পরীমনির মামলায় পুলিশের চার্জশিট: বোটক্লাবে কী ঘটেছিল সে রাতে?
চিত্রনায়িকা পরীমনিকে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার মামলায় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ।
গতকাল সোমবার ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এ অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেন।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী, তদন্তে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও শাহ শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে পরীমনিকে যৌনপীড়ন, নির্যাতন এবং হুমকির প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। আর মামলার আরেক আসামি তুহিন সিদ্দিকি অমির বিরুদ্ধে পেয়েছে এ কাজে 'সহায়তা'র অভিযোগ।
তবে এই তিনজনের কারও বিরুদ্ধেই ধর্ষণচেষ্টার কোনো প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরীমনির দায়ের করা মামলায় শাহ শহিদুল আলম (৫০) এর নাম না থাকলেও তদন্তে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তাকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তারা এ অভিযোগপত্রটি তৈরি করেছে। স্বাক্ষীদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ফাতেমাতুজ জোহরা বন্নি, জুনায়েদ বাগদাদী জিমি ও আশরাফুল ইসলাম। সাক্ষীদের কয়েকজন পরীমনির সঙ্গী হলেও বাকীরা ঢাকা বোটক্লাবের কর্মকর্তা কর্মচারী ও স্থানীয় বাসিন্দা।
অভিযোগপত্রটি গ্রহণের বিষয়ে আদালত আজ মঙ্গলবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো আদেশ দেননি।
পুলিশের বর্ণনায় সে রাতে যা ঘটেছিল:
অভিযোগপত্রে পুলিশ বলেছে, ঢাকা বোট ক্লাবের এক্সিকিউটিভ মেম্বার আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমি আগে থেকেই পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ। তুহিন সিদ্দিকি মামলার বাদী পরীমনিরও পূর্ব পরিচিত।
৮ জুন সন্ধ্যায় পরীমনির কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ বাগদাদী জিমি এই চিত্রনায়িকার বনানীর বাসায় যান। এরপর রাত সাড়ে ৮টায় সেখানে আসেন ফাতেমা তুজ জান্নাত বন্নি। সেখানে জিমির সঙ্গে মামলার আসামী তুহিন সিদ্দিকির ফোনে কথা হয়। এরপর তুহিন সিদ্দিকি রাত ১০টার দিকে পরীমনির বাসায় যান। সেখানে রাতের খাবার সেরে সাড়ে ১১টার দিকে সবাই ফাতেমা তুজ জোহরা বন্নির উত্তরার বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দেন।
পুলিশের তদন্ত বলছে, এ সুযোগে আসামি তুহিন সিদ্দিকী 'কৌশলে' পরীমনি ও তার সঙ্গীদের নিয়ে রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা বোট ক্লাবের বারে প্রবেশ করেন। বারে যাওয়ার বিষয়টি তুহিন সিদ্দিকি আগেই ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদকে জানিয়ে রাখেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদ তাদের জন্য একটি টেবিল বরাদ্দ রাখতে বোটক্লাবের ম্যানেজার আবদুর রহিমকে বলেন। এরপর পরীমনি ও অন্যরা বোটক্লাবে প্রবেশ করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আগে থেকেই ক্লাবে থাকা ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন ও আরেক আসামি শাহ শহিদুল আলমের সঙ্গে পরীমনি ও তার সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দেন তুহিন সিদ্দিকি অমি।
পরীমনি ও তার সঙ্গীরা বোটক্লাবের ওয়াশরুমে যান। সেখানে নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলমও যান। জিমি হ্যাফপ্যান্ট পরে বোটক্লাবে প্রবেশ করায় সেটি নিয়ে ওয়াশরুমেই শহিদুল আলমের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়।
এরপর ওয়াশরুম থেকে ফিরে তুহিন সিদ্দিকি, পরীমনি ও তাদের সঙ্গীরা মিলে দুই বোতল ব্লু লেভেল মদপান করেন। এ সময় আরেকটি টেবিলে বসা নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলমসহ অন্যরাও মদপান করেন।
এরপর রাত সোয়া একটার দিকে নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলম বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে পরীমনি ও অন্যান্যরা তাদের ফের ডেকে আনেন এবং টিভিতে গান ছেড়ে সবাই মিলে মদপান করেন।
অভিযোগপত্রে পুলিশ বলেছে, এ সময় পরীমনি ৬টি ব্লু লেভেল মদের বোতল পার্সেল নিতে চান। তবে বোটক্লাবে এক লিটারের ৬টি বোতল না থাকায় ওয়েটার পরীমনিকে জানান, একটি ৩ লিটারের বোতল আছে। তখন পরীমনি সে বোতলটি ওয়েটারকে দিয়ে আনান। পরীমনির সঙ্গে থাকা ফাতেমা তুজ জান্নাত বন্নিও ২টি রেড ওয়াইন পার্সেল নেন। তাদের আগে পান করা মদসহ বন্নির নেওয়া দুটি মদের বোতলের দাম আসে ৮৮ হাজার ৬১০ টাকা যা তুহিন সিদ্দিকি অমি পরিশোধ করেন।
অন্যদিকে পরীমনির নেওয়া ৩ লিটারের ব্লু লেভেল মদের দাম ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা হওয়ায়, সে বিল তুহিন সিদ্দিকি'র যেনো না দিতে হয় তাই তিনি 'কৌশলে' নাসির উদ্দিনকে দিয়ে বলান, এই বোতলটি ঢাকা বোট ক্লাবের স্যাম্পল। এটা পার্সেল দেওয়া যাবে না।
এসময় বোতলটি নিতে পরীমনি আরও আগ্রহী হয়ে গেলে, তার সঙ্গে নাসির উদ্দিন মাহমুদের কথা কাটাকাটি শুরু হয়।
পরীমনির সঙ্গে থাকা বন্নি ও জিমি তাকে নিষেধ করলে তিনি তাদের থাপ্পড় মেরে বলেন, 'আমি কি ড্রাংক?' এরপর নাসির উদ্দিন মাহমুদ তুহিন সিদ্দিকিকে বলেন, 'এরকম *****, *** মেয়েকে কেন ক্লাবে এনেছ?'
