খলিশা ফুলের মধু নিয়ে নৈরাজ্য
সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম সুন্দরবন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব অঞ্চলের মানুষরা প্রবেশ করেন সুন্দরবনে। তবে জীবিকার তাগিদে যারা সুন্দরবনে যান তাদের মধ্যে মৌয়ালদের ঝুঁকি থাকে সব চেয়ে বেশি। এ ছাড়া মাছ, কাঁকড়া ধরা ও গোলপাতা সংগ্রহ করতেও সুন্দরবনে যান বনজীবীরা।
কখনো কখনো বাঘের আক্রমণের শিকার হতে হয় এসব বনজীবীদের। জীবনও দিতে হয়েছে অনেক মৌয়ালকে। সেই মৌয়ালরাই বঞ্চিত মধুর ন্যায্য মূল্য থেকে। প্রকৃত লাভ লুফে নেয় মধ্যসত্ত্বভোগী প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সুন্দরবনের মধু নিয়ে চলে নৈরাজ্য। এই নামে বাজারে রয়েছে ভেজাল মধু।
সুন্দরবনের খলিশা গাছের ফুলের মধু সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। দামও বেশি এই মধুর। মূলত মে মাস থেকে জুলাই মাস খলিশা ফুলের মধু সংগ্রহের সময়। মে মাসের প্রথম দিকের মধু চকচকে ও দেখতে আকর্ষণীয়। বাকি দুই মাসের মধু একটু কালকে বর্ণের হয়ে যায়। খলিশা ফুল ছাড়াও সুন্দরবন থেকে গরান, বাইন ও গিবোর মধু সংগ্রহ করেন মৌয়াল।
খলিশার পরিচিতি
সুন্দরবনের অনেক গাছপালার ভিড়ে ছোট থেকে মাঝারি গড়নের একটি গাছ হলো খলিশা। এর বৈজ্ঞানিক নাম Aegiceras corniculatum.এটি গুল্ম বা ছোট বৃক্ষজাতীয় প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। প্রায় ৫-৭ মিটার পর্যন্ত বাড়ে। সুন্দরবনে খলিশা সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় না।
খলিশা ফুল ফুটলে সারা দিন মৌমাছি মধু সংগ্রহের জন্য ভিড় করে। বহুদূর থেকে সৌরভ পেয়ে মৌমাছি, প্রজাপতি ছুটে আসে। সুন্দরবনের প্রজাপতিরও পছন্দের ফুল এটি।
বিরল এই উদ্ভিদ সাধারণত সুন্দরবনে বিচ্ছিন্নভাবে জন্মে। সমষ্টিগতভাবে থাকে না। প্রচুর আলো পড়ে এমন পরিবেশে ভালো জন্মে। বনের অন্ধকার এলাকায় জন্মে না। লবণাক্ততার মাত্রা যেখানে বেশি সেখানে এরা ভালো থাকে। এটি ভারত, বাংলাদেশ, নিউগিনি, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ চীনসহ নানা দেশে জন্মে।
ফল দেখতে কিছুটা মটরশুঁটির মতো। লম্বায় প্রায় ৫-৮ সেন্টিমিটার। প্রতিটি ফলে একটি বীজ থাকে। বীজ থেকে চারা গজায়। খলিশার পাতা বিভিন্ন প্রজাতির মথ, ক্যাটারপিলারের খাবার। আদিবাসী কোনো কোনো গোত্রের লোকেরা পাতা কাঁচা বা তরকারি হিসেবে খায়। সিঙ্গাপুরের আদিবাসী মেয়েরা খোঁপায় খলিশা ফুল গোঁজে।
মধু সংগ্রহ
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন উপকূলীয় দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। ইউনিয়নের ৪০ হাজার বাসিন্দাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সুন্দরবন ও উপকূলীয় নদীর উপর নির্ভরশীল। গাবুরা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের সোরা গ্রামের বাসিন্দা মহসিন আলম। সুন্দরবনে গিয়ে মধু সংগ্রহ করেন এই মৌয়াল।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি জানিয়েছেন সুন্দনবন থেকে মধু সংগ্রহের প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা ও প্রতিবন্ধকতা। মহসিন আলম জানান, মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে প্রথমে ঠিক করা হয় ১০-১২ জনের একটি মৌয়াল দল। মহাজনের কাছ থেকে সুদ হিসেবে টাকা নিয়ে লাখ টাকায় এক মাসের জন্য নৌকা ভাড়া করা হয়। এরপর নৌকায় পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে গহীন সুন্দরবনের মধ্যে সুবিধাজনক স্থানে যাওয়া হয়। একটি জায়গায় নৌকা নোঙর করে ভাগ হয়ে ডুকে পড়া হয় সুন্দরবনের গহীনে।
কিছুক্ষণ পর পর কু কু শব্দে সংকতে দিয়ে সকলের অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। ৫০-১০০ হাত দূরত্বে প্রতিজন খুঁজতে থাকে মৌমাছির আস্থানা। একজন একটি আস্তানা খুঁজে পেলে সংকেত দিয়ে সকলকে একত্রিত করেন।
