে রাখা থাকে 'নীরবতা বজায় রাখুন'। কিন্তু ব্যতিক্রমী হিউম্যান লাইব্রেরির আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এখানে ব্যানার করে লিখে রাখা হয় ''No Silence Please". অর্থাৎ দয়া করে এখানে কেউ নীরব থাকবেন না। এখানে বই শুধু কথা বলে তাই নয়, পাঠক মনে উদয় হওয়া নানান প্রশ্নও তারা মানব বইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন এবং দ্বিপাক্ষিক কথোপকথন হয় বই ও পাঠকের মধ্যে। এটাই হচ্ছে প্রচলিত লাইব্রেরির সাথে হিউম্যান লাইব্রেরির সবচেয়ে বড় পার্থক্য।
যেভাবে শুরু-
২০০০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহার্গে সর্বপ্রথম এধরনের লাইব্রেরির চল শুরু হয়। সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে গড়ে তোলা অলাভজনক এই সংস্থাটি বর্তমানে একধরনের নীরব আন্তর্জাতিক সামাজিক আন্দোলন বলা চলে । যেখানে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা বিষয়গুলোকে সামাজিক ধরাবাঁধা চিন্তার বাইরে গিয়ে ভাবতে শেখায় এবং মানুষের সাথে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ- নির্বিশেষে সকল পেশাজীবী মানুষ এখানে এসে নিজেদের কথা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। অন্যরা সে গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ায় পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভেদাভেদ দূর করে তাদেরকে আপন করে নিতে পারে।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ৩জন তরুণ উপমা রশিদ, মুশফিকুজ্জামান খান অপূর্ব, রাফসানুল হক হৃদয়ের উদ্যাগে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে হিউম্যান লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে এ ৩ বন্ধুর মনে হয়েছিল তারা সামাজিক পরিবর্তনে কিছু করতে চান। কিন্তু ঠিক কী করবেন- তা নিয়ে তাদের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অন্ত ছিল না।
বাংলাদেশ হিউম্যান লাইব্রেরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা 'উপমা রশিদ' বলেন, "সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘাঁটাঘাঁটি করতে যেয়ে একদিন হঠাৎ হিউম্যান লাইব্রেরির কার্যক্রম দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হই। তারপর এর মূল প্রতিষ্ঠাতাকে একটি মেইল পাঠিয়ে জানাই, আমরা বাংলাদেশে এধরনের লাইব্রেরি কার্যক্রম চালু করতে আগ্রহী। তিনি আমাদের উদ্যোগে প্রশংসা জানিয়ে সায় দেওয়ার পর আমরা একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে আর কোথা থেকে বই, পাঠক, স্থান, অর্থের জোগান আসবে এসব নিয়ে। তারপর ২০১৬ থেকে আমরা একটু একটু করে পরিকল্পনা করে এগোতে থাকি এবং বই হিসেবে তুলে ধরা হবে এমন ব্যক্তিদের গল্পগুলো শুনতে থাকি। তারপর সেখান থেকে বাছাই করে ১০টি বইকে নির্বাচন করি আমাদের প্রথম আয়োজিত সেশনের জন্যে"।
Don't Judge a book by its cover
'হিউম্যান লাইব্রেরি বাংলাদেশ' এপর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মিলে ৯টি সেশনের আয়োজন করেছে, যেখানে ৮টি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ও ১টি খুলনা শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি সেশনে বই হিসেবে ছিলেন ১০/১২ জন ব্যক্তি। বই ও গল্প বাছাইয়ে নারী, পুরুষ, ট্রান্সজেন্ডার সবাইকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আবার পেশার দিক থেকেও কোনরকম বৈষম্য বা ভেদাভেদ করা হয় না এক্ষেত্রে। যে গল্প মানুষের মাঝে আবেদন ছড়িয়ে দিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে ও চিন্তা করতে শেখাবে সেগুলোকেই বেছে নেওয়া হয়।