এ সময় জিমি নাসির উদ্দিন মাহমুদকে বাধা দেওয়াসহ ঘটনার ভিডিও করতে চেষ্টা করলে শাহ শহিদুল আলম জিমিকে থাপ্পড় মারেন ও হুমকি দেওয়া শুরু করেন। ফলে পরীমনি ক্ষিপ্ত হয়ে পেরিয়ার ওয়াটার (পানির বোতল), গ্লাস ও এসট্রে ভাঙেন এবং নাসির উদ্দিন মাহমুদকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারেন। তবে নাসির উদ্দিন মাহমুদ সরে যাওয়ায় সেগুলো তার গায়ে লাগেনি।
এসময় নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও শাহ শহিদুল আলম পরীমনির সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
তারপর এই দুই আসামি পরীমনিকে গালিগালাজ করতে করতে তাকে থাপ্পড় মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দেন এবং হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। রাত পৌনে দুইটার দিকে নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলম বোট ক্লাব থেকে চলে যান।
এসময় ক্লাবের ক্লাবের কর্মচারীরা পরীমনিকে ক্লাব থেকে বের হওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি সেখানে বসে থাকেন। ফলে তারা কিছু লাইট, এসি ও ফ্যান বন্ধ করে দেন। এ সময় পরীমনির শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ফের তারা এসি, ফ্যান ও লাইট চালু করেন দেন।
এরপর রাত দুইটার দিকে বোট ক্লাবের এক প্রহরীর সহায়তায় জিমি পরীমনিকে গাড়িতে তুলে দেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মামলাটি তদন্তকালে প্রতীয়মান হয়েছে, তিন লিটারের ব্লু লেবেলের দাম তুহিন সিদ্দিকি না দিয়ে 'কৌশলে' নাসির উদ্দিনকে দিয়ে ক্লাবের স্যাম্পল বলানোয়, সেগুলো নিতে আরও আগ্রহী হন পরীমনি। আর এটি নিয়েই নাসির উদ্দিনের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে আসামিরা এই চিত্রনায়িকাকে মারধর করে তার শরীরে জখম করেন এবং হুমকি ধমকি দেন।
অভিযোগপত্রে পুলিশ বলেছে, নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও শাহ শহিদুল আলম পরীমনির সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করা ও তার শরীরে স্পর্শ করে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করার বিষয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারাসহ পেনাল কোড ৩২৩/৫০৬ ধারার অপরাধ।
উল্লেখ্য, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, "যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানি করেন তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।"
এছাড়া এ কাজে সহায়তা করায় আসামি তুহিন সিদ্দিকী অমি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী/ ২০০৩) এর ৩০ ধারার অপরাধ করেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে মনে করেছে পুলিশ।
এই ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, "যদি কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা যোগান এবং সেই প্ররোচনার ফলে উক্ত অপরাধ সংঘটিত হয় বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টা করা হয় বা কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহা হইলে ঐ অপরাধ সংঘটনের জন্য বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টার জন্য নির্ধারিত দণ্ডে প্ররোচনাকারী বা সহায়তাকারী ব্যক্তি দণ্ডনীয় হইবেন।"
অভিযোগপত্রে পুলিশ বলেছে, তদন্তকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এর ৯(৪) (খ) ধারায় ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ ও পেনাল কোড ৫১১ ধারায় ভয় দেখানোর অপরাধ প্রমাণের স্বপক্ষে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ আদালতকে জানিয়েছে, নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও শাহ শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে যৌনপীড়ন, নির্যাতন এবং হুমকির প্রমাণ ও তুহিন সিদ্দিকি অমির বিরুদ্ধে এ কাজে সহায়তা করার প্রমাণ পেয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
- বি.দ্র: অভিযোগপত্রে আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদের উচ্চারিত দু'টি শব্দ নারীর প্রতি অবমাননাকর হওয়ায়, শব্দদু'টি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদনে পরিহার করা হয়েছে।