প্রতারকদের গ্রাম!
মাগুরার প্রত্যন্ত গ্রাম গোয়ালদাহের চা দোকানদার মিটুন কুমার বালা (২৬)। ছোট ব্যবসায়ী হলেও আর্থিকভাবে বেশ স্বাবলম্বী। শুধু মিটুনই নন, দৃশ্যমান কোনো আয় ছাড়াই বদলে গেছে মাগুরার দুটি গ্রামের কয়েকশ যুবকের আর্থিক অবস্থা। কোনো পরশপাথরের ছোঁয়ায় নয়, এসব যুবকের ভাগ্য বদলেছে প্রতারণার মাধ্যমে বিকাশ ব্যবহারকারীদের অর্থ হাতিয়ে। পুলিশ বলছে, ইতোমধ্যেই তারা মাগুরার শ্রীপুর থানার গোয়ালদাহ ও মহেশপুর নামে দুটি গ্রামের ১৩৫ প্রতারকের বিষয়ে তথ্য পেয়েছেন। যারা গ্রামে বসেই বিকাশের মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে।
চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে, চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড ও হালিশহর এলাকার শতাধিক বিকাশ গ্রাহক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। একের পর এক অভিযোগে তটস্থ নগর পুলিশ ঘটনার তদন্তে নেমে জানতে পারে, প্রতারণার এই টাকা যাচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দূরের মাগুরা জেলার দুটি গ্রামের বিভিন্ন বিকাশ নম্বরে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ সালাম কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করা প্রতারক চক্রের সদস্যরা গ্রাহক সেজে যান বিকাশ এজেন্টের দোকানে। সেখান থেকে কৌশলে ভিডিও করে নেন এজেন্টের নিবন্ধন বইয়ে লেখা নম্বরগুলো। সেই নম্বর পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাগুরায় অবস্থান করা প্রতারক চক্রের সদস্যদের কাছে। তারা বিকাশের 'কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তা' সেজে ফোন করে কৌশলে জেনে নেয় পিন নম্বর। এরপর হাতিয়ে নেয় গ্রাহকের টাকা।"
তিনি জানান, শনি ও রোববার মাগুরার শ্রীপুর থানার গোয়ালদাহ ও চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় অভিযান চালিয়ে যথাক্রমে মিঠুন কুমার বালা (২৬) ও হামিদুল মোল্লা (২২) নামে দুই জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের গ্রেপ্তারের পরই সামনে আসে ওই দুই গ্রামের মানুষের প্রতারণার অভিনব এই কৌশল। ইতোমধ্যেই হামিদুল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে প্রতারণার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। মিঠুন বালাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
এই চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের কৃষক ইমরান (২৫)। তিনি জানান, ৮ জুন সকালে চট্টগ্রাম থেকে তার ভাইয়ের পাঠানো ৫ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। কিছুক্ষণ পরে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে বিকাশ কর্মকর্তা পরিচয়ে কল করে ইমরানকে বলা হয়, তার ভাইয়ের জমা দেওয়া টাকায় দুটি জাল নোট আছে, তাই ইমরানের বিকাশ নম্বরটি লক করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিকারের আশায় ইমরান ওই অপরিচিত লোককে নিজের পিন কোডটি দেন। পরক্ষণেই ইমরানের বিকাশ একাউন্ট থেকে সব টাকা সড়িয়ে নেয় প্রতারক চক্র।