এব্যাপারে উপমা রশিদ আরও জানান, "আমরা আমাদের চারপাশের সবকিছুকে সামাজিকভাবে গঠিত চিন্তাধারার মাপকাঠিতে মেপে থাকি। কোনো মানুষকে দেখে তার সম্পর্কে বিশদ না জেনেই তার সম্পর্কে চিরাচরিত বদ্ধমূল প্রচলিত ধারণার ছাঁচে বসিয়ে বিচার করতে শুরু করি। এটা আমাদের গৎবাঁধা চিন্তার প্রতিফলন। যেমন- লোকটা পাঞ্জাবি পরেছে, আবার এতো বড় দাড়ি আছে- তারমানে তিনি নিশ্চয় ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া। আবার কেউ ট্রাফিক পুলিশের কাজ করেন শুনলে অনেকে মনে করেন তিনি ঘুষ নেন। কেউ যৌনকর্মী পেশায় আছেন তারমানে তিনি খারাপ ব্যক্তি, আমরা তাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাই। এই যে আমাদের মধ্যে তাদের নিয়ে নানান রকমের প্রচলিত সামাজিক ধারণা কাজ করে; এবং সেটার ওপর ভিত্তি করে আমরা তাদেরকে বিচার করি- এর পরিবর্তন ঘটানোই হিউম্যান লাইব্রেরির মূল উদ্দেশ্য"।
"যখন এই মানুষগুলো (মানব বই) তাদের জীবনের গল্পগুলো বলতে আসেন, তখন তা পাঠকদের মধ্যে এক রকমের চিন্তার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তখন দেখা যায়- আমরা এই লোকগুলোকে বাইরে থেকে যেভাবে বিচার করছি, আসলে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন আদলের লোক বা তাদের জীবনের গল্পটা অন্য রকম। এজন্যই হিউম্যান লাইব্রেরির স্লোগান থাকে 'Don't Judge a book by It's Cover' অর্থাৎ কোন বইয়ের মলাট দেখেই তাকে বিচার করা ঠিক না। বইয়ের সামনে বসে তাদের জীবনের গল্পগুলো জানার পর সামাজিক চিন্তার বাইরে গিয়ে পাঠকরা তাদের সম্পর্কে ভাবতে শেখেন। তখন তাদের মাঝে অন্যের জন্য সহানুভূতি ও সম্মানবোধ কাজ করে। সব পাঠকের মধ্যে একইরকম পরিবর্তন আসবে বা গৎবাঁধা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারবে- এমনটা নাও হতে পারে। কিন্তু সমাজের একজনের মধ্যেও যদি পরিবর্তন আসে, তিনি তার মাধ্যমে হয়তো আরও অনেকের মাঝে পরিবর্তন আনতে পারবেন"।
সাধারণ চিন্তা থেকে অসাধারণ পরিবর্তন
৩ জন তরুণের সেই ছোট্ট উদ্যোগ এত বড় রূপ নেবে কে জানতো! প্রচার প্রচারণায় ও তারা খুব বেশি সরব ছিলেন না। তাই প্রথমবার ২০১৭ সালে ধানমন্ডির 'জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠে' লাইব্রেরি সেশনের আয়োজন করা হলে উদ্যোক্তারা আশা করেছিলেন বড়জোর সেখানে ৫০/৬০ জনের বেশি পাঠক উপস্থিত হবেন না। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই সেখানে তিন শতাধিকের ওপর পাঠক সমাবেত হতে দেখে তারা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে, তাদের মধ্যে ভাললাগাও কাজ করেছিল এই ভেবে যে- তাদের এই ধরনের চিন্তাকে মানুষ সাদরে গ্রহণ করছে। মানুষের মাঝে অন্য ব্যক্তিদের জীবনের গল্প শোনার আগ্রহ রয়েছে, তারা জানতে চায় এই মানুষদের কথা। নিয়মানুযায়ী লেখা ছিল প্রতিজন পাঠক পছন্দ অনুযায়ী- মাত্র একটি বই পড়তে পারবেন। কিন্তু পাঠকরা গল্প শুনতে এত বেশি আগ্রহী ছিলেন এবং অনুরোধের মাধ্যমে একেকজন ২/৩টি বইয়ের গল্পও শোনেন প্রথম এই সেশনে।
তারপর প্রতি দু-তিনমাস অন্তর অন্তর একেকটি সেশনের আয়োজন করেন তারা। ইএমকে সেন্টার, যাত্রা বিরতি ও ঢাকার বিভিন্ন অংশে অনুষ্ঠিত হয় লাইব্রেরি সেশনগুলো। গল্পের পটভূমি অনুযায়ী বইগুলোকে একেক ধরনের নাম দেওয়া হয়। তৃতীয় সেশনে নির্বাচিত বইগুলোর মধ্যে একটি গল্পের নাম ছিল- 'অ্যা সানসেট ইন মাই বডি'। এটি ছিল পারিবারিক যৌন নির্যাতনের শিকার এক নারীর গল্প। শারীরিক প্রতিবন্ধী একজন ব্যক্তির বিশ্বজয়ের গল্প ও উত্থান পতনের কাহিনিকে তুলে ধরতে বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছিল- 'দ্য ওয়ার্ল্ড রেস্ট ইন মাই ফিঙ্গারপ্রিন্টস'। এভাবে প্রতিটি সেশনে ভিন্নধর্মী গল্প ও সংগ্রামী মানুষদের বই হিসেবে বাছাই করা হয়। গল্প বাছাইয়ের কাজটি উদ্যোক্তারা খুব সূক্ষ্মভাবে করে থাকেন।
'নাহিয়ান বুসরা' একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। কিন্তু আর পাঁচজনের মতো সমানতালে লেখাপড়া চালিয়ে নিজের স্বপ্নের পথে একটু একটু করে হেঁটে চলেছেন। ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন। হিউম্যান লাইব্রেরি বাংলাদেশের দুইটি সেশনে তিনি বই হিসেবে নিজের গল্প অন্যদের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন। তার জীবনী গল্পকে বই হিসেবে দুইটি শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল- ১. ভিজ্যুয়ালি ইম্পায়ার্ড পার্সন ২. অ্যা বিম অব হোপ ইন দ্য সী অব ডার্কনেস।