তিনি বলেন, মধু রাখার পাত্রটি যিনি বহন করেন তাকে বলা হয় কাড়িয়ালা। আর মৌচাক থেকে মৌমাছি তাড়ানোর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে বলা হয় কাড়–য়ালা আর একজন মধু কাঁটে। তিনটি ভাগে বিভক্ত মৌয়াল দলটি। মধু সংগ্রহ করলে কাড়িয়ালা সেই মধু নৌকায় গিয়ে রেখে আসে।
খলিশা মধুর লাভ পান মধ্যসত্ত্বভোগীরা
খলিশা ফুলের মধু সব থেকে বেশি দামি ও আকর্ষণীয় উল্লেখ করে মহসিন আলম জানান, মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে খলিসা ফুলের মধু সংগ্রহ করতে হয়। মে মাসের প্রথম দিকের মধু সব থেকে ভালো। পরের দুই মাসের মধু কালচে হয়ে যায়। মধু সংগ্রহ করে সুন্দরবন থেকে ফেরার পর বিক্রির পর্ব শুরু হয়।
তিনি আরও বলেন, লাখ টাকা সুদে নেওয়া মহাজনের কাছে মধু বিক্রি করলে প্রতি মণ মধুর মূল্য দেওয়া হয় ১০-১২ হাজার টাকা। সেই মধুর বাজারমূল্য ১৫-১৬ হাজার টাকা। মহাজনের কাছে বিক্রি না করলে মধু বিক্রির টাকায় ভাগ দিতে হয় মহাজনকে।
''জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রহ করা এই খলিশা ফুলের মধু বিক্রি করি ৩৫০-৩৮০ টাকায়। প্রভাবশালীরা অল্প দামে নিয়ে বাইরে বেশি দামে বিক্রি করে। এরপর তা চলে যায় রাজধানীসহ সারাদেশে। এ ছাড়া সুন্দরবনের মধুর নামে ভেজাল মধুও রয়েছে বাজারে।'' যোগ করেন তিনি।
মধু সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়ে মৌয়াল মহসিন জানান, 'বনবিভাগ থেকে বিএলসি (বোর্ট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) নিয়ে মৌয়ালরা সুন্দরবনে প্রবেশ করে। অধিকাংশ মৌয়ালরা সুন্দরবনে ঢুকে যায় চুরি করে। বিএলসি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশের পরও সুন্দরবনের গহীনে বন বিভাগের ফরেষ্টারদের নৌকা প্রতি সপ্তাহে এক হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া প্রতিমণ মধুতে ভাগ দিতে হয় দুই কেজি। মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে অনেক মৌয়ালকে বিভিন্ন সময় প্রাণ হারাতে হয়েছে।'
তবে নৌকা প্রতি টাকা ও মধু নেওয়ার বিষয়ে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক আবুল হাসান বলেন, 'এমন অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারলে সেই ফরেষ্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য বিএলসি (বোর্ট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) রয়েছে ২৬০টি। প্রতি বিএলসিতে মৌয়াল ৬ জন। সে হিসেবে জেলায় মৌয়াল রয়েছে ১৫৬০ জন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষ রয়েছে ৫০ হাজারেও বেশি।
১৮ বছরে সুন্দরবনে মারা গেছেন ২০৭ জন
২০০১ সাল থেকে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে আহত ও নিহত হওয়ার পরিসংখ্যান লিপিবন্ধ শুরু করে বন বিভাগ। বন বিভাগের তথ্যে, ২০০১-২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে গিয়ে নিহত হয়েছেন ২০৭ জন। আহত হয়েছেন ৪৩ জন। ২০১০ সালের বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত মানুষদের জানমালের ক্ষতিপূরণ নীতিমালার আলোকে নিহত ৫৮ জনের পরিবারকে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা ও আহত ১৮ পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
মধু নৈরাজ্য
মৌয়ালদের সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করা মধু বাজারজাত হওয়ার পর শুরু হয় মধু নৈরাজ্য। সুন্দরবনের এই মধুর নামে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে বিক্রি করেন ভেজাল মধু। চিনি জ্বালিয়ে কৃত্রিম উপায়ে তৈরী করা মধু, বাণিজ্যিকভাবে বাক্স পেতে বিভিন্ন ফুল থেকে মৌমাছির সংগ্রহ করা মধুকে সুন্দরবনের মধু বলে বাজারে বিক্রি করেন এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা। সুন্দরবনের মধুর দাম বেশি হওয়ায় এই অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেন ব্যবসায়ীরা।
