করোনা অ্যাপের মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করছে ভারত?
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কন্টাক্ট ট্রেসিং সহজ করার জন্য গত এপ্রিলে 'আরোগ্য সেতু ' নামে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে আসে ভারত সরকার। ওই অ্যাপ উন্মোচনের পরপরই সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য মোবাইলে তা ডাউনলোড করে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়।
এরপর সেটি বাধ্যতামূলক করা হয় বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এবং পরবর্তীতে করোনার সংক্রমণ ছড়ানো এলাকার লোকজনের জন্যও এই অ্যাপের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। অ্যাপটি মোবাইলে ডাউনলোড না করলে ছয় মাসের জেল বা সাড়ে ১১০০ রুপি জরিমানার বিধানও রাখা হয়।
ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লির নয়দা এলাকায় বসবাস করেন রাজীব ঘোষ নামে ৫০ বছর বয়সী একজন কেমিস্ট। সরকার থেকে বাধ্যতামূলক করা এই অ্যাপটি তিনি ডাউনলোড করেননি। সরকারবিরোধী কোনো মনোভাব থেকে নয়, তিনি অ্যাপটি ডাউনলোড করেননি তার ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শঙ্কা থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, "আমি নিশ্চিত না সরকার আমার তথ্যগুলো কীভাবে ব্যবহার করবে। তারা যদি চায়, তাহলে এই অ্যাপের মাধ্যমে আমার লোকেশন ট্র্যাকিং করে আজীবন আমার ওপর নজরদারি করতে পারবে তারা।"
শুধু রাজীব ঘোষই নন, এরকম আপত্তি তুলেছে দিল্লির নয়দা এলাকার অনেক অ্যাক্টিভিস্টও। ফলে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে মে'র শেষদিকে অ্যাপটি ডাউনলোডের বাধ্যবাধকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার।
ভারত সরকার বলেছে, তারা অ্যাপ ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য এবং লোকেশনের তথ্য ডিলিট করে দেয়। কিন্তু সমালোচকদের মতে, ভারতের তথ্য সুরক্ষা আইনের ঘাটতি থাকায় কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হতে পারে। তাদের শঙ্কা, জনগণের এসব ব্যক্তিগত তথ্য বেসরকারি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে পারে সরকার অথবা করোনা পরবর্তী সময়েও এসব তথ্য দিয়ে নাগরিকদের ওপর নজরদারি করতে পারে।
১২০ মিলিয়নের বেশি ব্যবহারকারীর তথ্যের সুরক্ষা কতটুকু?
ভারত সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় কর্তৃক তৈরি করা করোনাভাইরাসের এই কন্টাক্ট ট্রেসিং অ্যাপটি প্লে স্টোরে ছাড়ার পর থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ডাউনলোড করা হয়েছে প্রায় ১২০ মিলিয়নের বেশি বার।
আরোগ্য সেতু নামে এই অ্যাপটিতে ব্যবহারকারীদের গতিবিধি এবং একজনের সঙ্গে অন্যজনের দূরত্ব পর্যবেক্ষণের জন্য সার্বক্ষণিক লোকেশন এবং ব্লুটুথ চালু রাখা হয়। ব্যবহারকারীদের অ্যাপটিতে তাদের নাম, ফোন নাম্বারম বয়স, লিঙ্গ, পেশা, শরীরের করোনার উপসর্গ এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য প্রদান করতে হয়।
অ্যাপে লগইন করার পরই প্রত্যেক ব্যবহারকারীর নামে একটি ডিজিটাল আইডি তৈরি হয়ে যায়। এই আইডির মাধ্যমে অ্যাপে পরবর্তী আপডেট দেওয়া যায়। প্রতি ১৫ মিনিট পর পর এই অ্যাপ গ্রাহকদের লোকেশন রেকর্ড করে রাখে।
যখন দুজন ব্যবহারকারী ব্লুটুথ রেঞ্জের মধ্যে আসে তখন অ্যাপ দুজনের ডিজিটাল আইডির তথ্য ও লোকেশন রেকর্ড করে রাখে। এই দুই ব্যবহারকারীর একজন যদি করোনায় আক্রান্ত হয় তখন সেই তথ্য দিয়ে কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজ শুরু হয়।
কন্টাক্ট ট্রেসিং নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবহার করা ২৫ টি অ্যাপ নিয়ে করা আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) এক বিশ্লেষণে ৫ তারকা রেটিংয়ের মধ্যে ভারতের আরোগ্য সেতু নামে এই অ্যাপটিকে তারা মাত্র দুই দিয়েছে। তারা বলছে, সরকার এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি তথ্য সংগ্রহ করছে। এরকম কন্টাক্ট ট্রেসিং একটি অ্যাপ চালু করেছে সিঙ্গাপুর সরকার যারা শুধুমাত্র ব্লুটুথের সাহায্যে কাজ করে। এমআইটির গবেষকরা সিঙ্গাপুরের অ্যাপটিকে ৫ তারকা রেটিং দিয়েছেন।
ভারতের অ্যাপটির ডেটা অ্যাকসেস এন্ড নলেজ শেয়ারিং প্রটোকলে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ভারতের যেকোনো মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অজ্ঞাত ডেটা শেয়ার করা যাবে। প্রটোকলে বলা হয়, যেকোনো ডেটা সার্ভারে রিসিভ হওয়ার ১৮০ দিন পর তা স্থায়ীভাবে ডিলিট করতে হবে।
তবে তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে কাজ করা অ্যাক্টিভিস্টরা বলেন, সরকার এই তথ্য ডিলিট করবে কিনা, সেটা জানার কোনো সুযোগ তাদের নেই।
এ বিষয়ে দিল্লির এক আইনজীবী সিএনএনকে বলেন, "এই ডেটাগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয় কিনা সেটা যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই এবং যে থার্ড পার্টির সঙ্গে সরকার ডেটা শেয়ার করে তারাও তথ্য স্থায়ীভাবে ডিলিট করে দেয় কিনা তা জানার কোনো উপায় নেই।"