কেমন ছিল তার গল্প বলার অভিজ্ঞতা ও কেন তিনি এখানে বই হিসেবে নিজের গল্প অন্যদের জানাতে এসেছিলেন- সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে-'বুসরা' খুব সাবলীলভাবে জানান, "আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে হিউম্যান লাইব্রেরি সম্পর্কে প্রথমবারের মতো জানতে পেরে খুব আগ্রহবোধ করি। তারপর এখানে এসে যখন নিজের পুরো জীবনের গল্প বললাম- সবাই খুব মনোযোগের সাথে আমার জীবনের গল্প শুনছিল। অনেকের ধারণা ছিল না আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাই। শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল। তাদের করা প্রশ্নের উত্তর দিতেও বেশ ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিলো তারা আমাদের জীবনের সংগ্রাম সম্পর্কে জানতে চান। এখানে গল্প বলতে এসে, আমার নিজের ভেতরে জমে থাকা অনেক কথা বলতে পেরে খুব ভালো লাগছিল। তারপর আবার আরেকটি সেশনেও আমাকে ডাকা হলে আমি খুব আনন্দের সাথে সেখানেও 'বই' হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম"।
বুসরার মতো 'মোহাম্মদ মহাসিন'ও হিউম্যান লাইব্রেরির দুটি সেশনে বই হিসেবে এসেছিলেন। বুসরার মতো তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও দুজনের গল্পটা ছিল ভিন্ন। জন্মটা স্বাভাবিক হলেও মাত্র পাঁচ মাস বয়সে তার পুরো শরীরে পোলিও বাসা বাঁধে, যা তার দুটো পা অচল করে দেয়। তারপর প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে উঠতে যেয়ে নিজের স্বপ্নকে জ্বলাঞ্জলি দিতে হয় মহাসিনকে। কিন্তু দীর্ঘ মনোবল ও উদ্যমের সাথে নিজ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো তিনি প্রতিবন্দীদের নিয়ে ক্রিকেট টিম গড়ে তোলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে তার মতো প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন পূরণে মশাল জ্বালিয়ে যাচ্ছেন।
নিজ অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বললেন, "হিউম্যান লাইব্রেরি বাংলাদেশ আমাদের মতো মানুষের কাজের প্রেরণা আরও বাড়িয়ে তুলছে। চলতে ফিরতে আমাদের অনেকের সাথে পরিচয় হয়, কিন্তু খুব কমজনই আমার লড়াইয়ের গল্প শুনতে চেয়েছে। এখানে বই হিসেবে উপস্থিত হতে পেরে অনেক ভালো লাগা কাজ করছিল। সবাই আমার গল্প শুনে বেশ অনুপ্রেরণা পেয়েছিল, যা আমাকেও জীবনে অনুপ্রেরিত করেছে। বর্তমানে হিউম্যান লাইব্রেরির সাথে যুক্ত রয়েছি এবং আমি চাই সামনের সেশনগুলোতেও অংশগ্রহণ করে মানুষের সাথে আমার কথাগুলো শেয়ার করতে। তাদেরকে বলতে চাই- আমি থেমে যায়নি, আর চাইলে সবাই নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। শুধু প্রয়োজন হেরে না যাওয়ার জন্য শক্ত মনোবল।"
সংস্থাটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা 'উপমা রশিদ' তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেন, " যে কেউ চাইলে আমাদের কাছে তাদের জীবনের গল্পগুলো লিখে পাঠাতে পারেন। সেখান থেকে আমরা আবেদনময়ী ও ভিন্ন গল্পগুলোকে বেছে নেই। আবার, খুব সাধারণ একজন ব্যক্তির গল্পও আমরা নির্বাচন করি। কারণ আমাদের হিউম্যান লাইব্রেরির উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণভাবে আমরা যা চিন্তা করছি, তা আদতে কতটা সঠিক সে উপলব্ধির জন্ম দেওয়া। গল্প বাছাইয়ে আমাদের সচেতন হতে হয়, কেননা আমাদের পাঠক শ্রেণী ৭ বছরের শিশু থেকে ৬০ ঊর্ধ্বে যেকেউ হতে পারেন। তাই সকলের ক্ষেত্রে গল্পগুলোর কতটা গ্রহণযোগ্য হবে এবং তারা সেটা কতখানি নিতে পারবেন, এইসব বিষয় বিবেচনায় রেখে গল্পগুলোকে আমাদের সাজাতে হয়। দেখা গেল, বীভৎস কোনো ঘটনা মানব বই তার পাঠকদের সাথে শেয়ার করার সময়- পাঠক ছোট শিশুটির মধ্যে সেটা ট্রমা হয়ে দাঁড়ালো। আবার, বইয়েরা তাদের জীবনে খারাপ কাজের অভিজ্ঞতাগুলো বলার সময় কোনও পাঠক ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে আঘাত করে বসলেন। এধরনেরর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে, তারজন্য প্রতিটি সেশনে আমাদের পুলিশ পারমিশন থেকে প্রটেকশন থাকে। অর্থাৎ পাঠক ও বই উভয়ের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেই সেশন আয়োজন করা হয়"।
