পলিথিনে অচল কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং প্রকল্পে ব্যয় এবং সময় দুটোই বেড়েছে। নদীতে পলিথিনসহ বিভিন্ন বর্জ্যের কারণে কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় প্রকল্প সংশোধন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প বাস্তবায়নে মেয়াদ ১ বছর বাড়ার পাশাপাশি ব্যয় বেড়েছে ৬৩ কোটি টাকা।
সংশোধিত প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রকল্পের কাজের সময়সীমা ২০২১ সালের জুন থেকে বাড়িয়ে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে কর্ণফুলী নদী থেকে বর্জ্যরে পরিমান বৃদ্ধি এবং অপসারণ ব্যয়কে উল্লেখ করেছেন প্রকল্প পরিচালক।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলী নদীতে বর্জ্য ও পলিথিন পড়া বন্ধ না করলে এসব ড্রেজিং প্রকল্প কোন কাজে আসবেনা।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে ওয়াসার কোন পয়:নিষ্কাষন ব্যবস্থা না থাকায় পলিথিনসহ নগরীর প্রায় ৬০ লাখ বাসিন্দার বর্জ্য ৩৬ টি খালের মাধ্যমে সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। চট্টগ্রাম ওয়াসার হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ লিটার গৃহস্থালি বর্জ্য, কয়েকশ টন শিল্প কারখানার ক্যামিকেল পড়ে এ নদীতে।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা কমিটির তথ্য মতে, বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সাথে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টন পলি গিয়ে পড়ে এ নদীতে। মানুষের বর্জ্য, পলিথিন ও পলি মিলে কর্ণফুলী নদীতে প্রায় ১০ মিটার পলিথিনের স্তর সৃষ্টি হয়েছে যা ড্রেজিং কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে।
ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কর্ণফুলী নদীতে জমে থাকা পলিথিনের কারনে ড্রেজিং প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সাথে বেড়েছে বর্জ্যের পরিমান। ২০১৮ সালে যখন নতুনভাবে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় তখন বর্জ্যের পরিমান ধরা হয়েছিলো ৪২ লাখ ঘনমিটার। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ লাখ ঘনমিটার। বর্জ্যের পরিমান বৃদ্ধি এবং তা সরানোর জন্য বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়।
তিনি আরো বলেন, গত ১২ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রনালয় সভায় কর্ণফুলী ড্রেজিং প্রকল্পের সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) পাশ হয়। শীঘ্রই একনেকের সভায় সেটি চূড়ান্ত হবে। প্রকল্পের ব্যয় ২৫৮ কোটি টাকা থেকে ৬৩ কোটি টাকা বেড়ে ৩২১ কোটি টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ ৩৯% শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় ৩.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করার কথা।
তিনি আরো বলেন, ড্রেজিং থেকে উত্তোলিত বালি ও মাটি নগরীর হামিদচর এলাকা ভরাট করার কাজে ব্যবহৃত হবে। ফলে বালু তুলে বর্জ্য বোঝাই করে সেখানে নিয়ে যাওয়ারও খরচ বেড়েছ।
দেশের ৯২ ভাগ আমদানি-রপ্তানি সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। কর্ণফুলী নদীর তীঁর ঘেষেই এই বন্দরের জেটি, ইয়ার্ড এবং অন্যান্য স্থাপনার অবস্থান। সে কারণে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা বন্দর এবং অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন।
কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যাপক প্রফেসর মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, "নগরীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা পয়:নিষ্কাষন ব্যবস্থাপনা না থাকার কারনে বর্জ্য ও পলিথিন সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ে। ফলে ড্রেজিং করলেও একইভাবে এসব বর্জ্য নদীর তলদেশ আবার ভরাট করে দেবে। পয়:নিষ্কাষন ব্যবস্থা না করে এবং এভাবে কর্ণফুলী নদীতে পলিথিন গিয়ে পড়লে এই ড্রেজিং কোন কাজে আসবে না। প্রথমে নগরীকে পয়:নিষ্কাষন ব্যবস্থায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, কোনভাবেই প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়তে দেওয়া যাবেনা"।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের এই সহসভাপতি আরো বলেন, দেশী এবং বিদেশী কোম্পানীর এসব পলিথিন উত্তোলনে অভিজ্ঞতা না থাকার কারনেও ড্রেজিং কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এই নদীকে রক্ষা করতে হলে স্থায়ীভাবে নদীতে বর্জ্য এবং পলিথিন পড়া বন্ধ করতে হবে।
বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১১ সালে ২২৯ কোটি টাকার কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। কাজ দেয়া হয় মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। সদরঘাট এলাকায় লাইটার জেটি নির্মাণসহ কিছু কাজ করলেও ২০১৩ সালে পুরো কাজ না করেই চলে যায় মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে এই অভিযোগে বন্দর কর্তৃপক্ষ চুক্তি বাতিল করে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আইনি জটিলতার কারণে প্রায় পাঁচ বছর বন্ধ থাকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে 'সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং' প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের মে মাসে ২৫৮ কোটি টাকায় নৌবাহিনীর সঙ্গে বন্দরের চুক্তি হয়। নৌবাহিনীর মাধ্যমে দেশীয় কোম্পানী সাইফ পাওয়ারটেক এর সিস্টার কনসার্ন ই-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পটির কাজ করছে। ই-ইঞ্জিনিয়ারিং ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করে। কিন্তু নদীতে প্রচুর পরিমাণে পলিথিন এবং প্লস্টিক বর্জ্য থাকার কারনে পর কাজ বার বার বাধাগ্রস্ত হয়।
ই-ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রজেক্ট ম্যানেজার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই প্রকল্পের বড় বাধা দীর্ঘদিনের জমে থাকা বর্জ্য। পলিথিন, লোহা, গাছের টুকরাসহ বিভিন্ন বর্জ্যের কারণে ড্রেজিং ঠিকমতো কাজ করেনা। বর্তমানে ১ টি ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ চলছে। পুন:নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে"।