বিমানে লুকানো গোপন কম্পার্টমেন্ট, যেখানে প্রবেশাধিকার নেই কোনো যাত্রীর!
একটা বিশাল বিমানের মধ্যে এমন কিছু লুকানো স্থান আছে যা সাধারণ যাত্রী হিসেবে আপনার অজানা তো বটেই, আপনার কখনো সেসব স্থানে প্রবেশের অনুমতিই নেই। এই তথ্য কিছুটা নতুন ঠেকছে কি? কিন্তু হ্যাঁ, সেসব জায়গা আসলেই আছে এবং সেখানে পাইলট ও কেবিন ক্রুরা বিশ্রাম করেন। এই জায়গাগুলোর একটি কেতাবি নামও আছে, তা হলো ক্রু রেস্ট কম্পার্টমেন্টস।
তবে বিমানভেদে এই গোপন কামরাগুলোর অবস্থান ভিন্ন হয়। যেমন, আধুনিক বোয়িং ৭৮৭ বা এয়ারবাস এ৩৫০ এর মতো বিমানে এই কম্পার্টমেন্ট থাকে মূল কেবিনের উপরে, আপার ফিউজলেজে। কিন্তু পুরনো বিমানগুলোতে এগুলো কার্গো হোল্ড বা মূল কেবিনের মধ্যেই থাকতে পারে।
আবার এই কম্পার্টমেন্টগুলো জোড়ায় জোড়ায় অবস্থিত। যেমন: পাইলটের জন্য একটি, যা ককপিটের উপরে থাকে এবং সাধারণত এতে দুটি বাংক ও একটি রিক্লাইনার সিট থাকে। কেবিন ক্রুদের জন্য থাকে আরেকটি কম্পার্টমেন্ট, যেখানে সাধারণত ৬টি বা তারও বেশি বাংক থাকে। বিমানের পেছন দিকে যেখানে খাবার ও পানীয় প্রস্তুত করা হয়, সেখানে এই কম্পার্টমেন্টের অবস্থান।
ক্যাপসুল হোটেল!
বিমানের কর্মীদের বিশ্রামের জন্য বিশেষ কম্পার্টমেন্ট তৈরির নকশার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব মতামত বা পছন্দ ব্যক্ত করতে পারে। কিন্তু আসল মানদণ্ড অবশ্যই ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক নির্ধারিত। নিয়ম অনুযায়ী, বিমানের কর্মীদের বিশ্রামের স্থান এমন অংশে হতে হবে যেখানে শব্দ, গন্ধ বা কম্পন (ভাইব্রেশন) তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। শুধু তাই নয়, এটি হতে হবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণক্ষম এবং ক্রুরা যেন চাইলেই আলো কমাতে-বাড়াতে পারেন।
এখানেই শেষ নয়। বিমানের ক্রুরা যেন লম্বা হয়ে শুতে পারেন, তার জন্য বাংকগুলো ৭৮/৩০ ইঞ্চি হতেই হবে। সেই সাথে অন্তত ৩৫ কিউবিক ফুট জায়গা থাকতে হবে চারপাশে। পোশাক পরিবর্তন, প্রবেশ ও বাইরে বের হবার জন্যও অন্তত ৬৫ কিউবিক ফুট জায়গা থাকতে হবে।
তাই সব মিলিয়ে এই লুকানো কম্পার্টমেন্টকে যেন অনেকটা জাপানি ক্যাপসুল হোটেলই বলা চলে! জানালা নেই, ছোট্ট, কিন্তু আরামদায়ক এক জায়গা! আর নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য অক্সিজেন মাস্ক, সিট বেল্ট ও ইন্টারকমসহ সকল সুব্যবস্থা তো আছেই।
ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৮৭,৭৭৭ ও ৭৬৭ বিমানে কর্মরত ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট সুজানাহ কার বলেন, "এই জায়গাগুলো বেশ আরামদায়ক। প্যাডেড ম্যাট্রেস, বায়ু চলাচলের ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থাও আছে। তবে ৬ ফুটের উপরে লম্বা মানুষদের এখানে শুতে একটু অসুবিধাই হবে বৈকি!"
কিন্তু এসব কম্পার্টমেন্ট কি প্রথম শ্রেণীর আসনের চাইতেও ভালো?
সুজানাহ কারের উত্তর, "কখনো হ্যাঁ, কখনো না। প্রথম শ্রেণীর আসনের চেয়ে এই বাংকের প্রশস্ততা বেশি। কিন্তু যেহেতু এটা বাংক, মাথা তোলার জন্য উপরে খুব বেশি জায়গা থাকে না। আর যদি আপনার ক্লস্ট্রোফোবিয়া থাকে তাহলে আপনার দমবন্ধ লাগতে পারে।"
কেবিন ক্রুরা কতক্ষণ থাকেন এখানে?
