পল্লী অঞ্চলে সরকারি হাউজিং প্রকল্প, মিলবে খামার সুবিধাসহ অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট
চার সন্তানসহ রংপুরে পৈত্রিক বাড়িতে বাস করেন মো. কামরুজ্জামান। যৌথ পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। এক বাড়িতে গাদাগাদি করে সবাইকে থাকতে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারি পল্লী জনপদ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত পল্লী জনপদ হাউজিং কমপ্লেক্সে প্রায় ১৩৮৪ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করছেন তিনি। ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে নীতিমালা অনুযায়ী ফ্ল্যাটের ৩০ শতাংশ অগ্রীম মূল্যও জমা দিয়েছেন।
ঠিকাদার ব্যবসায়ী মো. কামরুজ্জামান জানান, তিনি চাইলে আলাদা জমি কিনে বাড়ি বানাতে পারতেন। কিন্ত সরকার রংপুরে যে পল্লী জনপদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছে, সেখানে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ আধুনিক সুবিধা আছে। এছাড়া গবাদি পশু পালনের ব্যবস্থাও আছে। এসব সুযোগ সুবিধা বিবেচনায় তিনি পল্লী জনপদ কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট নিতে আগ্রহী।
কৃষি জমি বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সরকার সারা দেশে পল্লী জনপদ কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যেখানে থাকছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা । এর অংশ হিসেবে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথমে রংপুরের সদর উপজেলা, বগুড়ার শাহজাহানপুর এবং গোপালগঞ্জ সদরে পাইলট পল্লী জন কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনে বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমি (আরডিএ) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
সাশ্রয়ী মূল্য এবং সহজ কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের সুযোগ থাকায় এসব ফ্ল্যাটে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। ইতোমধ্যে রংপুর কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করছেন এক হাজার ৯৩ জন। পল্লী এলাকার কৃষক থেকে শুরু করে সারা দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এসব ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করেছেন।
রংপুর শহরের জিরোপয়েন্ট থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পান্ডারদীঘি এলাকায় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি হাউজিং পল্লী জনপদ কমপ্লেক্স। প্রায় চার একর জমিতে ২৭২ ফ্ল্যাটের কমপ্লেক্স নির্মাণের ৯৫ শতাংশ কাজই শেষ। এখন আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। অক্টোবরের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সটির উদ্বোধন করতে পারেন। এরপরই ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করা হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক দেলোয়ার হোসেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নীতিমালা অনুসারে পল্লী জনপদ প্রকল্পের তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এই হিসাবে রংপুর প্রকল্পের যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি ইউএনও (রংপুর সদর) মোছা: নুর নাহার বেগম। তিনি টাকা জমা দেওয়া ব্যক্তিদের তথ্য যাচাই-বাছাই করবেন। রংপুরে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে যাচাই-বাছাই শেষ হবে বলে ধারণা করছেন তারা। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে রংপুরে ফ্ল্যাটের জন্য অনেকে আবেদন করলেও আস্থা সংকটসহ বিভিন্ন কারণে ডাউন পেমেন্টে টাকা জমা দেননি বলে জানা গেছে। রংপুরে ফ্ল্যাটের মোট আবেদনকারীর মাত্র ২৪৬ জন ডাউন পেমেন্টের টাকা জমা দিয়েছেন। গত ১৫ জুলাই ছিল ডাউন পেমেন্ট জমা দেওয়া শেষ তারিখ। তবে দেশের কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় ডাউন পেমেন্ট জমা দেওয়ার সময় আরও বাড়ানো হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক দোলোয়ার হোসেন।
