পর্যটকে সরগরম কক্সবাজার
করোনা মহামারি দীর্ঘ ৫ মাসেরও অধিক সময় জনবিচ্ছিন্ন রেখেছিল কক্সবাজারের পর্যটন স্পটগুলো। করোনা প্রাদুর্ভাবে গত ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ হওয়া পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ প্রায় ৫ মাস পর আনুষ্ঠানিকভাবে 'পরীক্ষামূলক খুলে দেয়া' হয় ১৭ আগস্ট (সোমবার)। স্বাস্থ্যবিধি মানা সাপেক্ষে সীমিত আকারে চালু হওয়া পর্যটনে এখন সরগরম অবস্থা বিরাজ করছে কক্সবাজারে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং অন্যান্য বন্ধে পর্যটকে উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে সৈকতে। সম্প্রতি শেষ হওয়া দূর্গাপুজার ছুটিতেই লোকারণ্য ছিল কক্সবাজার। সপ্তাহিক ছুটির দিনেও একই চিত্র। ফলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই পূর্ণ হয়ে গেছে সৈকত তীরের হোটেল-মোটেল-কটেজ ও গেস্ট হাউজগুলো। এই অসময়েও মাসে শতকোটি টাকার বাণিজ্য করছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ধারা অব্যাহত থাকলে করোনার প্রথম ধাক্কার ক্ষতি পুষিয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালীন স্তব্ধ হয়ে থাকা পর্যটন এলাকা ১৭ আগস্ট খুলে দেয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই ভ্রমণ পিপাসুদের ভিড় বাড়ছিল কক্সবাজারে। এখন সরকারি ছুটি উপলক্ষে টানা বুকিংও পাচ্ছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। মূলত শুক্র-শনিবার সপ্তাহিক ছুটি মাথায় রেখেই পর্যটকরা আগাম বুকিং দিচ্ছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজ (১৩ নভেম্বর) পর্যটকে উপচে পড়ছে কক্সবাজার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে পর্যটকদের আগমন শুরু হয়। অনেকে এসেছেন পারিবারের সদস্যদের নিয়ে।
শুক্রবার সকাল থেকেই পর্যটকের উল্লাসে মুখরিত হতে শুরু করে সমুদ্র সৈকতসহ দর্শনীয় স্থানগুলো।
আগত পর্যটকরা সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি দরিয়ানগর, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানীর পাথুরে সৈকত, রামু বৌদ্ধ বিহার, মহেশখালী আদিনাথ মন্দিরসহ জেলার পর্যটন স্পটগুলোতেও ঢুঁ মারছেন।
কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারের প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও কটেজে রয়েছে, যেখানে লক্ষাধিক পর্যটক অবস্থান করতে পারেন। সপ্তাহিক ছুটিতেও প্রায় লাখো পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। শতভাগ বুকিংয়ে জমজমাট ব্যবসা করছে তারকা হোটেলগুলো।
কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি সূত্র জানায়, আগত পর্যটকদের সেবা নিশ্চিতে সর্তক অবস্থায় দায়িত্বপালন করছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশ। সপ্তাহিক ছুটিতে পর্যটক সমাগম বাড়ছে দেখে মোতায়েন রাখা হয় অতিরিক্ত পুলিশও। পর্যটক হয়রানি রোধে পর্যটন স্পটগুলোকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে দ্রুত সাধারণ চিকিৎসা ও খাবার পানির ব্যবস্থা রয়েছে সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রে গোসল করতে গিয়ে বিপদাপন্ন হলে পর্যটকদের রক্ষার্থে সর্তক অবস্থায় রয়েছেন লাইফগার্ড কর্মীরা।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে আসা পর্যটক রবিউল হাসান জানান, করোনা একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘদিন কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ির সবাই আতংক নিয়ে কাটিয়েছি দীর্ঘ ৮ মাস। এখন আবার দ্বিতীয় ফ্লু শুরুর শংকার কথা বলা হচ্ছে। তাই মানসিক প্রশান্তির আশায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে সৈকতের নোনাজলের সান্নিধ্য নিতে এসেছি। পরিবারসহ খুবই মজা করছি।
সি-সেইফ লাইফগার্ড সুপারভাইজার মোহাম্মদ ওসমান বলেন, দুর্গাপূজার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন পর্যটকরা সৈকতে ভিড় বাড়াচ্ছেন। শুক্র ও শনিবার এ মাত্রা বাড়ে। করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রতিনিয়ত মাইকিং করা হলেও বালিয়াড়িতে আসা পর্যটকদের অধিকাংশই মাস্ক পরে নামেন না। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় অব্যাহত রাখলেও পর্যটকরা সচেতন হচ্ছেন না।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোরাদ ইসলাম জানান, পর্যটক হয়রানি বন্ধে হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় মূল্য তালিকা টাঙ্গানোর নির্দেশনা আগেই দেয়াছিল। সমুদ্র সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা, কলাতলীসহ ১১টি পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে তথ্য কেন্দ্র (ইনবক্স)। পাশাপাশি দেয়া হয়েছে একটি হটলাইন নম্বর (০১৭৩৩৩৭৩১২৭)। যে কোনো অভিযোগ এখানে করতে পারবে পর্যটকরা। হটলাইনের সেবা নিয়ে ইতোপূর্বে অগণিত পর্যটক হয়রানির বিচার পেয়েছেন। জরিমানা করা হয়েছে কয়েকটি রেস্তোরা ও হোটেলকে। এখন করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সর্বদা সচেতনতা মূলক মাইকিং ও প্রয়োজনে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় সবসময় সর্তকাবস্থায় রয়েছে পুলিশ। পর্যটকরা যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্খিত হয়রানির শিকার না হন, পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে এবং পর্যটক বেশে পুরুষ-মহিলা পুলিশের সংখ্যাও সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় সৈকত এলাকায় পোশাকধারী পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের বিশেষ রেসকিউ টিম, ইভটিজিং কন্ট্রোল টিম, ড্রিংকিং জোন, দ্রুত চিকিৎসাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে পর্যটকদের নিরাপত্তায়। সৈকতে বীচ বাইক নিয়ে টহল অব্যাহত রেখেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। রয়েছে ৩টি বেসরকারি লাইফ গার্ড সংস্থার অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড কর্মী। কন্ট্রোল রুম, পর্যবেক্ষণ টাওয়াসহ পুরো সৈকতে পুলিশের নজরদারির আওতায় রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, পর্যটন সম্ভাবনাময় শিল্প। করোনার প্রথম প্রবাহের পর দীর্ঘ ৫ মাসের অধিক কক্সবাজারে সমস্ত কিছু বন্ধ ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা চিন্তা মাথায় রেখে অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে হোটেল-রেস্ট্যুরেন্টসহ পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো 'পরীক্ষামূলক খুলে দেয়া' হয়। সামনে পর্যটন মৌসুম আসছে। আবার করোনার দ্বিতীয় ফ্লুর ওয়েভের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা রোধের পাশাপাশি পর্যটনটাও এগিয়ে নিতে হবে। সেভাবেই পর্যটন সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেয়া রয়েছে। সবাই আন্তরিক হলে পর্যটন ব্যবসা ঠিক রেখে করোনা রোধ সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।