চরের মাটিতে অসময়ের সয়াবিন, হাজার টন কাঁচা বীজ উৎপাদনের নতুন পথ
মেঘনা নদীর বিশাল চরের বুকে হাজার একর জমিতে অসময়ে চাষ হয়েছে সয়াবিন। অসময়ে উৎপাদিত এ কাঁচা সয়াবিনের পুরোটাই প্রধান মৌসুমের বীজ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের নিকট বিক্রি হচ্ছে। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে সয়াবিন সংগ্রহ, মাড়াইসহ ক্রয় বিক্রয়ে ব্যস্ত হাজারো কৃষক-কৃষাণী। কয়েকটি চর থেকে অসময়ে উৎপাদিত এ সয়াবিনের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ২শ কোটি টাকা। এ ভিন্ন কৃষিতে জড়িয়ে আছে চরের ভূমিহীন ৫ হাজার কৃষক। কাচাঁ সয়াবিন দ্বিগুণ দামে বিক্রি সত্ত্বেও বাজারে তা প্রবল চাপ তৈরি করেছে প্রচলিত শুকনো বীজ ব্যবসার ওপর।
মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলার চরবংশী এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
রায়পুরের চর কাছিয়ার পানির ঘাট এবং মোল্লারহাটে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বীজ সয়াবিনের হাট বসে। গত প্রায় এক মাস যাবত প্রতিহাটে গড়ে প্রায় ৫শ থেকে হাজার টন সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ী রহমানসহ আরও কয়েকজন । ব্যবসায়ীরা জানান, এ উপজেলায় আরো ৫টি বাজারে বীজের হাট বসে। লক্ষ্মীপুরের অন্য সয়াবিন উৎপাদনকারী উপজেলা, নোয়াখালী এবং চাঁদপুরের কৃষকরা এ কাঁচা সয়াবিন বীজের প্রধান ক্রেতা।
মেঘনা নদীর চর কাছিয়া, কানিবগার চর, টুনুর চর, খাসিয়ার চর, চর ইন্দুরিয়ায় উৎপাদিত সয়াবিন এসকল বাজারে আসে।
চরে গিয়ে দেখা গেছে বাজার সংলগ্ন প্রতিটি নদীর ঘাটে মেশিনে মাড়াই করা সয়াবিন নৌকা বোঝাই করে ঘাট পার করে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে কৃষক। পরে আড়ৎদার ও পাইকারী বীজ বিক্রেতাদের হাত বদল হয়ে তা চলে যাচ্ছে কৃষকের মাঠে।
স্থানীয় চর গাছিয়ার মোল্লারহাট বাজার এবং পানিরঘাট বীজ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন শুকনো বীজ যেখানে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১শ টাকায় সেখানে কাঁচা নতুন বীজ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২১০ টাকায়। গত প্রায় ১ মাস ক্রয় বিক্রয়ে ব্যস্ত কৃষক।
কানিবগার চরের কৃষক শাহজাহান পাইক জানান, কৃষক এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক সংরক্ষিত আগের বছরের শুকনো বীজের তুলনায় নতুন কাঁচা উৎপাদিত বীজ শতভাগ গজায়। সে কারণে দ্বিগুন বেশি দামেও কৃষক কাঁচা সয়াবিন বীজ সংগ্রহ করছে।
কৃষক কাদের হাওলাদার জানিয়েছেন, মঙ্গলবার তিনি প্রতি কেজি দুইশত টাকা দরে ৪শ কেজি সয়াবিন বিক্রি করেছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, এ বছর চরে কয়েক দফা জলোচ্ছ্বাসের কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। তবুও ২ একর জমিতে তিনি ১ হাজার কেজি সয়াবিন পেয়েছেন।
হায়দরগঞ্জে বাজারে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার বীজ ব্যবসায়ী মহিন জানান, প্রতি টন ১লাখ ৯০ হাজার টাকা দরে ৪ টন সয়াবিন ক্রয় করেছেন। যার প্রতি কেজির দাম পড়েছে ১শ ৯০ টাকা। খুচরা বিক্রেতাদের নিকট তিনি এগুলো ৫ টাকা লাভে বিক্রয় করবেন।
স্থানীয়রা জানায়, ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাস হচ্ছে সয়াবিন চাষের প্রধান মৌসুম। কিন্ত এ ডিসেম্বর-জানুয়ারীতেই মেঘনার চরের বালুময় মাটি থেকে সয়াবিন ঘরে তোলে কৃষক। কাঁচা সে সয়াবিন সাথে সাথেই আবার মাটিতে বপন করে কৃষক। এ সয়াবিনগুলো সাধারণত বর্ষা মৌসুমের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চরের মাটিতে লাগায় কৃষক।
লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ চর বংশী ইউনিয়নের মেঘনার নদীর চর কাছিয়া, কানিবগার চর, টুনুর চর, খাসিয়ার চর, চর ইন্দুরিয়া এবং সদর উপজেলার মেঘার চরে গত ৩/৪ বছর যাবত অসময়ে (বর্ষাকালে) সয়াবিন চাষ করছে চরের কৃষকরা। লক্ষ্ণীপর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে এ সকল চরে অসময়ে প্রায় ২০ হাজার একর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়। প্রচলিত সয়াবিনের তুলনায় বেশি দামের কারণে এর বাজার মূল্য প্রায় দুইশত কোটি টাকা।
বাজারে চরের কাঁচা সয়াবিন বীজের প্রভাব সর্ম্পকে জানতে চাইলে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন-বিএডিসির সিনিয়র পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো: শরীফ উল্লাহ জানান, বিগত বছরে প্রায় ৩শ থেকে ৫শ টন বীজ বিক্রয় করেছিল বিএডিসি। কিন্ত এবার মাত্র ৫ টন চাহিদা পেয়েছেন। বিএডিসির বীজ ১শ টাকার নিচে বিক্রয় হলেও কৃষক তা কিনছে না বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
লক্ষীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বেলাল হোসেন খাঁন জানান, এবছর লক্ষীপুর জেলায় ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হবে। সেখানে ২৭শ ৩০ টন বীজ লাগবে। কিন্ত চরে উৎপাদিত বীজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায়ও বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই)'র নোয়াখালী অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী বলেন, দেশের অন্তত ৩৩ জেলার ৭২টি উপজেলায় ৩-৪ লাখ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়। যেখান থেকে বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিনের উৎপাদন হয়। যার শতকরা ৬০ ভাগ সয়াবিন উৎপাদিত হয় লক্ষীপু্রে। কিন্ত সয়াবিন উৎপাদনের প্রধান সমস্যা ছিল বীজ। তিনি জানান, এবার চরে উৎপাদিত সয়াবিন বীজ সমস্যা সমাধানে দেশকে একধাপ এগিয়ে দেবে।
অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে জানা যায়, সয়াবিন উৎপাদনে শীর্ষে থাকার কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার উপকূলীয় জেলা লক্ষীপুরের 'ব্র্যান্ডিং নাম' রাখে সয়াল্যান্ড। ওয়ার্ল্ড এটলাসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ সয়াবিন উৎপাদনে বিশ্বের ৩৫তম দেশ। বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদনে প্রধান জেলা লক্ষ্মীপুর।