লম্বা কোনো ফ্লাইটে যেসব কেবিন ক্রুরা দায়িত্ব পালন করেন, মোট সময়ের ১০ শতাংশ সময় তারা এই গোপন কম্পার্টমেন্টগুলোতে বিশ্রাম নেন। ঘন্টার হিসাবে এটি গড়ে দেড় ঘন্টা হতে পারে, যদিও এয়ারলাইন ও ফ্লাইটের সময়ভেদে বিশ্রামের সময় বাড়তে বা কমতে পারে।
তবে বিমানের কেবিন ক্রু, কর্মীদের কাছে এই গোপন কম্পার্টমেন্টগুলোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যেহেতু বিমানে খাওয়াদাওয়া বা কফি ব্রেকের জন্যও তাদের আর কোনো ব্যক্তিগত জায়গা নেই, তাই এই বিশ্রামের জায়গাটিই তাদের অনেক আপন ও আরামদায়ক। এসময় তারা যাত্রীদের ডাকে সাড়া দিতে ছোটেন না, নিজেদের পা ও পুরো শরীর-মনকেই বিশ্রাম দেন। নিজেদের আরও প্রস্তুত রাখেন যেকোনো পরিস্থিতির জন্য।
সিনিয়রদের প্রাধান্য
সাধারণত টেকঅফ ও ল্যান্ডিং এর সময় বিশ্রামের কম্পার্টমেন্টগুলো বন্ধ থাকে এবং কেবিন ম্যানেজার এগুলোর দেখাশোনা করেন। তদারককারী ব্যক্তিটি নিজেও একটি বিশেষ বাংক পেয়ে থাকেন বিশ্রামের জন্য, যেটি বিশ্রামের অংশের প্রবেশপথের কাছে অবস্থিত। এখানে ইন্টারকম থাকে যা দিয়ে পাইলট ও বাকি সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা যায়।
সুজানাহ কার জানান, বিমান শিল্পে ফ্লাইটের সময়সূচি থেকে শুরু করে বিমানের রুট, ছুটি-বিশ্রাম বিরতি সবকিছুতেই জ্যেষ্ঠদের প্রাধান্য দেওয়া হয়।
পাইলটদের বিশ্রামের জায়গা
কেবিন ক্রুদের থেকে পাইলটের বিশ্রামের জায়গা যে আলাদা তা আগেই বলা হয়েছে। ফ্লাইটের দূরত্ব ও সময়ের উপর ভিত্তি করে একটি বিমানে সর্বোচ্চ চারজন পাইলট থাকতে পারেন, তবে এর মধ্যে দুজনকে সবসময় ককপিটে থাকতে হবে। তাই তাদের বিশ্রামের স্থানও ককপিটের কাছেই। তাদের জন্য রয়েছে দুটি বাংক, পুরনো বিমানগুলোতে একটিও থাকতে পারে। তবে সেখানে বিশেষ একটি 'ইন-ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট' আসন বাদে বাকি সবকিছুই কেবিন ক্রুদের বাংকের মতোই।
ফিনএয়ার এর ডেপুটি ফ্লিট চীফ পাইল্ট আলেক্সি কুসমানেন বলেন, "আমি সেখানে বেশ আরামেই ঘুমোতে পারি।" তবে তার মতে, এ৩৫০ বিমানের বিশ্রাম এলাকা তুলনামূলক বেশি ভালো। "সেখানে চমৎকার পর্দা রয়েছে, তাপমাত্রাও বেশ ভালো নিয়ন্ত্রণ করা যায়, ভেন্টিলেশনও দারুণ এবং এটি আরো বেশি সাউন্ডপ্রুফ", বলেন তিনি।
এখন আপনার মনে কৌতূহল জাগতেই পারে যে বিমানের এই গোপন কম্পার্টমেন্টগুলো আসলে কোথায়? পরেরবার বিমানে উঠলে নিশ্চয়ই তীক্ষ্ণ-দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করবেন এগুলোর অবস্থান! তাই আগেই বলছি, হঠাৎ করে যদি পাইলট বা কেবিন ক্রুকে কোনো একদিকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখদন, তার মানে আপনি খুঁজে পেয়েছেন সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গা!
তবে এও মনে রাখবেন, এ বিষয়ে অতি কৌতূহল না থাকাই ভালো। কারণ যেহেতু এই বিশ্রামের স্থান তাদের ব্যক্তিগত জায়গা, তাই তারা মোটেও আপনার উপস্থিতিতে খুশি হবেন না!
সূত্র: সিএনএন