ইমরানের এই ঘটনার তদন্তে নেমে মাগুরার শ্রীপুর ইউনিয়নের দুটি গ্রামের বেশ কয়েকজনের বিষয়ে খোঁজ পায় চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেন, "১২ জুন বিকেলে মাগুরার গোয়ালদাহ থেকে প্রতারক দলের প্রধান মিঠুন কুমার বালাকে গ্রেপ্তার করি। পরে তার দেওয়া তথ্যে ১৩ জুন চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকা থেকে হামিদুলকে। হামিদুলের কাছে বিকাশের এজেন্টের নিবন্ধন বইয়ের ৩৬টি ভিডিও পাওয়া গেছে।"
পাটক্ষেতে আস্তানা, সারাদেশে নেটওয়ার্ক
এডিসি শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেন, "আমাদের টিম তিনদিন মাগুরায় অবস্থান করে। সরেজমিনে দেখা যায়, গোয়ালদাহ ও মহেশপুর গ্রামে পুকুর পাড়ে বা পাটের ক্ষেতে মাচার মত কিছু টং ঘর আছে। অধিকাংশ যুবকরাই সেই টং ঘরে আড্ডা দেয়। যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। তারা সেখানে বসেই একের পর এক মানুষকে বিকাশ বা রকেটের কর্মকর্তা সেজে ফোন করে। তারপর গ্রাহকদের কাছ থেকে পিন কোড হাতিয়ে নেয়। দুটি গ্রামে এমন ৭-৮টি চক্র রয়েছে। "
তিনি বলেন, "এমনই একটি টং ঘরের দায়িত্বে ছিলেন মিঠুন কুমার বালা, যাকে গোয়ালদাহ থেকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, সারা বাংলাদেশে তাদের প্রতারণার জাল আছে।"
অভিযানে অংশ নেওয়া গোয়েন্দা পুলিশের এসআই রুবেল বড়ুয়া বলেন, "আমরা আসামিদের গ্রেপ্তারে যতবারই অভিযান চালিয়েছি, তাদের কাউকেই বাড়িতে পাওয়া যায়নি। দিনের বেলায় তো নয়ই, এমনকি রাতের বেলাতেও কোনো বাড়িতেই পুরুষ সদস্যদের পাওয়া যায় না।"
"গ্রামের আশপাশে বিশাল বিশাল পাটক্ষেত। প্রতারক চক্রের সদস্যরা অধিকাংশ সময় ক্ষেতের ভেতরের টং ঘরে থাকেন। গ্রাম জুড়েই তাদের নেটওয়ার্ক। পুলিশ গ্রামে প্রবেশ করলেই সে খবর চলে যায় তাদের কাছে। মুহুর্তেই সবাই পালিয়ে যায়। এমনকি ১৩ থেকে ১৪ বছরের কিশোররাও এই প্রতারণায় জড়িত", যোগ করেন রুবেল।
স্থানীয়দের প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করে শ্রীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদুল গনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মহেশপুর ও গোয়ালদাহ গ্রামের ছেলেপেলেরা এসব কাজ করে। এটা এক সময় ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, প্রশাসনের তৎপরতায় এখন তা কিছুটা কমেছে। বর্তমানে প্রতারক চক্রের সদস্যরা গ্রামেই থাকছে না। এখন তারা পাশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসব প্রতারণা করছে। এদের সঙ্গে পাশের ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলা এবং রাজবাড়ির বালিয়াকান্দি গ্রামের অনেক অধিবাসীরা জড়িত।"
তিনি বলেন, "গত সাত-আট বছরে শ্রীপুর উপজেলাতেই অন্তত ত্রিশ জনকে চিনি যারা কয়েক বছর আগেও তেমন একটা বিত্তশালী ছিলেন না। কিন্তু তাদের উল্লেখ করার মতো কোনো উপার্জনের উৎস না থাকলেও তারা আলিসান জীবনযাপনই করছেন।"
শ্রীপুর থানার ওসি সুপদেব রায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অভিযুক্তরা প্রতারণাগুলো জেলার বাইরে করে। স্থানীয়ভাবে তেমন কোনো অভিযোগ পাই না, তাই আমাদের করারও কিছু থাকে না। মাঝে মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযোগ পেলে, আমরা আসামিদের গ্রেপ্তারে সহায়তা করি।"
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাগুরা জেলা পুলিশ সুপার জহিরুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।