চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের ৭৮ শতাংশই ব্যবসায়ী
জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচন- সর্বত্রই ব্যবসায়ীদের আধিপত্য। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের ৭৮ ভাগেরই পেশা ব্যবসা। এদের মধ্যে ঠিকাদার ব্যবসা থেকে শুরু করে তামাক ব্যবসা এমনকি আছে বৈধ মদ বিক্রির ব্যবসাও। তবে ১২ শতাংশ প্রার্থীর আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে বাড়ি ভাড়া। হলফনামায় কেবল একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী পেশা হিসেবে রাজনীতি উল্লেখ করেছেন।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) ১৭৮ জন বৈধ প্রার্থীদের জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের এ নির্বাচনে সর্বমোট ১৭৮ জন বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। এর মধ্যে মেয়র পদের বিপরীতে ৭ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৭১ জন ( বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বিজয়ী একজন ছাড়া)। ২৭ জানুয়ারি ইভিএমের মাধ্যমে ৪১ ওয়ার্ডের ৭৩৫ টি কেন্দ্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে ভোট দিবে ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৫২ জন।
হলফনামায় দেখা যায় ৭ জন মেয়র প্রার্থীর সবাই ব্যবসায়ী। কাউন্সিলর পদে ১৭১ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৩২ জন ব্যবসায়ী। আছেন কৃষক, আইনজীবী, সমাজসেবক, চিকিৎসক, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী। কৃষিকে পেশা হিসেবে লিখেছেন ৬ জন, চাকরি ৮ জন, আইনজীবী ২ জন ও সমাজসেবক ১ জন ও চিকিৎসক ১ জন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কে বলেন, "রাজনীতি পুরাই বাণিজ্যকরণ হয়ে গেছে। যখনই ব্যবসায়ীরা রাজনীতি দখল করে ফেলেছে, তখন থেকে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে ব্যবসায়ীমুক্ত ছিল। কিন্তু যখন এটি দলীয় নির্বাচনে রূপ নিয়েছে তখন এখানে মনোনয়ন বাণিজ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে। যা রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত। নির্বাচনে এসব ব্যবসায়ীর জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা ও আনুগত্য থাকবে না। বরং তারা তাদের পদ-পদবী কাজে লাগিয়ে অর্থ-বিত্তকে আরো স্ফীত করবেন"।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঠিকাদারি ও কমিশন এজেন্টের ব্যবসায়ে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী জড়িত। ঠিকাদারি করেন এমন প্রার্থী ৩০ জন। কমিশন এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করছেন ১৮ জন প্রার্থী। এছাড়া মোট প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৩৪ জন এবং বিএনপি সমর্থিত ২৯ জন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
তৃণমূল নির্বাচনে এতো ব্যবসায়ীর অংশগ্রহণ 'রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত' করছে বলেও মনে করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার। তিনি বলেন, "রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করার একটি মোক্ষম হাতিয়ার নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্যে কোণঠাসা প্রকৃত রাজনীতিবিদরা। এতে তারা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পরেছেন। অন্যদিকে বিদ্যমান নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিগত কয়েক বছর ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকারের বাস্তব প্রতিফলন দেখছেন না"।
এছাড়া কাউন্সিলরদের মধ্যে ১৫৮ জন প্রার্থী হলফনামায় তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে স্বশিক্ষিত ও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ৫১ জন (৩২.২৮ শতাংশ)। সপ্তম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে এমন প্রার্থী আছেন ৯ জন (৫.৬৯ শতাংশ)। এসএসসি ও এইচএসি যথাক্রমে ২৪ জন ও ৩৩ জন। উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীও কম নয়। ৪০ জন (২৫.৩১ শতাংশ) প্রার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। পিএইচডি ডিগ্রীধারী আছেন মাত্র একজন প্রার্থী।
ব্যবসায়ীরা কেন রাজনীতিমুখী হচ্ছেন এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, "রাজনীতি রাজনীতিবিদরা করবেন এমনটাই হবার কথা ছিল। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের আধিক্য যে হারে বাড়ছে তাতে দেখা গেছে তারা নির্বাচিত হলে পদপদবী ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ সুরক্ষাও বৃদ্ধি করতে পারেন। পূর্বসুরীদের মতো জনসেবাকে তারা খন্ডকালীন মনে করে এবং জনকেন্দ্রীক না হয়ে আত্মকেন্দ্রীক হয়ে পড়ে"।