ডিসেম্বরে উড়াল সড়কের বিমানবন্দর-তেজগাঁও অংশ খুলে দেওয়ার উদ্যোগ
নির্মানাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমান বন্দর-তেজগাঁও অংশ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করতে চায় সেতু বিভাগ। এ লক্ষ্য সামনে রেখে রাত দিন অবিরাম কাজ চলছে বিমানবন্দর, কাওলা, কুড়িল, জোয়ারসাহারা, বনানী, মহাখালী ও তেজগাঁও এলাকায়।
তবে বিমান বন্দর থেকে বনানী অংশের উড়াল সড়ক নির্মাণের কাজ ৫৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। বনানী থেকে মগবাজার অংশের কাজ হয়েছে ৯ শতাংশ। এরই মধ্যে বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ শুরু হলে এর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে উড়াল সড়কটির ওই অংশের ডিজাইন সংশোধনের বিষয়টি সামনে আসছে।
তবে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে উড়াল সড়ক নামিয়ে দেয়া হলে সেখানে নতুন করে যানজট সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সম্প্রতি সেতু বিভাগে অনুষ্ঠিত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভায় প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ড. মো: মনিরুজ্জামান জানান, ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে বিমান বন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশ চালু করার লক্ষ্যে ভৌত অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারি বেসরকারি ভিত্তিতে (পিপিপি) বিমান বন্দর থেকে চট্টগ্রাম রোডের কুতুবখালী চার লেনের লেনের উড়াল সেতু নির্মাণ করতে ২০১১ সালে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়।
এর আওতায় ১৯.৭৩ কিলোমিটার মূল সড়কের পাশাপাশি নির্মাণ হবে ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৩১ টি র্যাম্প। সব মিলে উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য হবে ৪৬.৭৩ কিলোমিটার।
মোট তিনটি ধাপে উড়াল সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে বিমান বন্দর থেকে বনানী রেল স্টেশন পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। এ ধাপে ১৫০০ পাইলের মধ্যে ১৪৫২ টি, ৩৫০ পাইলক্যাপের মধ্যে ২৫০ টি, সমসংখ্যক ক্রসুবমের মধ্যে ১৪৯ টি ক্রস বিম, ৩৫০ কলামের মধ্যে ২২৭ টি, ৩১৫৪ টি আইগার্ডারের মধ্যে ৬০৫ আই গার্ডার স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এ অংশের ভৌত অগ্রগতি ৫৯ শতাংশ।
দ্বিতীয় ধাপে বনানী থেকে মগবাজার রেল ক্রসিং আর শেষ ধাপে মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ হবে।
প্রকল্প পরিচালক জানান, দ্বিতীয় ধাপের প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ অংশে ৬০২টি পাইল ও ১৫টি পাইল ক্যাপের কাজ শেষ হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে ৯ শতাংশ।
তৃতীয় ধাপে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া নির্মানাধীন সড়কটির এলাইনমেন্টে বিদ্যমান স্থাপনা ও ইউটিলিটি স্থানান্তরে সেনাবাহিনী কাজ করছে।
এ দিকে উড়াল সড়কটি নির্মাণে ব্যয় ধরা আছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ইথাল থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি এ প্রকল্পে অর্থায়ণ ও নির্মাণ কাজ করছে।
এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল এবং পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় যানজট এড়িয়ে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারবে।
অন্য দিকে উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো যানজট এড়িয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। এর ফলে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অংশে যানজট দূর হবে।
সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (আরএসটিপি) তথ্যানুযায়ী, বাস্তবায়নের পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে। পুরো এক্সপ্রেসওয়েতে থাকবে ১১টি টোল প্লাজা, এর মধ্যে পাঁচটি হবে এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে।
হানিফ ফ্লাইওভার পর্যন্ত বর্ধিত করার সুপারিশ
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার সুপারিশের আলোকে নির্মানাধীন সড়কটিতে হাতিরঝিল সোনারগাঁও হোটেল, হাতিরপুল, কাটাবন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবে পিআইসি সভায় উপস্থিত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের একজন উপসচিব এ লিঙ্ক থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে তিনি উড়াল সড়কটি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার পর্যন্ত সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেন।