প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী ফ্ল্যাটের মূল্যের ৩০ শতাংশ অর্থ অগ্রীম জমা না দিলে আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। রংপুরের চিকিৎসক রুবায়েত উল ইসলাম জানান, তিনি অনেক আগে আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রকল্পে বাস্তবায়ন কাজের বিলম্বের কারণে এতদিন তার আগ্রহ কমে গিয়েছিল। আগামী মাসে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের কথা শুনে তিনি খুব দ্রুত ডাউন পেমেন্টে টাকা জমা দেবেন বলেন জানান।
এদিকে আবেদন করেও ডাউন পেমেন্টের টাকা জমা না দেওয়ায় অনেকের আবেদন বাতিল হচ্ছে বলে আরডিএ সূত্রে জানা গেছে।
ব্যবসায়ী সোহরাব আলী বলেন, "প্রথমে আবেদন করেছিলাম। পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি এবং ডাউন পেমেন্ট জমা দেইনি । কারণ রংপুরের মানুষ খোলামেলাভাবে বাস করতে চায়। বসবাসের জন্য এসব ফ্ল্যাট সুবিধাজনক হবে না।"
বগুড়ার পল্লী কমপ্লেক্স নির্মাণ হচ্ছে শাহাজানপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামে। এরই মধ্যে বগুড়ায় ৫.৬৭ একর জমির হাউজিং কমপ্লেক্সের কাজ ৫০ শতাংশ ও ৪.২৬ একরের ওপর নির্মিত গোপালগঞ্জ প্রকল্পের কাজ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শেষ হয়েছে।
বগুড়ায় ইতোমধ্যে আবেদন করেছে এক হাজার ৩৫৪ জন। গোলাপগঞ্জে আবেদন পড়েছে ৮৬৯টি। তবে এ দুটি কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাটের আবেদনের সময় এখনো নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। যে কেউ এখনও ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
পল্লী জনপদ প্রকল্পে ফ্ল্যাট পাওয়ার ক্ষেত্রে চার ধরনের ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পাবেন। তারা হলেন, ওই প্রকল্পে জমি বিক্রিকারী, সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা (গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা), রেমিট্যান্স যোদ্ধা এবং দেশের যেকোনো জায়গার মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। এছাড়াও জেলা, বিভাগ এমনকি সারাদেশ থেকে এসব ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করতে পারবেন আগ্রহীরা। চাকুরিজীবী ও ব্যবসায়ীরাও ফ্ল্যাট নিতে পারবেন।
ফ্ল্যাটের বিবরণ
চার তলা ভবনে চার ধরনের ফ্ল্যাট রয়েছে পল্লী জনপদে কমপ্লেক্সে। সবচেয়ে বড় 'এ' টাইপের ফ্ল্যাট হবে ১৩৮৩.৮২ বর্গফুট এবং সবচেয়ে ছোট 'ডি' টাইপের ফ্ল্যাট হবে ৫৫২ বর্গফুটের। এছাড়া 'বি' ও 'সি' টাইপের ফ্ল্যাটের আয়তন হবে যথাক্রমে ১০৭৩.৭৯ এবং ৬৯৫.৬৯ বর্গফুট।
জনপদ ভবনে প্রতিটি পরিবারের ২৭টি হাঁস-মুরগী ও কমপক্ষে একটি গরু পালনের জন্য তিন তলা বিশিষ্ট ক্যাটেল হাউজ থাকবে। এছাড়া কৃষি পণ্য সংরক্ষণ, নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, বিকল্প হিসেবে সৌর বিদ্যুৎ এবং রান্নার জন্য বায়ো গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ থাকবে।
সবচেয়ে কম দামে 'ডি' টাইপের ফ্র্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। 'এ' টাইপের ফ্ল্যাটের মূল্য ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। 'বি' টাইপের ফ্ল্যাটের মূল্য ১১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা এবং 'সি' টাইপের ফ্ল্যাটের মূল্য সাত লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ১৫ বছরে এ মূল্য পরিশোধ করার সুযোগও রাখা হয়েছে।
বাদ পড়েছে চারটি ভবন নির্মাণের কাজ
২০১৪ সালে নেওয়া প্রকল্পের আওতায় শুরুতে সাত বিভাগের সাতটি ভবন নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। কিন্ত সম্প্রতি সরকার প্রকল্পে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। চার বিভাগের পল্লী জনপদ ভবন আপতত বাদ দেওয়া হয়েছে। খুলনার বাটিয়াঘাটা, কক্সবাজারের খরুশকুল এবং সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় পল্লী জনপদ ভবনের প্রস্তাব ছিল প্রকল্পে। তবে বরিশাল বিভাগের পল্লী জনপদ ভবনের জন্য জায়গা চিহ্নিত করা হয়নি।
