নীল তিমি মারা যাওয়ার কী কারণ?
নীল তিমি সারা বিশ্বেই একটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী। সম্প্রতি বাংলাদেশের সমুদ্রতীরে পর পর দুটি মৃত নীল তিমি ভেসে আসার ঘটনা অশুভ সংকেত দেয়, আমাদের বাস্তুসংস্থানগত ভারসাম্য কতটা বিঘ্নিত হচ্ছে।
অবশ্য সেটাসিন-তিমি জাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী (তিমি, শুশুক ও ডলফিন) আগেও কক্সবাজারে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ২০২০ সালের শেষ দিকে কিছু মৃত ডলফিন সেখানে ভেসে ওঠে। কিন্তু মৃত নীল তিমির দেখা পাওয়া বিরল ঘটনা।
নীল তিমি ও এই প্রজাতির প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিছু বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। সেটাসিন জাতীয় প্রাণীর জীবনকাল কয়েক দশক থেকে শুরু করে ২০০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। তাই বার্ধক্যজনিত কারণেও মৃত্যু ঘটতে পারে এগুলোর।
যদিও এ জাতীয় প্রাণীরা দলবেঁধেই চলাফেরা করে, তবু অনভিজ্ঞ কোনো প্রাণী দিক হারিয়ে সহজেই হারিয়ে যেতে এবং মৃত্যুর মুখে পতিত হতে পারে। এছাড়া রোগবালাই,পরজীবীর আক্রমণ এবং সন্তান জন্মদানকালীন সমস্যার কারণেও মারা যেতে পারে তিমি।
প্রাকৃতিক কারণগুলো ছাড়াও বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে বহু নীল তিমি মারা যায়।
জাহাজের সঙ্গে আঘাত লেগে আহত হবার ফলে নীল তিমি মারা যেতে পারে। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলীয় যেসব অঞ্চলে বন্দর কিংবা শিপিং লেন রয়েছে এবং দ্রুতবেগে বিশালাকৃতির জাহাজ চলাচল করে, সেসব স্থানে তিমি মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেশি।
মাছ ধরার বড়শিতে আটকে গিয়েও নীল তিমি জখম হতে পারে এবং সেখান থেকে ধীরে ধীরে তাদের পুরো শরীরে রোগ ছড়িয়ে পড়ে ও সে মারা যায়।
নীল তিমিসহ অন্য সেটাসিন প্রাণীরা ওশান নয়েজ বা সমুদ্রে শব্দদূষণ, বাসস্থানগত বিপর্যয়, দূষণ, জাহাজের কারণে সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে মারা যেতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে, নীল তিমিগুলো আহত হয়েছে কিংবা অগভীর সমুদ্র অঞ্চলের মধ্যে ওদের মেরে ফেলার ফলে সমুদ্রের ঢেউয়ে মৃতদেহ কূলে ভেসে এসেছে।
বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র অফিসার ও পিএইচডি ফেলো মোহাম্মদ আশরাফুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ''শুক্রবার সমুদ্রতীরে ভেসে আসা তিমিটি একটি প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিড'স তিমি।"
ব্রিড'স তিমি এক ধরনের সরু পৃষ্ঠবিশিষ্ট তিমি, যারা নীল তিমি ও হাম্পব্যাক তিমির মতো একই প্রজাতির অন্তর্গত।
আশরাফুল হক বলেন, 'সাধারণত তিমিরা দলে দলে ভাগ হয়েই চলাফেরা করে। কোনো কারণ ছাড়া দলত্যাগ করলে প্রায়ই তিমি মারা যায়। শুক্রবার ও শনিবার যে দুটি মৃত তিমি পাওয়া গেছে, এগুলোর ক্ষেত্রেও হয়তো একই ঘটনা ঘটেছে।'
মৃত্যুর কারণ নিশ্চিতভাবে বলতে না পারলেও তিনি জানান, তিমিগুলোর মৃত্যু ঘটেছে আরও অন্তত ১০-১২ দিন আগে।
সবার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ প্রাণী হিসেবে পরিচিত নীল তিমি প্রকৃত পক্ষে সবচেয়ে বিরল প্রাণীগুলোরও অন্যতম। খুব কম দেশই এই স্তন্যপায়ী প্রাণীকে সরাসরি দেখতে পেয়েছে। এমনকি কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলের লোকেরাও নীল তিমি দেখেছেন খুব কম।
এর আগে শুক্রবার বিকেলে একটি ৪৫ ফুট লম্বা মৃত নীল তিমি হিমছড়ি এলাকায় সমুদ্র তীরে স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসে। এরপর শনিবার সকালে আরেকটি অপেক্ষাকৃত ছোট, মৃত নীল তিমি ভেসে আসে।
ফেসবুকের মাধ্যমে নীল তিমি ভেসে আসার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং কক্সবাজার শহর, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও চকরিয়া থেকে লোকজন ভিড় করে হিমছড়ি সৈকতে।
জেলা প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তারা ছাড়াও পরিবেশ বিভাগ, বন বিভাগ, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড এবং বাংলাদেশ মেরিন রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরাও ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।
এছাড়াও জেলা প্রাণীসম্পদ বিভাগের সার্জনসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ময়নাতদন্তের জন্য হিমছড়িতে আসেন।
পরিবেশ সাংবাদিক আহমেদ গিয়াসের মতে, কক্সবাজারে শেষবার বিশাল তিমি দেখা গিয়েছিল ১৯৯০ সালে। সেবার লাবণী বিচে ভেসে আসা সেই তিমি ছিল ৬৫ ফুট লম্বা।
তিনি আরও বলেন, 'তীরে ভেসে আসা মৃত তিমিগুলোর কংকাল সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে গবেষণা কাজের জন্য।'
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা জানিয়েছেন, শুক্রবার ভেসে আসা তিমিটির শরীরের প্রয়োজনীয় অংশ সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং সেদিনই এটিকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, 'মেরিন ও ফিশারিজ বিভাগের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ অনুযায়ী মাটি চাপা দেওয়া অংশ ঘিরে রাখা হয়েছে, যেন পরে হাড়গুলো ওঠানো ও সংরক্ষণ করা যায়।'
সংখ্যায় কম হলেও বঙ্গোপসাগরের কাছে অনেকবারই তিমির দেখা পাওয়ার কথা জানা গেছে। আলাদা আলাদা হিসাব অনুযায়ী ধারণা করা হয়, সারা বিশ্বে বর্তমানে সংখ্যায় ২৫ হাজারের চেয়ে বেশি তিমি নেই।