ঠেকানো যাচ্ছেনা ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়া, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার আরও ২৮
চট্টগ্রামে দুই দিনে নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা নারী-শিশুসহ ২৮ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা খেয়ারঘাট থেকে ৯ জন ও বুধবার সীতাকুণ্ড উপজেলার উত্তর সলিমপুরের সাগর উপকূল থেকে ১৯ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পুলিশ বলছে, গত তিনমাসে অন্তত ২৫০ জন রোহিঙ্গা নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে পালিয়েছে।
মিরসরাই থানার ওসি মুজিবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা সাগরপথে ট্রলারে করে ভাসানচর থেকে মিরসরাই সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় ঢুকে পড়ে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা তাদের আটক করে থানায় খবর দেয়। খবর পেয়ে মিরসরাই থানা পুলিশ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এর আগে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে ১৭ জুলাই শিশু সহ ২০ জন, ১১ জুলাই ১৮ জন, ২২ জুন ১৪ জন এবং ৩০ মে ১০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়।
অন্যদিকে, ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী এএসআই মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, বুধবারে আটককৃতদের মধ্যে ৮ জন পুরুষ, ৪ জন নারী এবং ৭ শিশু রয়েছে ।
তিনি বলেন "দালালদের মাধ্যমে ভাসানচর থেকে একটি নৌকা দিয়ে উত্তর সলিমপুর এলাকার সাগরপাড়ে নামেন এই রোহিঙ্গারা। তাদের নামিয়ে দিয়েই নৌকা নিয়ে দালালরা চলে যায়। তাদের দেখে লোকজনের সন্দেহ হলে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে খবর দেয়। পরে চেয়ারম্যানের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাদের আটক করে"।
"প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা টেকনাফে যাওয়ার জন্য ভাসানচর থেকে পালিয়েছেন, " বলেন পুলিশ কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম।
গত ১৭ আগস্ট নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে পালানোর সময় নৌকাডুবির ঘটনায় সন্দ্বীপ থেকে ১১ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করে কোস্টগার্ড ও পুলিশ। এ সময় ১৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
সে দিন কোস্টগার্ড কন্টিনজেন্ট কমান্ডার সাজু আহামদ টিবিএসকে জানান, ১৩ আগস্ট রাতে কাঠের নৌকায় ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন ৩৮-৪০ জন রোহিঙ্গার একটি দল। কিন্তু ভাসানচর থেকে আনুমানিক ১৫-২০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে চট্টগ্রামের কাছে বঙ্গোপসাগরে নৌকাটি ডুবে যায়। দুর্ঘটনার পর বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ও নৌবাহিনীর জাহাজ বঙ্গোপসাগর এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে ১৫ জনকে জীবিত এবং ১১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে পালিয়েছে আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গা
চট্টগ্রামে মিরসরাই, সন্দীপ এবং নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, চর জব্বার এলাকা দিয়ে গত তিন মাসে আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গা পালিয়েছে বলে জানিয়েছে ভাসানচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিকুল ইসলাম পুলিশ। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা।
ভাসানচর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসের জন্য মানুষের সাথে মিশে যাচ্ছে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা। এছাড়া কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত তাদের স্বজনদের কাছে ফেরত যাওয়ার উদ্দেশ্যেও ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে তারা।
জুন ও জুলাই মাসে ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মিরসরাই ইকোনোমিক জোন এলাকা থেকে চার দফায় ৩ দালাল সহ ৬২ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ। সন্দীপ থানা পুলিশের হাতে আটক হয়েছে ৩৯ জন রোহিঙ্গা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের তথ্যমতে, কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে ১৮ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়। কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে তাদের উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
'রোহিঙ্গারা কেন ভাসানচর ছাড়ছে'- এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামছুদ্দৌজা বলেন, "রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একশ্রেণীর দালাল কাজ করে। রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ক্যাম্প থেকে নিয়ে আসে এই চক্র। মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থানা পুলিশের হাতে আটকের পর এমন তথ্য আমরা জানতে পেরেছি"।
এই প্রসঙ্গে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের উন্নয়নে কাজ করা এনজিও স্কাস এর চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা বলেন, "ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা থাকলেও তাদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে। ভাসানচরে অবস্থানরত অনেক রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর স্বজনরা এখনো কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে রয়েছে। তাদের টানে কিছু রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে দুই একজন রোহিঙ্গা ফেরত এলেও পালিয়ে যাওয়া বেশিরভাগ রোহিঙ্গা আর ভাসানচর ক্যাম্পে ফেরত আসেনা"।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধানে ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় ১৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। এরপর একই বছরের ২৯ ডিসেম্বর ১৮০৪ জন, চলতি বছরের ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি ২৪২১ জন এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩৬০০ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। আরও দুই ধাপে স্থানান্তরের পর ভাসানচরে বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৮,৩৪৭ জন।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেখানে একটি স্বতন্ত্র থানার উদ্বোধন করেছে। ওই থানায় একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে ৪১ জন পুলিশ সদস্য ও ২৪৭ জন এপিবিএন সদস্য কর্মরত আছেন। পাশাপাশি নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছে।