ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: খুলনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে জনপ্রতি বরাদ্দ ৩ টাকারও কম!
‘সিডর’ ও ‘আইলা’র পর সম্প্রতি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ খুলনা জেলায় আঘাত হেনেছে। সুন্দরবনের কারণে ব্যাপক আকারের ক্ষয়ক্ষতির কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ। তবুও বুলবুলের প্রভাবে খুলনা অঞ্চলে প্রায় ২ লাখ ৯৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে প্রায় ৪৮ হাজার পরিবার।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে খুলনা জেলা প্রশাসন ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে, যা মাথাপিছু তিন টাকারও কম। এছাড়া চাল বরাদ্দ দিলেও এখন পর্যন্ত তা ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছায়নি।
ত্রাণ পুনর্বাসনের তথ্যমতে, ‘বুলবুলের’ তাণ্ডবে সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার কয়রা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা ও রূপসা উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ২ লাখ ৯৭ হাজার ৫শ' পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৩৭ হাজার ৮২০টি ঘরবাড়ি আংশিক ও ৯ হাজার ৪৫৫টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসেব মতে, ২৫ হাজার হেক্টর জমির আমন ফসল পানির নিচে ছিল। সাড়ে ৮শ হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ত্রাণ পুনর্বাসনের সূত্র জানায়, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে কয়রা ও দাকোপ উপজেলায় আড়াই লাখ টাকা করে, পাইকগাছা উপজেলায় দেড় লাখ টাকা, বটিয়াঘাটা উপজেলায় এক লাখ টাকা এবং রূপসা উপজেলায় ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া রূপসা ও দাকোপ উপজেলায় ৫০ টন করে চাল, সাতশ প্যাকেট শুকনো খাবার, পাইকগাছা উপজেলায় ২৫ মেট্রিক টন চাল, দুইশ প্যাকেট খাবার, বটিয়াঘাটা উপজেলায় ২০ মেট্রিক টন চাল, দুইশ প্যাকেট শুকনো খাবার, রূপসা উপজেলায় ১৫ মেট্রিক টন চাল ও একশ প্যাকেট খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. হুমায়ূন কবির জানান, ইউনিয়নের জন্য ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তবে তা এখনও বিতরণ করা হয়নি। একশ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ১০ হাজার কাঁচা ঘর আংশিক ও ২০ হাজার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া চিংড়ি চাষিরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
তিনি আরও জানান, জিআর’র ৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও তা উপজেলা প্রশাসনে ফেরত দেয়া হয়েছে। এতো স্বল্প পরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা সম্ভব নয় বলেও এই ইউপি চেয়ারম্যান জানান।
এ ব্যাপারে খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার জানান, জিআরের টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ে ৬৮০০ কিলোমিটার পল্লী বিদ্যুৎ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত
খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের দেয়া তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে খুলনা পল্লী বিদ্যুতের প্রায় ৬ হাজার ৮শ’ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৪শ’র বেশি বৈদ্যুতিক খুঁটি হেলে পড়েছে, কোথাও কোথাও আবার উপড়ে গেছে। বিদ্যুৎ লাইনের ওপর গাছ পড়ে অন্তত দুই হাজার জায়গায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে।
পল্লী বিদ্যুতের জোনাল ম্যানেজার প্রকৌশলী আলতাফ হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে খুলনায় বৈদ্যুতিক লাইনে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয়দের সহায়তায় বিদ্যুৎ লাইনের ওপর থেকে গাছ সরানো হয়েছে। বিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হেলে পড়া খুঁটি ঠিক করছেন। কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা গেছে। বাকি এলাকায়ও শিগগিরই বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা যাবে।
ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব সুন্দরবনের দুটি রেঞ্জে বাঘসহ কোনো বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হয়নি
