করোনায় ঝুলে আছে ৯০ শতাংশ মামলা, আদালত খুলে দেওয়ার দাবি আইনজীবীদের
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা নাহিদা আক্তার (২৫)। ২০ বছর আগে তার বাবার কেনা জমিতে বাড়ি তৈরীর উদ্যোগ নেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তারই এক প্রতিবেশি ওই জমি নিজের দাবি করে আদালতে মামলা করেন। এর পরপরই করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় আদালতের নিয়মিত শুনানি। এ কারণে গত দেড় বছরেও বাড়ি তৈরীর কাজ শুরু করতে পারেননি নাহিদা, থাকছেন ঝুপড়ি ঘরে। উঠনেই নষ্ট হচ্ছে বাড়ি তৈরীর জন্য ক্রয় করা কয়েক লক্ষ টাকার ইট-বালি ও সিমেন্ট।
শুধু নাহিদা নয়, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে নিয়মিত আদালতের বিচারকার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ১৮৬টি। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই জমা হয়েছে অতিরিক্ত দুই লাখ ৪৪ হাজার মামলা। আইনজীবীদের হিসেবে গত এক বছরে দায়ের হওয়া মামলা গুলোর ৯০ শতাংশের বিচারকার্যক্রম বন্ধ আছে।
মহামারীর কারণে বিচারিক আদালতে সব ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার নিয়মিত বিচারকাজ (ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য, যুক্তিতর্কের শুনানি ও রায় এবং দেওয়ানি মামলায় আরজি গ্রহণ ও জবাব) বন্ধ রয়েছে।
জাহিদ হাসান নামে এক ভূক্তভূগী বলেন, "করোনা মহামারী শুরুর আগে আমার পরিবারের সদস্যদের উপর হামলা চালায় স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় দায়ের মামলার চার্জ গঠনের তারিখ ছিলো ২৭ মার্চ। কিন্তু এর একদিন আগে ২৬ মার্চ দেশব্যপি লকডাউন ঘোষণা হয়। গত এক বছর ধরে আসামিরা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হুমকি দিচ্ছে, তাদেরকে আদালতে যেতে হচ্ছেনা বলে তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। বিচার বিলম্বিত হওয়া মানে বিচার না হওয়ার সামিল। আমরা শঙ্কায় আছি।"
চট্টগ্রাম আইজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন বলেন, "গত এক বছরে চট্টগ্রামে হাজার হাজার মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু এসব মামলার ৯০ শতাংশ এখন ঝুলে গেছে। বিচারপ্রার্থীরা মামলা মাথায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে। বিশেষ করে ১৪৫ ধারার মামলা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সারাদেশে ভূমিদস্যূরা বেপরোয়া হয়ে গেছে। একদিকে থানায় মামলা নিচ্ছেনা, অন্যদিকে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ।"
আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম না থাকায় আইজীবীরা আর্থিক কষ্টে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, "চট্টগ্রাম আদালতে প্রায় ছয় হাজার আইনজীবী রয়েছে। শিক্ষানবীস, সহকারী মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। ভার্চুয়াল আদালতে সিনিয়র আইনজীবীদের শুধু মাত্র পাঁচভাগ মামলা পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছেন। এর বাইরে প্রায় ১২ হাজার মানুষ বর্তমানে বেকার অবস্থায় আছেন। একারণে তাদের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।"
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রকাশ্য আদালতে বিচারকার্য পরিচালিত হবে এটা হচ্ছে সাংবিধানিক রীতি। করোনা পরিস্থিতির কারণে ভার্চুয়াল আদালত চললেও এ কারণে নানামুখি সমস্যা তৈরী হচ্ছে। একদিকে মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে আইজীবীরা তাদের পেশা পরিচালনা করতে পারছেন না।"
"সাংবিধানিক অধিকার হলেও এখন কোথাও আগাম জামিন চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একইভাবে নানামুখী সংকটে মানুষ। যেহেতু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খোলার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই আমরা মনে করি স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালত খুলে দেওয়া দরকার।"- যোগ করেন আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস।
চট্টগ্রাম আইজীবী সমিতির সভাপতি মো. এনামুল হক বলেন, "স্বাস্থ্য ঝুঁকির যে যুক্তিতে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে, বাস্তবক্ষেত্রে তার কোনো প্রয়োগ নেই। আদালতের সব কাজ স্বশরীরে করতে হচ্ছে, শুধুমাত্র বিচারক মহোদয় শুনানিটা এজলাসে না উঠে উনার চেম্বার থেকে বা বাসা থেকে করছেন।"
চট্টগ্রামে ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রমও নিয়মিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, "কোনো কোন কোর্ট আছে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন চলছে। যেমন- নারী ও শিশু আদালত-৭ দুইদিন বসছে। নারী ও শিশু আদালত-৫ মাত্র একদিন তার কার্যক্রম চালু রেখেছে। গত আড়াইমাস যাবত একেবারেই বন্ধ রয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এ কারণে মোট ভূক্তভুগির ৫ শতাংশ মানুষও তাদের সেবা পাচ্ছেন না।"