গ্রাহকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলছে পুনর্ব্যবহৃত সিম
গত ৩রা মার্চ রাজধানীর কলাবাগানের বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহর কাছে একটি এসএমএস আসে। তিনি তখন তার কর্মস্থলে ছিলেন। এসএমএসটিতে লেখা ছিল, "আপনার ডাচ বাংলা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।"
উদ্বিগ্ন মাসুম সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের হটলাইন নাম্বারে ফোন করে নিশ্চিত হন যে, তার অ্যাকাউন্ট থেকে এই টাকা তোলা হয়নি।
পরে মাসুম প্রায়ই তার কাছে আসা অপরিচিত লোকজনের ফোন এবং ব্যাংক থেকে পাঠানো সে এসএমএসের কারণ উদ্ধার করতে পারেন। সম্প্রতি তিনি যে সিম কার্ডটি কিনেছেন তার পূর্বের ব্যবহারকারীর সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে বলেই এতসব বিভ্রান্তি!
এদিকে মধ্যরাতে ফোন বেজে ওঠার শব্দে তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেমে আসেন বনশ্রীর বাসিন্দা, গৃহবধূ জাহানারা বেগম। রাতে ফোন আসায় তিনি আতংকিত হয়ে ওঠেন; তার ভয় হতে থাকে যে- হয়তবা দেশের বাড়ি থেকে কোন খারাপ সংবাদ আছে। নইলে এত রাতে কেউ এভাবে কেন ফোন করবে!
ফোনটি ধরার পর জাহানারা বুঝলেন, ফোনের ও প্রান্তের ব্যক্তিটি অন্য কাউকে চাইছে। তার দাবি, এই ফোন নাম্বার তার বন্ধুর।
জাহানারা পাঁচ মাস আগে এই সিমটি কেনেন, ইদানিং নিয়মিতই তিনি এ জাতীয় ফোন পাচ্ছেন।
মাসুম ও জাহানারার মতো, অনেক গ্রাহকই এই অপ্রত্যাশিত সমস্যায় পড়ছেন। অনেকে আবার সিমের প্রাক্তন গ্রাহকদের সম্পর্কে নানাবিধ তথ্যও জেনে যাচ্ছেন।
তথ্য ভুল মানুষের হাতে এসে পড়লে তা সামাজিক এবং আর্থিকভাবে হুমকি সৃষ্টির কারণ হতে পারে।
বিপরীতে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সিম কার্ড নতুন ব্যবহারকারীর জন্যও কখনো কখনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সিমটির প্রাক্তন গ্রাহকের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের কাছ থেকে আসা ফোন এবং বার্তা তার জন্য বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে।
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) জানিয়েছে, এই মুহূর্তে দেশে সক্রিয় সিমকার্ডের সংখ্যা ১৭ কোটি ৩৩ লাখ। তবে মোবাইল ফোন অপারেটররা সম্মিলিতভাবে এর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক সিমকার্ড বিক্রয় করেছে।
একেবারে নতুন সংখ্যার পরিবর্তে, সাধারণত যেসব সিম ৪৫০ দিনের অধিক সময়ব্যাপী অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে, সেগুলোকে পুনর্ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে থাকে বিটিআরসি। টেলিফোন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ জানায়, ভারতে এই সময়সীমা ৯০ দিনের।
অব্যবহৃত সিমকার্ড পুনরায় সচল করে মোবাইল অপারেটররা অন্য গ্রাহকের কাছে তা নতুন করে বিক্রয় করে।
গ্রামীণফোন এবং রবি সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবরে বন্ধ থাকা বিভিন্ন সিম পুনরায় চালু করে। সে সকল ফোন নম্বর নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার আগে, উভয় অপারেটরই তাদের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশ জারি করে যেন, সেসব সিমের গ্রাহকেরা এ সম্পর্কে অবগত থাকে।
কিন্তু বেশিরভাগ গ্রাহকই এ বিষয়ে কিছু জানে না।
সে কারণেই পুরনো ব্যবহারকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা বা জমার মত একান্ত গোপনীয় তথ্যও সিমের নতুন মালিকের কাছে চলে যায়।
ব্যাংক কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানান, এ প্রবণতার ফলে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক অপরাধের ঝুঁকি বাড়বে।
যতক্ষণ পর্যন্ত না পূর্ববর্তী ব্যবহারকারী ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, পাসপোর্ট এবং অন্যান্য নথিতে তার সাথে যোগাযোগের জন্য দেয়া ফোন নম্বরটি পরিবর্তন না করবেন, ততক্ষণই অপ্রত্যাশিতভাবে তথ্য ছড়িয়ে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা থাকবে।
কয়েকজন গ্রাহক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সিম সচল রাখতে মোবাইল অপারেটররা ফোন কলের মাধ্যমে তাদের নিজেদের নম্বরে রিচার্জ করতে বলেছিলেন; কিন্তু অব্যবহৃত থাকা সিম পুনর্ব্যবহারের বিষয়ে তাদের কখনো জানানো হয়নি।
দীর্ঘদিন পড়ে থাকা সিম কার্ড নিষ্ক্রিয় ও পুনর্ব্যবহারের আগে টেলিকম সংস্থাগুলোর অবশ্যই গ্রাহকদের জানানো উচিত বলে তারা মন্তব্য করেন।
পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক কামরুল আহসান বলেন, অসাধু লোকজন ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে এমনকি ঋণ পর্যন্ত নিতে পারে।
"তাছাড়া এভাবে তথ্যের অনুপ্রবেশ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন", যোগ করেন তিনি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রিসাইকলড বা পুনর্ব্যবহৃত এসব সিম থেকে নতুন ব্যবহারকারীরা ব্যাংকের নাম, অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স, অ্যাকাউন্ট নম্বরের মত প্রাথমিক তথ্য জেনে যেতে পারেন।
অ্যাকাউন্ট নম্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য। কখনো কাউকে উস্কে দেয়া হলে, তারা চেক বইয়ের জাল অনুলিপি তৈরি করতে পারে যা পরে আর্থিক বিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সতর্কতাস্বরূপ তাই তারা 'কখনও ফোনে ব্যাংক একাউন্ট নম্বরের সবগুলো সংখ্যা প্রেরণ করেন না' বলে জানালেন মাহবুবুর।
আইসিটি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, অনেকেই একাধিক সিমকার্ড ব্যবহার করে থাকেন, কেউ কেউ বছরের পর বছর দেশের বাইরেও কাটান। সেদিক থেকে সিমের ডিএকটিভেশন পিরিয়ড বা নিষ্ক্রিয় রাখার সময়টুকু খুব একটা দীর্ঘ নয়।
অব্যবহৃত সিম ডিএকটিভেট বা নিষ্ক্রিয় করার আগে মোবাইল অপারেটরদের কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ বছর অপেক্ষা করা উচিত। ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও গ্রাহকের যোগাযোগের তথ্য নির্দিষ্ট বিরতিতে যাচাই করা উচিত বলে জানান সুমন।
অব্যবহৃত সিম কার্ড পুনরায় বিক্রয়ের আগে নির্দিষ্ট একটা 'টাইমফ্রেম' বজায় রাখার ব্যাপারে বিটিআরসির ভাইস-চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, "প্রতিটি সিমকার্ডের জন্যই নিয়মিত লেনদেন প্রক্রিয়া বজায় রাখতে হবে। কোন সিম যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে, তাহলে মোবাইল অপারেটররা সিমটি সচল রাখতে পারেন না।"
তবে গ্রাহকের নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করেননি।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: SIM recycling puts mobile users' safety at risk