ক্যাসিনো চালিয়ে ২৬ কোটি টাকা, ১২১ ফ্ল্যাটের মালিক এনু-রুপন সহোদর
মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা করে গত পাঁচ বছরে ২৬ কোটি টাকা ও ১২১টি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন দুই ভাই এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়া।
শান্তি নামের এক ব্যক্তি এবং নেপালি নাগরিক হ্যারির মাধ্যমে ক্যাসিনোতে জড়িয়ে পড়েন দুই ভাই।
দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে করা মানি-লন্ডারিং মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত ৮ আগস্ট ঢাকার একটি আদালতে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মেহেদি মাকসুদ।
আদালত ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য তারা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সেক্রেটারি জয় গোপালকে দৈনিক ৫০ হাজার টাকা দিতেন।
এই বিষয়ে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর জানান, দীর্ঘ তদন্তের পর এনু-রুপনের বিরুদ্ধে করা মানি লন্ডারিং মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তদন্তে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
গত বছরের ৫ মার্চ মানি লন্ডারিংয়ের এই মামলার তদন্ত শুরু করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। এই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওয়ারী থানায় মামলা করা হয়। এ মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার আছেন- এনামুল হক এনু, রূপন ভূঁইয়া, তুহিন মুন্সী, নবীর হোসেন শিকদার, সাইফুল ইসলাম ও জয় গোপাল সরকার। পলাতক আছেন- পাভেল রহমান, এনু-রুপনের তিন ভাই শহিদুল হক ভূঁইয়া, রশিদুল হক ভূঁইয়া, মেরাজুল হক ভূঁইয়া শিপলু। এছাড়া ভুলু চন্দ্র দেব নামের এক ব্যাক্তিও পলাতক রয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, এ মামলায় এনু-রুপনের কাছ থেকে ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা জব্দ করা হয়। এই দুজন সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতি একসঙ্গে করতেন। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো খেলাও মূলত তারা দুই ভাই তাদের অনুগত লোকজনদের দিয়ে চালাতেন।
ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য তাদের অপর তিন ভাই রশিদুল, শহীদুল, শিপলু এবং তাদের বেতনভূক্ত কর্মচারী মোবারক, করিম, আলী, বুলু, পাভেল রহমান, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সেক্রেটারি জয় গোপাল সরকার মিলিতভাবে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কর্মচারী তুহিন মুন্সী, নবীর হোসেন শিকদার, সাইফুল ইসলামসহ আরও অজ্ঞাত প্রায় ৫০-৬০ জন লোকদের দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করাতেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ক্লাবের দৈনিক ভাড়া অভিযুক্ত জয় গোপালের কর্মচারী সাইফুল ইসলাম সংগ্রহ করতেন। সাইফুল ইসলাম না থাকলে এনু-রুপনের কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন নবীর হোসেন শিকদার ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কর্মচারী তুহিন মুন্সী। এর বিনিময়ে সাইফুল ইসলাম দৈনিক ৪০০ টাকা বেতন পেতেন এনু ও রুপনের কাছ থেকে।
নবীর হোসেন শিকদার এবং তুহিন মুন্সীও দৈনিক ৪০০ টাকা হারে বেতন পেতেন। এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়া তাদের ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য কিছু নেপালি নাগরিকদেরও নিয়োগ দেন। নেপালি নাগরিকেরা ক্যাসিনো সরঞ্জাম সেট আপ করে দিত। ক্যাসিনো খেলা পরিচালনার জন্য এনু ও রুপন তাদের পছন্দসই লোকজনদের নিয়োগ দিতেন, যারা বিভিন্ন দিক সামাল দিত।
ক্যাসিনো খেলা পরিচালনার জন্য মোবারককে নিয়োগ দেওয়া হয়। মোবারক ছিলেন ক্যাসিনো বোর্ডের সেক্রেটারি। ওয়ান্ডারার্সের ক্যাসিনো বোর্ডের ভেতর কে কোথায় থাকবে এবং কার কী ভূমিকা থাকবে তা নির্ধারণ করে দিতেন মোবারক। বিনিময়ে মোবারক দৈনিক ১৫০০ টাকা বেতন পেতেন।
মোবারককে এ কাজে সহায়তা করতেন আলী। এর বিনিময়ে আলী দৈনিক ৮০০ টাকা বেতন পেতেন। বুলু ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো বোর্ডের মধ্যে একটি বোর্ড পরিচালনা করতেন। বুলু্র দৈনিক বেতন ছিল ১০০০ টাকা। ক্যাসিনো খেলা পরিচালনা করার জন্য স্থানীয় লোকজনসহ বাইরের সবকিছু ম্যানেজ করার দায়িত্ব ছিল করিমের উপর। এর বিনিময়ে তিনি দৈনিক ১৫০০ টাকা বেতন পেতেন। এছাড়া পাভেল রহমান ছিলেন এনু ও রুপনের অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি ও পরামর্শ দাতা।
সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এনু ও রুপন ভূঁইয়ার নামে শীটের ব্যবসা থাকলেও তাদের প্রধান উপার্জন হয়ে দাড়ায় ক্যাসিনো ব্যবসা। নগদ অর্থ দিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার কিনে রাখা শুরু করেন তারা। এক পর্যায়ে ক্যাসিনোর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ওয়ারি, গেন্ডারিয়া ও সূত্রাপুর এলাকায় বিভিন্ন জায়াগায় বহু জায়গা, বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনে রাখতে শুরু করেন।
তাদের নামে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মোট ১২১টি ফ্ল্যাট ও খালি প্লট এবং ঢাকার বাইরে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান ও কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া এলাকায় খালি প্লট কেনার তথ্য পাওয়া যায়। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালে এসব সম্পদ গড়ে তোলেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে আরও অপরাধের তথ্য পাওয়ায় গত বছরের ৩১ আগস্ট বংশাল থানায় মানিলন্ডারিংয়ের মামলা হয়।
সিআইডির তদন্ত থেকে জানা যায় যে, ২০১৪-১৫ সালের দিকে শান্তি নামে একজন ব্যক্তির মাধ্যমে এনু ও রুপন ভূঁইয়া ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ওয়ান টেন খেলার বোর্ড চালানোর সঙ্গে যুক্ত হন। ওয়ান টেন বোর্ডের পার্টনার হিসেবে তারা দুই ভাই দুই ধাপে চার লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন।
প্রায় ৩ বছর ধরে তারা এই বোর্ড চালান। এই ওয়ান টেন বোর্ড চালিয়ে তারা প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার টাকা পেতেন।
ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সেক্রেটারি মোবারক নেপালি নাগরিক হ্যারির সঙ্গে এনু ও রুপনের পরিচয় করিয়ে দেন।
হ্যারির মাধ্যমে এনু ও রুপন ভূঁইয়া ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো খেলার বোর্ড সেট আপ করেন। ক্যাসিনো খেলা ২৪ ঘন্টাই চালু থাকত।