ই-কমার্স ও অনলাইনে প্রতারণা ঠেকাতে কঠোর হচ্ছে সিআইডি
গত কয়েক বছরে, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, সোস্যাল মিডিয়া ও অনলাইনে বিনিয়োগসহ ঋণ প্রদানের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাজারো কোটি টাকা লুটে নেয়া ২৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এর মধ্যেই গত শুক্রবার রিংআইডি'র পরিচালক সাইফুল ইসলাম, রোববার এসপিসি ওয়ার্ল্ড-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান আল-আমিন প্রধান, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার এবং নিরাপদ শপডটকম-এর পরিচারলক ফারহানা আফরোজ অ্যানিসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান টিবিএস'কে বলেন, এর মধ্যে এসপিসি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান ও তাঁর স্ত্রী শারমীন আক্তারকে মানি লল্ডারিংয়ের মামলায় ও নিরাপদশপডটকমের পরিচালককে এক গ্রাহকের অর্থ আৎসাতের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এসব বিষয়ে সোমবার দুপুর বেলা বারোটায় মালিবাগে সিআইডি হেডকোয়ার্টারসের মিডিয়া সেন্টারে বিস্তারিত ব্রিফিং করে জানানো হবে।
জানতে চাইলে সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান টিবিএস'কে বলেন, "ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সাইবার স্পেস ব্যবহার করে কাস্টমারের সঙ্গে যে প্রতারণা করছে, এমন ব্যাপারে ছায়া তদন্ত করেছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। বেশ কয়েকটি ই-কমার্স সাইটের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ছদ্মবেশী ফর্মে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছে। আর্থিক নীতিমালা অনুযায়ী কোনো অবস্থায়ই তারা এটা করতে পারে না। যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাওয়া যাবে, সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলবে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
সিআইডির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ই-কমার্স এবং অনলাইন কেলেঙ্কারির বিষয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি হাই-কমান্ড বৈঠক হয়েছে। "সিআইডি অবশেষে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চলেছে এবং জালিয়াতির অভিযোগের বিরুদ্ধে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে অভিযান চালানো হবে," তিনি যোগ করেন।
অর্থপাচার ও আত্মসাতের সন্দেহভাজন ই-কমার্স, ই-লোন ও গেমিং অ্যাপ সাইটগুলো হলো- ইভ্যালি, রিংআইডি, ইঅরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, শিরাজগঞ্জ শপ, আলেশা মার্ট, আদিভান মার্ট, দালাল প্লাস, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস, কিউকুম, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, প্রিয়শপ, 24tkt.Ltd, নিডস ডটকম, নিরাপদ শপ, প্লে অ্যান্ড উইন, দারাজ, টিকটিকি, শপ আপ ই-লোনস, স্বাধীন, উঠাও ক্যাশ, র্যাপিড ক্যাশ, ই-শপ ইন্ডিয়া ও বিডি লাইক।
এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস:
এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে গত ২৬ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের কলাবাগান থানায় মামলা দায়ের করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এতে অনুমোদনহীন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা পরিচালনা করে ১ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলায় অভিযুক্তরা হলেন, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আল আমিন ও তার স্ত্রী পরিচালক সারমীন আক্তার এবং সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. ইসহাক। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) ইউনিট মামলাটি দায়ের করে।
অভিযুক্তরা ই-কমার্স ব্যবসার আড়ালে অনুমোদনহীন এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করছে বলে এজাহারে উল্লেখ করে সিআইডি। এতে বলা হয়, সাধারণ মানুষকে অধিক কমিশনের প্রলোভন দেখিয়ে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামে মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার কর্ মোবাইল ব্যাংকিং ও বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ করে।
সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের মাধ্যমে গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করা হয়। এসব লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোট ২২ কোটি ৫ লাখ টাকা জমা করা হয়েছে। উত্তোলন করা হয়েছে মোট ৪ কোটি ৭ লাখ টাকা।
অভিযুক্ত আল আমিন গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা প্রতিষ্ঠানটির হিসাব থেকে প্রতারণামূলকভাবে সরিয়েছেন। এতে সহযোগিতা করেছেন অভিযুক্ত শারমীন আক্তার ও মো. ইসহাক। পরে আল আমিন নিজ নামে ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের তিনটি গাড়ি ক্রয় করেন। এছাড়া সিটি ব্যাংকের একটি হিসাব থেকে ৩৫ লাখ টাকা তার স্ত্রী শারমীন আক্তারের নামের হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে সিআইডি আরো জানতে পারে, অভিযুক্তরাসহ অজ্ঞাত একাধিক লোকের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি অনুমোদনহীন এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করে।
সাধারণ মানুষকে লোভে ফেলতে তারা নানা ছক এঁকেছে। নতুন গ্রাহকদের অ্যাপে আইডি খুলে দিলে রেফার ও জেনারেশন বোনাস দেয়া। এছাড়া একটি আইডির ডাউনওয়ার্ডে নির্দিষ্ট সংখ্যক আইডি হলে বিদেশে ভ্রমণ, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, গাড়ি, ফ্ল্যাট ও কোম্পানির মুনাফার একটি অংশ দেয়ার কথাও বলা হতো।
গত বছর এমএলএম ব্যবসা ও প্রতারণার দায়ে প্রতিষ্ঠানটির ছয়জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এসপিসি ১১ মাসে ২২ লাখ ২৫ হাজার জনকে যুক্ত করতে সক্ষম হয়। এরই মধ্যে তারা হাতিয়ে নিয়েছে ২৬৮ কোটি টাকা।
এরপর তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর আল আমিনসহ ছয়জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু দুই মাসের ব্যবধানে জামিনে বের হয়ে ফের এসপিসির কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। কার্যক্রম গতিশীল করতে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে প্রতিষ্ঠানটির শুভেচ্ছাদূত করেন। বিষয়টি প্রচার করে যুবকদের আকৃষ্ট করতে থাকেন। কিন্তু দুই মাস না যেতেই চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেন মাশরাফি। এর কারণ হিসেবে মাশরাফি জানান, কোম্পানিটির ব্যবসার ধরন সম্পর্কে প্রথমে ভুল জানানো হয়েছিল তাকে।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির টিবিএস'কে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা বিস্তারিত তদন্ত করে দেখছি। প্রাথমিকভাবে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছি, এটি বাড়তে পারে। আত্মসাত্কৃত টাকার অংক বেশি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ তাদের ব্যাংক লেনদেনের পরিমাণ অনেক।
নিরাপদশপ ডটকম:
এর আগে ১২ জুলাই নিরাপদশপ ডটকম নামের প্রতিষ্ঠানের পরিচালক শাহরিয়ার খানকে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।
এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণার অভিযোগ পেয়েছে সিআইডিও। ডিবির উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, 'কিছু গ্রাহককে পণ্য দিয়ে সেটির রিভিউ দেখিয়ে প্রতারণা করে প্রতিষ্ঠানটি।'