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে বাগেরহাটে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ কোনো বন্যপ্রাণী মারা যায়নি। তবে ৬টি আবাসিক, ১৭টি অনাবাসিক, ১০টি জেটি ও ১৯টি নৌযানের আংশিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
বনবিভাগের সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য মতে, দুবলার চরে বাঁশ, গোলপাতা, হোগলা ও পলিথিন দিয়ে তৈরি জেলেদের অস্থায়ী কিছু ঘরের আংশিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বনবিভাগের বিভিন্ন স্টেশন ও ক্যাম্পের পুরানো স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মংলার সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের বৈদ্যমারী ক্যাম্প এলাকায় বেশ কিছু রেইন্ট্রি-শিরিস গাছ উপড়ে পড়েছে।
বাগেরহাটে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে বনের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. শাহিন কবির ও শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. জয়নাল আবেদীনকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
ঝড় হলে গাছপালার কিছু ক্ষতি হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার বন বিভাগের সতর্কাবস্থার জন্যই বন ও বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষতিসাধন থেকে রেহাই মিলেছে।
কেসিসি’র অধিক্ষেত্রে ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) অধিক্ষেত্রে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে প্রবল বর্ষণে ৩১টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন সড়কে বড় বড় খানা-খন্দ তৈরি হয়েছে, প্রচণ্ড ঝড়ো ও দমকা হাওয়ায় অনেক স্থানে সাইডওয়াল ভেঙে পড়েছে ও গাছ উপড়ে পড়ে বৈদ্যুতিক তার ও পাঁচ শতাধিক এলইডি লাইট সেড অকেজো হয়ে গেছে।
সংস্থার প্রকৌশলীরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও লাইট মেরামতে অন্তত ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রয়োজন। অর্থ বরাদ্দ পেলে সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।
জানা গেছে, গত ৯ ও ১০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাজার হাজার কাঁচা ঘর-বাড়ি আর উপড়ে পড়েছে লাখ লাখ গাছপালা। কেসিসির ৩১টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন রাস্তা, ড্রেন, সাইডওয়াল ও কালভার্টে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সড়কগুলো হলো ১নং ওয়ার্ডে মানিকতলা মেইন রোড ও কেদার নাথ ক্রস রোড, ২নং ওয়ার্ডে আনসার ফ্লাওয়ার মিল, এস আর সিরাজী রোড ও রেলিগেট শ্মশান রোড, ৫নং ওয়ার্ডে আঞ্জুমান রোড বাইলেন, ৬নং ওয়ার্ডে শরীফ আমজাদ সড়ক বাইলেন, ৮নং ওয়ার্ডে বিআইডিসি রোড, ৯নং ওয়ার্ডে মুজগুন্নী মহাসড়ক, শহিদ আবু নাসের হাসপাতাল রোড, মুজগুন্নি মেইন রোড, ১০নং ওয়ার্ডে বিভিন্ন সড়ক, ১১নং ওয়ার্ডে ১৬নং সড়ক, ১২নং ওয়ার্ডে বিভিন্ন সড়ক ও ২৯নং ওয়ার্ডে টিবি ক্রস রোড, এমটি রোড ও রূপসা স্ট্যান্ড রোড, ৩০নং ওয়ার্ডে টুটপাড়া মেইন রোড, ৩১নং ওয়ার্ডে শিপইয়ার্ড রোড ও আল-আমিন সড়ক। এছাড়া এ ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে ৩১টি ওয়ার্ডে অন্তত ৫শ’ এলইডি লাইট সেড নষ্ট ও অকেজো হয়েছে। পাশাপাশি অনেক স্থানে গাছ পড়ে বৈদ্যুতিক লাইনের তার ছিঁড়ে গেছে।
সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) জাহিদ হোসেন শেখ বলেন, বুলবুলের আঘাতে সড়কের বাতি ও লাইনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বেশিরভাগ সড়কে বাতির লাইনের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে তার ছিঁড়ে গেছে। পাশাপাশি অন্তত ৫ শতাধিক এলইডি লাইট সেড নষ্ট ও অকেজো হয়ে পড়েছে। এসব তার ও লাইট সেড মেরামতে ৩০ লাখ টাকার প্রয়োজন।
করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (চ. দ.) মো. লিয়াকত আলী খান বলেন, প্রবল বর্ষণে ৩১টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, বেশ কিছু ড্রেন-কালভার্ট ও সাইডওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের খরচ নিরূপণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে অন্তত ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মন্ত্রণালয় টাকা বরাদ্দ দিলে সংস্কার কাজ আরম্ভ করা সম্ভব হবে।