পল্লী জনপদ কমপ্লেক্স নির্মাণে সাত থেকে তিনটিতে নেমে আসায় প্রকল্পের ব্যয়ও ৪২৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২৪৭ কোটি টাকা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাবও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
স্থানীয় সরকার ও সমবায় বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পল্লী জনপদে যারা আবেদন করছেন, সেসব উপকারভোগীর মতামতের ভিত্তিতে বাকি পল্লী কমপ্লেক্সগুলো নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ কারণে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা হচ্ছে। তবে বাকি চারটি বিভাগেও পল্লী জনপদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, "পল্লী জনপদ প্রকল্পে সব শ্রেণির মানুষের আবেদন করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। নামের সঙ্গে মিল রেখে শুধু পল্লীর মানুষ আবেদন করবেন তা নয়। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো কৃষিজমি রক্ষা করা। অনেকে চাকরি কিংবা ব্যবসা করে কৃষি জমি কিনে সেখানে বাড়ি করছেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি বছর এক শতাংশ কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। এতে কৃষি জমির অপচয় হচ্ছে। পল্লী জনপদ প্রকল্পের রূপরেখা অনুসারে সারাদেশে প্রকল্প হাতে নিলে কৃষি জমি রক্ষা পাবে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই মূলত এই প্রকল্প। এটি সফল প্রকল্প হবে বলে আমরা আশা করছি।"
প্রকল্প নেওয়ার আগে শুরু থেকে এ কাজে যুক্ত ছিলেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি টিবিএসকে বলেন, "পল্লী জনপদ কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্পটি ভালো প্রকল্প। কৃষি জমি বাঁচানো এর মূল উদ্দেশ্য। অনেকে কৃষি জমিতে বাড়ি করছে। এ প্রকল্পটি সফল হলে কৃষজমির ওপর চাপ কমবে।
"তবে, এটি সফল করতে হলে গ্রামের মানুষকে কম দামে ফ্ল্যাট দিতে হবে। এখানে সরকার ব্যবসা করতে পারবে না। ফ্ল্যাটের জায়গার পরিমাণও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফ্ল্যাটের আকার ছোট হলে মানুষে এতে আগ্রহী হবে না। গ্রামের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে ভবিষ্যতে ভবন নির্মাণ করা গেলে প্রকল্পটি আকষণীয় হবে এবং পল্লীবাসীর আগ্রহ বাড়বে।"
প্রচারণার ঘাটতি
এদিকে প্রকল্প থেকে সঠিকভাবে প্রচারণা না চালানোর অভিযোগ করছেন অনেকে।
সরকারিভাবে এভাবে কিস্তির সুযোগে ফ্ল্যাট পাওয়ার বিষয়ে আরডিএ কোনো প্রচারণা চালায়নি বলে অভিযোগ রংপুর সদরের নিউবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. নুরুজ্জামানের। তিনি বলেন, "নিউবাজার প্রকল্প এলাকা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। পল্লী জনপদ প্রকল্প নির্মাণ শেষ হওয়ার পর মানুষ জানতে পেরেছে এটি সরকারি। ততোদিনে এখানে আবেদন করার সময়ও শেষ হয়ে গেছে।"
প্রকল্পে ফ্ল্যাট পাওয়ার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে অভিযোগ করছেন বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা।
শাহজাহানপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার গৌর গোপাল গোস্বামী বলেন, "বগুড়ায় কোথায় পল্লী জনপদ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ হচ্ছে আমরা তা জানি না। মুক্তিযোদ্ধাদের জানানো হয়নি।"
একই অভিযোগ করেছেন আড়িয়া ইউনিয়নের আরেক মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী।
এ বিষয়ে আরডিএ কর্মকর্তারা জানান, এটা সরকারের একটি বহুল আলোচিত প্রকল্প। যেসব উপজেলায় পল্লী জনপদ ভবন হচ্ছে, সেখানে ব্যাপকভাবে লিফলেট বিলি করা হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকাতেও বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
আরডিএ'র ওয়েবসাইট ছাড়াও টেলিভিশন ও দৈনিক পত্রিকায় বহু প্রতিবেদনে এই প্রকল্প আলোচনায় এসেছে বলেও জানান তারা।