ঘাতক ময়লার ট্রাক ও একটি স্বপ্নের করুণ পরিসমাপ্তি
ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, শুধু আইন পড়বার নেশায় উচ্চ মাধ্যমিকে চলে যান মানবিক বিভাগে। স্বপ্ন ছিল বিচারক হবেন, দেশের মানুষকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে কাজ করবেন। কামরাঙ্গীরচরের বাসা থেকে কলেজে যাওয়া-আসার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সুযোগ পেলেই চলে যেতেন শহীদ মিনারের পাশে থাকা আইন অনুষদ ভবনের সামনে। ইচ্ছে ছিল ভর্তি হবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। অথচ এই কিশোরের মৃত্যুর বিচার চেয়ে এখন রাস্তায় নেমেছেন তার সহপাঠীরা। নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের বিচারক হবার স্বপ্নকে এভাবে পিষে দিয়ে গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ট্রাক।
বুধবার সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে রাজধানীর গুলিস্তানে সিটি হল মার্কেটের সামনের রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন নাঈম। এ সময় সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি প্রথমে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পরে সামনের চাকা দিয়ে পিষে দিয়ে যায়, এভাবেই ঘটনার বীভৎস বর্ণনা দেন প্রত্যক্ষদর্শী আমিনুল ইসলাম ফাহিম।
তিনি বলেন, 'ট্রাকটি ধাক্কা দেওয়ার পরেই রাস্তায় পড়ে যায় নাঈম, এরপর তো সামনের চাকা তার ওপর উঠিয়ে দেয়। রক্তে ভিজে যায় হালকা ঘি রংয়ের শার্ট, হয়তো পিষে না গিয়ে গেলে তাকে বাঁচানো যেত।'
ছেলে হারানোর শোকে আহাজারি করছেন নাঈমের বাবা শাহ আলম দেওয়ান। তার কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে কামরাঙ্গীরচর ও তাদের গ্রামের বাড়ির পরিবেশ।
নাঈমের বাবা মো. শাহ আলম দেওয়ান আহাজারি করতে করতে বলেন, 'আমার বাবা সকালে শেষ বিদায় নিয়া গেল, বাসায়ও আর ফিরতে পারল না। কী জন্য তোরে শেষ বিদায় দিছি! ও নাঈম রে, তোরে আমি কেন একা যাইতে দিলাম।'
শাহ আলম দেওয়ান জানান, তার দুই ছেলে। বড় ছেলে শাহরিয়ার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র। আর নাঈম হাসান নটরডেম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের মানবিক বিভাগের ছাত্র। পরিবার নিয়ে কামরাঙ্গীরচর ঝাউলাহাটি চৌরাস্তা এলাকায় নিজেদের বাড়িতে থাকেন। শাহ আলম নীলক্ষেত বই মার্কেটে চাকরি করেন।
তিনি বলেন, 'সকাল ৭টার সময় নাঈম বাসা থেকে বের হয় কলেজে যাওয়ার জন্য। বেলা ১২টার দিকে বাসায় ফেরার কথা ছিল তার। এর আগে নাঈমের ফোন থেকে পুলিশ কল দিয়ে জানায়, নাঈমকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর তো গিয়ে দেখি আমার ছেলের রক্তাক্ত লাশ। কী সুন্দর ইউনিফর্মটা রক্তে ভেসে গেছে।'
সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পেনশনের টাকা দিয়ে কামরাঙ্গীরচরে একটুকরো জমি কিনে বাড়ি করেন শাহ আলম দেওয়ান। পরিবারে আর্থিক অনটন না থাকলেও দুই ছেলের পড়শোনার ভালোভাবে চালিয়ে নিতে নীলক্ষেতে ছোটখাটো একটা চাকরি নেন তিনি। নিজে ছোট চাকরি করলেও ইচ্ছে ছিলে ছেলেদের বড় করবেন, প্রতিষ্ঠিত করবেন।
"নবম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই নাঈমের আইনের ব্যাপারে ঝোঁক তৈরি হয়। তবে কখন, ঠিক কীভাবে এই ভালোবাসা তৈরি হয়, আমরাও বলতে পারবো না। তবে আমরাও আর তাকে বাধা দেইনি। চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হবার চেয়ে বিচারক হতে চাওয়াতেও তো কোনো ক্ষতি নেই,' শাহ আলম বলেন।
নাঈমের সহপাঠী তাহসিন আহমেদ বলেন, 'রাষ্ট্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন নিয়ে খুব সচেতন ছিল ও। আমাকেও বেশ কয়েকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ও সব সময় চাইত দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস, আমরা এখন তার হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন করছি।'
দুর্ঘটনার পর নাঈমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া কবি নজরুল কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র আমিনুল ইসলাম ফাহিম জানান, 'গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তা হেঁটে পার হওয়ার সময় গুলিস্তান জিরো পয়েন্টগামী ময়লা পরিবহনের একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। এতে গুরুতর আঘাত পায় নাঈম। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।'
মো. ফিরোজ নামে এক পথচারী জানান, 'দুর্ঘটনার পর কেউ তাকে ধরছিল না। সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে আমরাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।'
নাঈমকে সমাহিত করা হয়েছে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে তাদের গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে। বৃহস্পতিবার সকালে জেলার রামগঞ্জ পৌরসভার পূর্ব কাজীরখিল এলাকায় জানাজা ও দাফনকাজে এলাকার হাজার মানুষ অংশ নেয়।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জন্মের পর নানার বাড়ি ভাদুর ইউনিয়নের সমরেশপুর গ্রাম থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন নাঈম। পূর্ব কাজীরখিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং পরে ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী হাই স্কুল থেকে জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উর্ত্তীন হন তিনি।
শুক্রবার সকালে নাঈমের বড় মামা ও কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক ফারুক আহমেদ জানান, 'আমাদের ইচ্ছে ছিল সে ভবিষ্যতে চিকিৎক কিংবা প্রকৌশলী হবে। সেজন্য এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে তাকে ভর্তি করা হয়। কিন্ত তার প্রবল ইচ্ছে ছিল সে ভবিষ্যতে একজন বিচারক কিংবা আইন অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত হবে। সে কারণে তার স্বপ্নকে প্রধান্য দিয়ে এসএসসি পাশের পর নটর ডেম কলেজের মানবিক বিভাগে ভর্তি করা হয়।'
নাঈমের বড় মামা বলেন, 'অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন একজন গাড়িচালক কীভাবে সিটি করপোরেশনে চাকুরি করে?'
এটাকে দুর্ঘটনা না বলে স্পষ্ট হত্যাকাণ্ড বলেও দাবি করেন তিনি। এ হত্যার জন্য চালকের শাস্তি দাবির পাশপাশি অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন লোককে সিটি করপোরেশনে চাকুরি দেয়ার জন্য সিটি করপোরেশন থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চান তারা। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে পল্টন থানায় মামলা করা হয়েছে।
অন্যদিকে নাঈমের বাবা ছেলের স্মৃতি রক্ষার্থে ও নিরাপদ সড়কের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গুলিস্তানের ওই সড়কটির নামকরণ নাঈম হাসানের নামে চাচ্ছেন।
নাঈমের বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'দেশের সব বিচারকদের প্রতি আমার করজোড়ে অনুরোধ, আমার ছেলে তো আর বেঁচে রইলো না, অন্তত আপনারা দেশের সড়কগুলো নিরাপদ রাখতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন।'