তবে পিপিপি চুক্তির কাজে বড় ধরনের ভেরিয়েশনের সুযোগ না থাকায় নতুন অংশটি প্রকল্পে যুক্ত না করে আলাদা একটি ধাপে (চতুর্থ ধাপ) বাস্তবায়নের সুপারিশ করেন প্রকল্প পরিচালক।
ব্যয় বাড়ছে সহায়ক প্রকল্পের
পিপিপি ভিত্তিতে সড়কটি নির্মাণ করতে সহায়ক হিসেবে নেয়া সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট এর ব্যয় ও মেয়াদ আরেক দফায় বাড়ছে।
সম্প্রতি ৪৯১৭.৫৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছে সেতু বিভাগ। সর্বশেষ সংশোধনীতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা ছিল ৪৮৮৯ কোটি টাকা।
অবশ্য ২০১৪ সালের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ, অবকাঠামো এবং ইউটিলিটি স্থানান্তরসহ সড়ক নির্মাণের সহায়ক কাজ শেষ করতে ২০১১ সালে অনুমোদন দেয়া প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২১৬.৮৭ কোটি টাকা। মূল প্রকল্পের তুলনায় মোট ব্যয় বাড়ছে ১৭০০.৭০ কোটি টাকা, বা ৫৩ শতাংশ।
সহায়ক এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। এ হিসাবে বাড়তি সময় লাগছে সাড়ে ১০ বছর।
দীর্ঘ জটিলতার অবসান
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির চুক্তি করে সেতু বিভাগ। ওই বছর ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন। কিন্তু অর্থসঙ্কটসহ নানা জটিলতায় মাঝে দীর্ঘদিন কাজ আটকে থাকে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ।
এরপর ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতায় কাজ আটকে থাকে দুই বছর। নকশা পরিবর্তন ও মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করতে হয়।
চুক্তি সংশোধনের পর ওই বছরই শুরু হয় ভূমি জরিপ। ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর এবং ২০১৫ সালের ১৬ অগাস্ট দুই দফা এ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রয়োনীয় অর্থ জোগাড় করতে না পারায় নির্মাণকাজ তা চলতে থাকে ঢিমেতালে।
প্রকল্প পরিচালক জানান, ইতাল-থাই এ প্রকল্পে দুটি প্রতিষ্ঠানকে অংশীদার হিসেবে নেওয়ার পর তাদের অর্থসঙ্কট কেটেছে।
এখন এ প্রকল্পের ৫১ শতাংশের মালিকানা রয়েছে ইতাল থাইয়ের হাতে। চায়না শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কোম্পানি গ্রুপ লিমিটেড ৩৫ শতাংশ এবং সিনো হাইড্রোর ১৪ শতাংশ অংশদারীত্ব নিয়েছে।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত হোসেন দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রকল্পের প্রথম অংশের কাজ একেবারেই শেষের পর্যায়ে। তা ছাড়া জমি ও অর্থের সঙ্কট না থাকায় দ্বিতীয় অংশের কাজও চলছে দ্রুত। সব মিলে চলতি বছরের মধ্যে তেজগাঁও পর্যন্ত সড়ক চালু করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেই এ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে এ লক্ষ্য পূরণ হবে বলে তারা আশ্বস্ত করেছে।
বিমান বন্দর এলাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার আগেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। তা ছাড়া পিপিপি প্রকল্পের চুক্তি হয়ে গেলে ডিজাইন পরিবর্তণের সুযোগ কম থাকে। তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে এ প্রকল্পের সঙ্গতি নিশ্চিত করতে সিভিল এভিয়েশান কর্তৃপক্ষকেই উদ্যোগী হতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাক পরিবহণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, মাঝ পথ পর্যন্ত উড়াল সড়ক চালু হলে সেকানে নেমে যানবাহন কোথায় যাবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে পিপিপি প্রকল্প বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীকেই নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অর্ধেক সড়ক চালু করার বিষয়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রাজি নাও হতে পারে। কারণ এটুকু সড়ক চালু করলেও টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। যদিও যানবাহন চলবে পরিমাণে কম।
উড়াল সড়কটি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার বিষয়ে শুরুতেই উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় ফ্লাইওভার থেকে নেমে যানজট টেলে উড়াল সড়কে উঠতে হবে। ফলে কর্মঘন্টা নষ্ট হবে।