শ্যামনগর সদরের গাজী ইমরান হোসেন জানান, বছর খানেক আগে ভেজাল মধু উদ্ধার হয়েছিল শ্যামনগরে। একটি অসাধু চক্র রয়েছে যারা বেশি লাভে মধু বিক্রির আশায় ভেজাল মধু তৈরী করে বাজারজাত করে। ওই মধুতে শরীরে উপকারের থেকেও স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। কিন্তু এসব ভেজাল মধু প্রথমে দেখে বোঝার উপায় নেই। কিছুদিন রাখার পর নিচে চিনি জমে থাকে। তখন বোঝা যায় মধুটি ভেজাল।
মধু সরবরাহ
গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের মৌয়াল রফিকুল ইসলাম জানান, 'খলিশা ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে জমা করে। মৌমাছির সেই মৌচাকগুলো আমরা সংগ্রহ করি। এরপর নৌকায় ফিরে চেপে চেপে মৌচাক থেকে মধু বের করে ছোট ছোট ড্রামে সংরক্ষণ করে রাখি। এরপর সেগুলো ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে দেওয়া হয়। তারপর বিভিন্ন মাধ্যমে সেগুলো পৌঁছে যায় রাজধানীসহ সারাদেশে।'
শ্যামনগর সদরের মধু বিক্রির বড় দোকান মধুর ক্যান্টিন। মধু বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়া উল্লেখ করে দোকান মালিক শাহিনুর রহমান জানান, 'আমি সারাদেশেই কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মধু পাঠাই। অনলাইন, ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে এ অর্ডার পাই। এ ছাড়া এখন দোকানের পরিচিতি হয়ে গেছে। সকলেই সুন্দরবনের মধুর জন্য যোগাযোগ করে। আজ (বৃহস্পতিবার) চাঁদপুর, জালালপুর, সুনামগঞ্জ, ঢাকায় ৪৪ কেজি মধু পাঠিয়েছি। আমি খলিশা ফুলের মধু খুচরা বিক্রি করি ৮০০ টাকায়, পাইকারি দোকানে বিক্রি করি ৯০০-৯৫০ টাকা।'
শ্যামনগর উপজেলা সদরে অনলাইনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে মধু বিক্রি করেন মুজাহিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, 'সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধু সব থেকে ভালো। খলিশা ফুলের খাঁটি মধু প্রতি কেজি বিক্রি করি ৭০০-৮০০ টাকায়।'
ভেজাল মধু
উপকূলীয় শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলাসহ জেলা সদর ও জেলার সকল উপজেলাতে কমবেশি মধু ব্যবসায়ী রয়েছেন। যারা বিভিন্নভাবে মধু সংগ্রহ করে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেন। বাড়ির জন্য মধু কিনে বিপাকে পড়েছেন তালা সদরের শিবপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম।
তিনি জানান, তালা বাজারের একটি দোকান থেকে এক কেজি মধু কিনেছি ১৫ দিন আগে। বাড়িতে আনার পর এখন দেখছি বোতলের নিচে চিনি জমেছে। বোঝা গেছে, মধুটি ভেজাল।
সাতক্ষীরা বিসিক শিল্পনগরীর উপ ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) গৌরব দাস জানান, জেলায় নিবন্ধিত ৮০০ জন মৌচাষী রয়েছে। নিবন্ধনের বাইরেও মৌচাষী রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫০০ জন মৌচাষী রয়েছে জেলায়। বর্তমানে এসব মৌচাষীরা বিএসটিআই করে বিপননের দিকে ঝুঁকছে। জেলার বিভিন্ন বাজারে দোকানগুলোতে এসব মৌচাষীরা মধু সরবরাহ করেন।
তিনি বলেন, '২০১৭ সাল পর্যন্ত 'মৌমাছি প্রকল্প' নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এ সকল মৌচাষীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনেও দুটো প্রোগ্রাম করা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০-২৫ হাজার টাকা করে এসব মৌচাষীদের সরকারি ঋণ দেওয়া রয়েছে। তবে তারা সেটি পরিশোধ করেন না।'
সাতক্ষীরা জেলা মার্কেটিং অফিসার এস এম আব্দুল্লাহ্ বলেন, 'সুন্দরবনের মধুর জনপ্রিয়তা ও সুনাম রয়েছে সারা দেশে। মধুর সরকারি বাজার দর ৫৫০ টাকা। কোনটি খাঁটি মধু বা কোনটি ভেজাল সেটি আমাদের পরীক্ষা করার সুযোগ নেই। এটি বিএসটিআইয়ের কাছে থাকে।'
তিনি বলেন, 'কিছু অসাধু মধু ব্যবসায়ী রয়েছে শ্যামনগরে। তারা সুন্দরবনের খাঁটি মধুর নাম করে ভেজাল মধু সরবরাহ করেন এমন মৌখিক অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'