আয়োজনের জন্য ফান্ড বা অর্থের জোগান কোথা থেকে করা হয়- এই ব্যাপারে সহ-প্রতিষ্ঠাতা উপমাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "আমরা যেহেতু শিক্ষার্থী থাকাকালীন এটি শুরু করেছিলাম, তাই তখন আমাদের কাছে এতো বড় আয়োজনের জন্য অর্থ ছিল না। এখানে গল্প বলতে আসা মানব বই থেকে উদ্যোক্তা ও লাইব্রেরিয়ান সবাই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিনা অর্থে নিজেদের ভালো লাগা থেকে কাজ করেন। আর স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে আমাদের উদ্যোগের কথা জানাই। অনেকেই বিনা ভাড়ায় আমাদেরকে স্থান দিয়েছেন, তাই আমাদের অর্থ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। এছাড়াও পরবর্তীতে 'এশিয়া ফাউন্ডেশন', 'ব্রিটিশ কাউন্সিল', বাংলাদেশের ব্রিটিশ দূতাবাস থেকেও আমাদেরকে ফান্ড দেওয়া হয়েছে"।
'সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চাই'
বর্তমানে 'হিউম্যান লাইব্রেরি বাংলাদেশের' সাথে সক্রিয়ভাবে রয়েছেন সহ-প্রতিষ্ঠাতা উপমা রশিদ ও রাফসানুল হক হৃদয়। শুরুর দিকে স্বেচ্ছাসেবক দলে ৩৮/৪০জন নিরলসভাবে কাজ করলেও; পরবর্তীতে ব্যক্তিগত জীবন ও চাকরির ব্যস্ততায় তাদেরকে এই পথ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এখনও তাদের অনেকে সেশনগুলোয় পাঠক হয়ে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে সংস্থাটির সাথে ১০/১২ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। সহ-প্রতিষ্ঠাতা ২ জন চান তাদের এই দায়িত্ব নতুন কিছু তরুণদের কাছে হস্তান্তর করতে। তাহলে তরুণদের উদ্যমে 'হিউম্যান লাইব্রেরি'র কার্যক্রম দেশের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে।
উপমা রশিদ ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনার বিষয়ে জানান, "আগামী ২ বছরের মধ্যে আমরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান লাইব্রেরির কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে তাদের মধ্যে থেকেই গ্রুপ তৈরি করে দায়িত্ব দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটলে তা পরবর্তী প্রজন্মের ওপর ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে। আর সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে গিয়ে সামাজিক প্রথাগত চিন্তায় আঁচড় কাটতে সক্ষম হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাক ও ড্যাফোডিলের সাথে ইতোমধ্যে আমরা আলোচনা করেছি। এটিকে ছড়িয়ে দিতে ধীরে ধীরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেও আলোচনা করব।"
'হিউম্যান লাইব্রেরি বাংলাদেশ' এ বছরের সেপ্টেম্বরে তাদের দশম সেশন আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে বই হিসেবে থাকবেন ২০ জন ব্যক্তি। এছাড়াও সংস্থাটি করোনাকালীন #Know your Heros" স্লোগানে ১০জন ব্যক্তির- যারা করোনার সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাদের নিয়ে আমেরিকান দূতাবাস ও হিউম্যান লাইব্রেরির যৌথ প্রয়াসে সংক্ষিপ্ত ডকুমেন্টারি করে- যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। তারা কেউই সামনের সারিতে কাজ করা কর্মী নন; অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিজ অবস্থান ও ইচ্ছাশক্তি থেকে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এছাড়াও সামাজিক নানান কাজে 'হিউম্যান লাইব্রেরি বাংলাদেশ' সংস্থাটি নিজেদের অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছে ও ভূমিকা রাখছে।