চাল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, তবু হাসি নেই কৃষকের মুখে
৩০ কাঠা জমিতে প্রতি মৌসুমে ধানের আবাদ করেন ময়মনসিংহের সুতিয়াখালির কৃষক সুরুজ আলী। বোরো মৌসুমে কেমন চলছে তার কৃষিকাজ? এমন প্রশ্নের জবাবে জানান, গত মৌসুমে চৌদ্দ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে তার। এবারও ফলন ভালো হয়েছে; তবে ন্যায্য দাম পাবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
বললেন, প্রতি মৌসুমে লোকসান হলেও চাষ থেমে থাকে না। কেননা, কৃষিই তার জীবন-জীবিকা।
কৃষকদের এমন অভিযোগ সব সময়ের। এসবের সমাধান না হলেও থেমে থাকে না আবাদ। ফলে এবার চাল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় শীর্ষ উৎপাদনকারী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
মার্কিন কৃষি বিভাগের পূর্বাভাস বলছে, চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন তিন কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে চীন ও দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত।
ধারাবাহিকভাবে চাল উৎপাদন বাড়ছে বাংলাদেশে। বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় হওয়ার এ পূর্বাভাস দিয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগ, ইউএসডিএ।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ হলেও হাসি নেই কৃষকের মুখে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, কৃষি আধুনিকায়নের পাশাপাশি নজর দিতে হবে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে। নিশ্চিত করতে হবে কৃষকের ঘামের সঠিক মূল্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণা, সম্প্রসারণ বিভাগসহ এই সেক্টরের প্রতিটা দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় থাকা খুবই জরুরি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, কৃষক তার দায়িত্ব পালন করছেন। তারা আবাদ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন না। সরকার কৃষককে সহযোগিতা করতে কাজ করছে। প্রতি বছর ভর্তুকিও দিচ্ছে। এখন প্রয়োজন কৃষক ও চাষাবাদ একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা।
তিনি বলেন, কৃষক যেন তার উৎপাদিত ফসলের দাম পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় না ভোগেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে সরাসরি ধান কিনছে। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, চাষীদের বড় অংশ কিন্তু ফরিয়াদের কারসাজিসহ বিভিন্ন কারণে সঠিক দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। অন্যথায় উৎপাদন বাড়লেও যারা এর পেছনে কাজ করছেন, তারা লোকসানে পরবেন।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু উৎপাদন বাড়ছে, কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার পাশাপাশি নিয়মিত চাল রপ্তানির ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এতে দাম বাড়বে ফসলের। এর জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব কমলারঞ্জন দাশ বলেন, শস্য উৎপাদন করেন কৃষক, তারা যদি কোনো রকম খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকেন, তাহলে কৃষি সেক্টরে সফলতা আসবে না। উৎপাদিত শস্যের সঠিক বাজারজাতকরণ নিশ্চিত না হলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে না।
তিনি বলেন, আমাদের যে সকল সীমাবদ্ধতা আছে তাকাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছি। আমাদের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী, মজুদ রেখে উদ্বৃত্ত চাল বাণিজ্যিকীকরনে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দেশের জন্য পর্যাপ্ত মজুদ রেখে ভালোমানের চাল রপ্তানি করা যেতে পারে। রপ্তানি একটি পলিসিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। আমাদের শস্যের মান ভালো।
সরকার চলতি মাসে আবুধাবিতে উপহার হিসেবে যে চাল পাঠিয়েছিল, তার মান নিয়ে খুব ভালো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে বলে যোগ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আরব আমিরাত বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান শেখ হামাদ বনিজায়েদ আল নাহিয়ান বাংলাদেশ থেকে চাল আমদানির ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
এদিকে গবেষকরা বলছেন, উৎপাদন বাড়ছে, তাতেই খুশি হলে চলবে না। এই ধারা অব্যাহত রাখতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও কৃষির আধুনিকায়নে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রাখার বিষয়ে কৃষক এখনো কম সচেতন। মাটির উর্বরাশক্তি ঠিক রেখে কীভাবে উৎপাদন আরও বাড়ানো যায়, সেই গবেষণা আমরা করছি। উদ্ভাবন করা হচ্ছে নতুন নতুন জাত।
তিনি বলেন, সার প্রয়োগ থেকে চাষাবাদের প্রতিটি ধাপে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে সচতেন থাকতে হবে। কৃষিকে আধুনিকায়ন করা বা কনজারভেশন অ্যাগ্রিকালচারের দিকে ঝুঁকতে হবে। সেজন্য আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। জমিতে রাসায়নিক ব্যবহারে কৃষকদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। জেনে বুঝে, প্রয়োজনে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান বলেন, দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। কমছে কৃষি জমি।তারপরও আমাদের উৎপাদন বাড়ছে। সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে, বছরে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা এই সেক্টরে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। সুষম সারের দাম কমানো হচ্ছে। নতুন নতুন জাত কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, আগে একটি নতুন জাতের ধান কৃষক পর্যায়ে পৌঁছাতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগত। এখন তিন-চার বছরের মধ্যেই কৃষক পেয়ে যাচ্ছেন। এসব জাত চাষাবাদের প্রক্রিয়া নিয়মিত মনিটর করা হচ্ছে। গবেষণা থেকে সম্প্রসারণ- প্রতিটি ধাপেই সরকার গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। এসব কারণে উৎপাদন বাড়ছে।
তিনি বলেন, এখন মেকানাইজেশন খুব দরকার। মেকানাইজেশন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, জমিগুলো টুকরা টুকরা অবস্থায় চাষ করা হচ্ছে। এসব জমি যদি একত্রে চাষের আওতায় না আনা যায়, তাহলে মেকানাইজেশন করতে পারব না। এটা করার জন্য আমরা সিনক্রোনাইজ অ্যাগ্রিকালচারের দিকে ঝুঁকছি। যেখানে অন্তত ৬০ একর জমি এক সঙ্গে চাষ হবে। মেশিনের সাহায্যে ধান বপন থেকে প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে কর্তনও করা হবে। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। চাইলেই আমরা রপ্তানি করতে পারি। তবে রপ্তানির ঘোষণা এলে অভ্যন্তরীণ বাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।তাই অভ্যন্তরীণবাজার ব্যবস্থাপনার দিকে আমরা আগে নজর দিচ্ছি।
দেশের উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশের বেশি আসে বোরো ধান থেকে। বাকিটা আসে আউশ ও আমন থেকে। কৃষি বিভাগ বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে চালের চাহিদা রয়েছে বছরে তিন কোটি ৫১ লাখ টন।