চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে সাফ করার পর এবার লেক ভরাট ও ঝিরি দখল করছে স্পেক্ট্রা
পনেরোটি পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছিল বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড। এখন সেই সড়কের দুপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে চলছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, লেক ভরাট আর ঝিরি দখল।
পরিবেশবিধ্বংসী এ কাজে নেতৃত্বে দিচ্ছে এই সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। স্পেক্ট্রার সহায়তায় শত শত একর পাহাড় কেটে দখল নিচ্ছে সংঘবদ্ধ বেশ কয়েকটি ভূমিদস্যুচক্র।
বায়েজিদ লিংক রোডের পাঁচ নম্বর ব্রিজ এলাকার স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রকল্প এলাকাটি একসময় সড়ক নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে তা প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে।
ইতোমধ্যেই প্রকল্প এলাকার ১ একর ২০ শতক পাহাড় কেটে করে ফয়'স লেক ভরাটের অভিযোগ উঠেছে স্পেক্ট্রার বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির পাহাড় কাটা ও লেক ভরাটের প্রমাণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্ত দলও।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী। তিনি বলেন, 'স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রজেক্ট এরিয়া ভিজিট করে পাহাড় কাটার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল। প্রতিষ্ঠানটি বিশাল এলাকাজুড়ে পাহাড় কেটেছে, যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি রিপোর্ট জমা দেব।'
শনিবার দুপুরে সরেজমিনে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকা শক্ত টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করা। মূল ফটকেও কড়া পাহারা বসানো হয়েছে। এ প্রতিবেদক সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে কয়েজন যুবক এসে বাধা দিয়ে বলেন, 'এখানে প্রবেশের অনুমতি নেই।'
তবে পাশের উঁচু পাহাড়ে দাঁড়ালেই পুরো প্রকল্প এলাকায় পাহাড় কাটার দৃশ্য চোখে পড়ে। সেখান থেকে দেখা যায়, অন্তত চারটি পাহাড় ও টিলা কেটে প্রায় দেড় একরের বেশি জমি সমান করে ফেলেছে স্পেক্ট্রা লিমিটেড। পাহাড় কাটা সেই মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার ফয়'স লেকের একটি অংশ।
২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পাহাড় কাটা ও লেক ভরাট দেখতে সীতাকুণ্ডে যান পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিজিসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সীতাকুণ্ড উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় পাহাড় কাটা ও লেক ভরাটের দায়ে ৭২ জনের নাম সংবলিত তালিকা পাঠান পরিবেশ অধিদপ্তরে।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. রবিউল হক, সমন্বয়কারী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন দিদারসহ চার ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে এনফোর্সমেন্ট মামলা দায়ের করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
সেই মামলার শুনানিতে আসামিরা জলাধার ভরাট ও পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতিসাধনের বিষয়টি স্বীকারও করেন। পরিবেশ অধিপ্ততর তাদের ৫ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে। পাশাপাশি তিন মাসের মধ্যে ভরাটকৃত জলাধার ও কেটে ফেলা পাহাড় পূর্বাবস্থায় অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী টিবিএসকে বলেন, 'স্পেক্ট্রা আমাদের কাছে প্রকল্পের মাটি রাখার জন্য জায়গাটি ব্যবহারের অনুমতি নিয়েছিল। কিন্তু তারা উল্টো পাহাড় কেটেছে। সরেজমিন তদন্তে বিষয়টি উঠে আসার পর আমরা জরিমানা করেছি।'
কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই আদেশের পর আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও স্পেক্ট্রার এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। এই সুযোগে করোনাকালেও পাহাড় কেটে সরকারি জমি দখল অব্যহত রাখে প্রতিষ্ঠানটি।
অভিযোগ আছে, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড শুধু নিজেরা সরকারি জমি দখল করেনি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সড়ক নির্মাণের সুযোগে বিভিন্ন ব্রিকফিল্ড ও আবাসিক এলাকার প্লট নির্মাণে পাহাড় কাটতে সহায়তা করেছে এই প্রতিষ্ঠান। কোটি কোটি টাকা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা লিমিটেড এদের হয়ে পাহাড় কেটেছে।
দায় নিচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম
লিংক রোডের দুই পাশে গত কয়েক বছর ধরে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হলেও এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর কার্যালয়ের দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, করোনাকালে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তায় স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিডেট নির্বিচারে পাহাড় নিধনে নামে।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাহাড় কাটা ও ফয়'স লেক ভরাটের ঘটনায় জড়িত ৭২ জনের একটি তালিকা পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়। কিন্তু এনফোর্সমেন্ট মামলায় অভিযুক্ত করা হয় মাত্র ৫ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, 'পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে। ঝিরি বা হ্রদ ভরাটের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই। তবে আপনারা নিউজ করলে ব্যবস্থা নিতে পারি।'
এ বিষয়ে জানানো হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ড. এটিএম মাহবুব উল-করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পাহাড় কাটার বিষয় থাকলে পরিবশে অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয় অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য।'
পাহাড় কেটে পার্ক, দখল করেছে ঝিরিও
স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রকল্প এলাকার ঠিক উল্টো পাশে বিশাল পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে আরশি নগর ফিউচার পার্ক-২। ইতোমধ্যে সেখানে একটি ভবনসহ বেশ কিছু ছাউনি তৈরি করেছে স্পেক্ট্রা।
শনিবার দুপুরে আরশি নগর ফিউচার পার্ক-২-এ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় প্রায় এক একরের বেশি জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে পার্কটি। পার্ক তৈরির জন্য পাহাড় কাটা মাটি ফেলা হয়েছে পেছনের পাহাড়ের ঝিরিতে। সেই পাহাড়র ঝিরির মাঝামাঝিতে আড়াআড়িভাবে জিও ব্যাগ ফেলে তৈরি করা হয়েছে দুটি বাঁধ। এতে পাহাড় থেকে নেমে আসা মাটি ও বালিতে ভরাট হয়ে গেছে ঝিরির একটি বিরাট অংশ।
এ বিষয়ে জানতে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সের মুখপাত্র ও মীরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক নাছির উদ্দিন দিদারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় পেতেই 'ব্যস্ত আছি' বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
বিভিন্ন সমিতি ও সোসাইটির নামে চলছে পাহাড় দখল
আরশি নগর ফিউচার পার্ক-২ নামে পার্ক হলেও এর সীমানাপ্রাচীরের ভেতর জঙ্গল সলিমপুর ভূমি মালিক সোসাইটি ও ব্লু ভিউ কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে দুটি অফিস রয়েছে। এর পেছনে পাহাড়ের খাঁজে সাইনবোর্ড গেড়েছে সাসটেইনেবল এনভায়রমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কনসালন্টেন্ট নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয় বাসিন্দা মনসুর আলী টিবিএসকে বলেন, 'মূলত এসব সোসাইটি ও সমিতির নামে সরকারি জমিগুলো দখল করা হয়েছে।'
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. ইউসুফ বলেন, 'লিংক রোডের পাশে আমাদের ৩ একর জায়গা আছে। গত সপ্তাহে রাতের বেলা স্পেক্ট্রা আমাদের সব স্থাপনা ভেঙে জমির দখল নিয়েছে।।'
সরেজমিনে দেখা যায়, চবি রেজিস্ট্রার যেখানে নিজেদের ৩ একর জায়গার দাবি করেছেন, সেই অংশের পুরোটাই পাহাড়। তাদের সংগঠন ব্লু ভিউ কো-অপারেটিভ সোসাইটি অফিসের পাশেই পাহাড় কাটা হয়েছে। অপরপাশে পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছে জঙ্গল সলিমপুর ভূমি মালিক সোসাইটির অফিসটিও।
এ সময় পাহাড়ের অংশের জায়গাগুলো সরকারি খাসজমি বলে টিবিএসের কাছে স্বীকার করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. ইউসুফ।
এদিকে বায়েজিদ লিংক রোড এলাকায় টিবিএসেরর সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, ৩ নম্বর সেতু এলাকায় সিডিএর রাস্তার দুই পাশের বিশাল এলাকা সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে বেঙ্গল ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ঘেরাওয়ের ভেতরে পাহাড় কেটে সমান করে ফেলা হয়েছে বিশাল এলাকা। পাশের পাহাড়েও পোঁতা হয়েছে আরসিসি পিলার।
৪ নম্বর ব্রিজ এলাকার দুপাশের দুটি পাহাড়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দখলে নিয়েছেন সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও যুবলীগ সভাপতি এমএম আল মামুন। এ বিষয়ে মামুনের কেয়ার টেকার মুছা বলেন, 'বছরখানেক আগে আমরা বায়না মূল্যে এ পাহাড় কিনেছি।'
তবে সরকারি পাহাড় কার কাছ থেকে কিনেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এত কথা বলা যাবে না।'
পাশেই আরেকটি পাহাড়ে সাইনবোর্ড পোঁতা হয়েছে এম. এ . সালাম বৃক্ষ প্রকল্প-এর নামে। ৩ নম্বর ব্রিজ এলাকায় একটি পাহাড়ের দখলে নিয়েছে জিন্নুরাইন প্রপার্টিজ। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান আছে বলে জানা গেছে। ৬ নম্বর ব্রিজ এলাকায় বাংলাদেশ লৌহজাত ব্যবসায়ী সমিতির নামে সাইবোর্ড পুঁতে দখল করা হয়েছে ৬০ গণ্ডা পাহাড়ি জমি।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান সংলগ্ন সড়কের দুপাশে উত্তর জালালাবাদ আবাসন প্রকল্প, মেট্রোপলিটন গৃহনির্মাণ সমবায় সমিতিসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন অসংখ্য সাইনবোর্ডের আড়ালে সরকারি জমি ও পাহাড়ি ছড়া দখল করা হয়েছে।